‘মিনি এমপি’ থেকে সাবধান!

Spread the love

আবুল কালাম আজাদ:

গুরুদাসপুরে তাঁকে ‘মিনি এমপি’ বলেন স্থানীয়রা। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। আওয়ামী লীগ নেতা নজরুল তাঁর কথা ও কাজের মাধ্যমে নানা আলোচিত ঘটনার জন্ম দিয়েছেন এলাকায়। এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগবাণিজ্যসহ নানা অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। সর্বশেষ মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার মুজিব জন্মশতবর্ষের উপহার  আশ্রয়ণ প্রকল্পের বিনামুল্যের  ঘর দেওয়ার নামে ভুমিহীন-গৃহহীনদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন তিনি। পরে সেই টাকা ফেরত দিয়েছেন ইউএনও শ্রবনী রায়।গুরুদাসপুরে বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে দরিদ্র গৃহহীনদের মাঝে আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধীনে দুই কক্ষ বিশিষ্ট আধা পাকা টিন শেড ঘর দেওয়ার কথা বলে টাকা নিয়েছেন মিনি এমপি খ্যাত নজরুল ইসলাম। উপজেলার বৃন্দাবনপুর গ্রামের মৃত আব্দুল খালেকের স্ত্রী জয়নব বেগমের কাছ থেকে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা নেন নজরুল। এ ছাড়া স্থানীয় অসহায় আরও সাত নারীর কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা করে আদায় করেন তিনি।ভুক্তভোগী সাত নারী হলেন—নাজিরপুর ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামের রেজাউল করিমের স্ত্রী আসমা বেগম, ছাইফুল হোসেনের স্ত্রী ইঞ্জিরা বেগম, মৃত হাসমত আলীর স্ত্রী রাবিয়া বেগম, মৃত আবেদ আলীর স্ত্রী রিজিয়া বেগম, মৃত তারা মিয়ার স্ত্রী হাবিয়া বেগম, আব্দুল হামিদের স্ত্রী সাহারা বানু ও ইয়াছিন আলীর মেয়ে বিউটি খাতুন। জয়নব বেগম গত বছর বাদী হয়ে নজরুলে বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করেন।এই মামলায় গত ২ এপ্রিল আদালতে জামিন চাইতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন নজরুল। এরপর দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। ১৬ দিন কারাভোগের পর গত ১৮ এপ্রিল জামিনে বেরিয়ে আসেন নজরুল ইসলাম। এরপরই ফেসবুক লাইভে এসে বলেন, ‘জেল থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আবেদন পাঠানোর পর গুরুদাসপুর থানার ওসির বদলি হয়ে গেছে।’ ভিডিওটি মুহূর্তেই সামাজিক গনমাধ্যমসহ বিভিন্ন প্রন্ট ও ইলেক্ট্রনিক  গনমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। এরপর নজরুলকে দলে আগের পদে বহাল করা হয়।গত ৪ মে গুরুদাসপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের পরিচিতি সভায় তাঁকে সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এমপি আব্দুল কুদ্দুস।এ দিকে টাকা না পেয়ে গত ৩মে বুধবার ভুক্তভোগী সাহারা বেগম ও মমতাজ বেগম গুরুদাসপুর আমলি আদালতে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আদায়ের অভিযোগ এনে নজরুলের বিরুদ্ধে মামলা  করেন।  ৪ মে বৃহস্পতিবার নাটোরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) নূর মোহাম্মদ ইউএনওর কার্যালয়ে অভিযোগকারীদের বক্তব্য শোনেন। তখন ইউএনও শ্রাবণী রায় ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) মেহেদী হাসান উপস্থিত ছিলেন।  ৫ মে শুক্রবার ওই সাতজনের মধ্যে পাঁচজনের টাকা ফেরত দেন ইউএনও শ্রাবণী রায়

দিনটিসাপ্তাহিকসরকারি ছুটির দিন ইউএনওর সরকারি বাসভবনে ভুক্তভোগী নারীদের ডেকে নিয়ে এসব টাকা ফেরত দেওয়া হয়। তবে সাহারা বেগম ও মমতাজ বেগমের টাকা দেওয়া হয়নি। টাকা ফেরত পেতে তাঁদের শর্ত দেওয়া হয়েছে—নজরুলের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।ইউএনও যখন তাঁর বাসভবনে ভুক্তভোগীদের ডেকে টাকা ফেরত দিচ্ছিলেন তখন স্থানীয় সাংবাদিকেরা তাঁর বাড়ির ফটকে উপস্থিত হন। সাংবাদিকদের উপস্থিতির খবরে ভুক্তভোগীদের ইউএনওর বাসভবনের প্রাচীর টপকে বের করে দেওয়া হয়। ঘুষের টাকা ফেরত নেওয়া নারীরা জানান, ইউএনওবৃহস্পতিবার রাতে তাঁদের ফোনকল করে টাকা নেওয়ার জন্য শুক্রবার সকালে তাