মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত কিংবদন্তী – তাড়াশের গর্ব গাজী আব্দুর রহমান মিঞা

Spread the love

সুজন কুমার মাল

 

চলনবিল অধূষ্যিত পাবনা জেলার অধীনে ছিল তাড়াশ নামের একটি উপজেলা। পরবর্তীতে পাবনা জেলা হতে আলাদা করে সিরাজগঞ্জ জেলা ঘোষণা করা হয়। আর এই তাড়াশ জনপদটি  ছিল তৎকালীন ৭জন জমিদারের শাসনাধীন এলাকা। ১৯২৫ সালের ১৩ই মার্চে জন্মগ্রহণ আব্দুর রহমান মিঞা। তার পিতা ছিলেন ভাদাশ গ্রামের মরহুম রায়হান উদ্দিন । মাত্র ৮ বছর বয়সে তার মা মারা যান। সাংসারিক অবস্থা তেমন ভাল না হওয়ায় অন্যের বাড়িতে জায়গীরদার হিসেবে থেকে ১৯৩২ সালে বস্তুল হাইস্কুলে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা করেন তিনি। আনুমানিক ১৯৩৫ সালের দিকে দেশব্যাপী মহামারী আকাল (খাদ্য সংকট) দেখা দেয় । সে সময়ে জমি আছে কিন্ত জমিতে উৎপাদিত ফসল নেই কোন। এমন এক সময়ে তার বোন মারা যান। তারপরেও শত অভাব-অনটন, দুঃখ, দুর্দশাকে সহ্য করে ১৯৪২ সালে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন। ব্রিটিশ সরকারের শোষণ নিপীড়ন, নির্যাতন, জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ আন্দোলনের তৎকালীন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ মাওলানা সেরাজুল হকের সাথে থেকে রাজনৈতিক হাতে খড়ি হয় আব্দুর রহমান মিঞার।  রাজনৈতিক শত বাধা বিপত্তি আসলেও তিনি থেমে যাননি। তারপরেও তিনি আইএ পাশ করেন সুনামের সহিত।

 

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরে ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের দিকে আনসার বাহিনীর আত্মপ্রকাশ ঘটে। মাত্র ৪ দিনের প্রশিক্ষণে উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন তিনি। সেই সময়ে বারুহাসের চৌধূরী পরিবারের অন্যতম সদস্য দাদ আলী খাঁন ছিলেন প্রশিক্ষক। তৎকালীন তাড়াশ থানার এক দারোগার অনুরোধ পত্রের মাধ্যমে প্রশিক্ষণকালীন যোগ্যতা ও অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় তিনি আনসারের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পান। পরবর্তীতে সিরাজগঞ্জ মহকুমায় শীতকালীন মহড়ায় ১৫ দিন ব্যাপী প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। প্রশিক্ষণ চলাকালীন পিটি প্যারেড পরিদর্শনে আসেন পি.এ, নাজির  ও এস.ডিও কর্মকর্তাবৃন্দ । তারা আব্দুর রহমান মিঞার প্রশিক্ষণ কার্যক্রম দেখে তাকে মহকুমা প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলেন। এ ঘটনার ২ বছর পরেই মিলিটারীতে লোক নিয়োগের চিঠি আসে। সেই চিঠি অনুসারে রংপুরে এরশাদ সাহেব তাকে মিলিটারী বাহিনীর দ্বিতীয় সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করেন ঢাকার সাভারে প্রশিক্ষণের জন্য । প্রায় ৬ মাসের প্রশিক্ষণ কোর্স করতে হয় পশ্চিম পাকিস্তানের মোহাম্মদ আলীর নিকটে। চাকুরী করার জন্য তাড়াশ থানায় পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়। কিন্ত সে সময় তার বড় ভাইয়ের আপত্তিতে মিলিটারীর চাকুরীতে যোগ দিতে পারেনি আব্দুর রহমান মিঞা।

পরবর্তীতে সিরাজগঞ্জ মহকুমায় আনসার ক্যাম্পে প্রধান প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন তিনি। এরপরে বৈবাহিক জীবন শুরু করেন আব্দুর রহমান মিঞা। এভাবেই ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবন বাজী রেখে দেশকে স্বাধীন করতে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। আব্দুল লতিফ মির্জা , সোহরাব আলী সরকারের নেতৃত্বে যুদ্ধকালীন সংগঠন পলাশডাঙ্গা যুব শিবির গঠন করা হয়।  ওই সংগঠনে তিনি অস্ত্র প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘ নয় মাসের দুই মাস দিনরাত হাতে কলমে ও অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে অবশিষ্ট ৭ মাসে কম বেশী ১৩টি পাক সেনাদের সন্মুখ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন তিনি। এর মধ্যে নওগাঁ শাহ শরীফ জিন্দানী (রঃ) পূণ্যভূমিতে ১৯৭১ সালের ১১ নভেম্বরে ত্রিমুখী আক্রমণে জীবন-মরণ অবস্থার সৃষ্টি হয় তার। তাড়াশ থেকে নওগাঁ যাওয়ার পথে  রংমহল এলাকার প্রাইমারী স্কুলের পাশে তাড়াশ-নওগাঁ, রায়গঞ্জ-নওগাঁ, উল্লাপাড়া-নওগাঁ, গুরুদাসপুর-নওগাঁ, সিংড়া-নওগাঁ,শেরপুর – নওগাঁ  রাস্তা সমূহের সংযোগস্থল ছিল। এই পথ দিয়ে পাকবাহিনী , রাজাকার, মিলিশিয়া একই সাথে নওগাঁয় প্রবেশের চেষ্টা করে। ওই সংযোগ সড়কে আব্দুর রহমান মিঞা সহ আরো ৭জন মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ করেছিলেন। সেই যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকসেনাদের গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছিল। তাদের অস্ত্র-শস্ত্র সংগ্রহ করা হয় এবং ক্যাপ্টেন সেলিম আত্মসমর্পণ করেন। এদিকে আত্মসমর্পণকৃত ক্যাপ্টেন ও উদ্ধার করা অস্ত্র নিয়ে লতিফ মির্জার নিকটে হস্তান্তর করেন। এ সময় ক্যাপ্টেন সহ আরো ৫জনকে গুলি করে রাস্তার ওপর মেরে ফেলেন আব্দুল লতিফ মির্জা।

এর আগে নওগাঁ যুদ্ধের আগের দিন (বুধবার) আব্দুল লতিফ মির্জার উল্লাপাড়ার প্রতাপহাট এলাকায় ফুফুর বাড়িতে সকল যোদ্ধাদের খাওয়ার আয়োজন করা হয়। সেখানে ক্যাম্পের ওপর চতুর্দিক থেকে হামলা হতে পারে বলে এমন সংবাদ রয়েছে পরিচালক জানান সকল যোদ্ধাদের। যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি জানতে পারেন, তার সন্তান সম্ভবা স্ত্রী যে সন্তান জন্ম দেন সেই সন্তান জন্মের ঘন্টা খানেকের মধ্যেই মারা যায়। যুদ্ধ পরবর্তী স্বাধীন দেশে মাধাইনগর ইউনিয়নে চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি নির্বাচিত হন। জনগণের আস্থা, সেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার স্বরুপ তাড়াশ উপজেলার ৭নং মাধাইনগর ইউনিয়নের টানা ৩ বার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে তৎকালীন ছাত্রনেতা রাজনৈতিক কোন্দল দেখা দেয়। সেই সময়ে সেরাজুল আলমের নেতৃত্বে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠন করা হয়। সেই দলের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনিও সেই দলের সদস্য হিসেবে ভর্তি হন। এদিকে ১৯৭১ সালের ২রা মার্চে বাংলাদেশের সৃষ্টি লগ্নের সময় বাংলাদেশের ম্যাপ সম্বলিত যে পতাকা তৈরী করে উত্তোলন করেছিলেন  আ.স.ম আব্দুর রব। আর সেই আ.স.ম আব্দুর রবের জে.এস.ডি জাসদের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

পরবর্তীতে দেশে স্বনির্ভর আন্দোলন শুরু হয়। মাহবুব আলম চাষী ছিলেন এই আন্দোলনের পরিচালক। সে সময়ে আব্দুর রহমান মিঞা প্রায় ১৪ দিন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন রংপুর জেলার সাদুল্ল্যাপুরে। সেই প্রশিক্ষণে ওই এলাকা সহ স্বাধীন দেশের কোথায় কি সমস্যা-সম্ভবনা তা চিহিৃতকরণ করতে হবে। ‘‘ বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় কি কি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে ?’’ – শীর্ষক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেন তিনি। সেই প্রতিবেদনে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় তালগাছ রোপণের কথা তিনি উল্লেখ করেন। কেন তালগাছ রোপণ করতে হবে ? তাল গাছ রোপণ করলে কি কি উপকার হবে তার ওপর বিশদ ব্যাখা দেন। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় শ্রেষ্ঠ প্রতিবেদক হিসেবে স্বর্ণপদক লাভ করেন। তারই ধারাবাহিকতা তাড়াশ-ভূইঞাগাঁতী সড়কে তিনি তালগাছ রোপণ করেন। এই সড়কটি তালসড়ক নামে পরিচিত। পশ্চাৎপদ এই জনপদে শিক্ষার আলো জ্বালানোর দায়িত্ব নিয়ে গাজী আব্দুর রহমান মিঞা তাড়াশ ডিগ্রী কলেজ, তাড়াশ মহিলা ডিগ্রী কলেজ, জে আই টেকনিক্যাল স্কুল এ্যান্ড কলেজ , তাড়াশ মহিলা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার সময় ও এলাকার জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ভাদাশ মৌজা হাসপাতাল স্থাপনের ক্ষেত্রে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন। গাজী আব্দুর রহমান মিঞা তাড়াশ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের একবার কমান্ডার ও দুই বার সাংগঠনিক কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন।

জনাব রহমানের অন্য একটি বিশাল অবদান হল, ১৯৮০ সালে তাড়াশের ঐতিহ্যবাহী তাড়াশ প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠায়ও তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। সেসময় তিনি কিছুকাল সাংবাদিকতায় জড়িত ছিলেন। শুধু তাই নয় উদ্বোধনের পর প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে তাড়াশ প্রেসক্লাবের কার্যালয় তৎকালে তাড়াশ বাজারে তার নিজস্ব ঘরে অনেক দিন অবস্থিত ছিল। তাই সার্বিক বিচার-বিবেচনায় তিনি তাড়াশের  একজন কৃতি সন্তান, তাড়াশের গর্ব। ব্যক্তিগত জীবনে গাজী আব্দুর রহমান মিঞা এক মেয়ে ও এক ছেলের পিতা। ছেলে ও মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। সম্প্রতি তার স্ত্রীও মারা গেছেন।। বয়স হয়েছে,শারীরিক শক্তিও আগের মত নেই। প্রবল ইচ্ছা ও মানসিক শক্তিকে পুঁজি করে এখনো জীবন যুদ্ধে অপরাজেয় এই মুক্তিযোদ্ধা থেমে যাননি। বিশেষ করে সমাজের অন্যায়-অবিচার সম্পর্কে তিনি এখনো সোচ্চার কণ্ঠ। আমরা তাড়াশবাসী অনেক গুণে গুণান্বিত এই মহৎপ্রাণ মানুষটির সুস্বাস্থ্য এবং দীর্ঘায়ু কামনা করি।

 

লেখক: তরুণ সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইমেইল: ংঁলড়হশঁসধৎসধষ৪@মসধরষ.পড়স  , মোবাইল:  ০১৭৭২-৮১০৩৮৮

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD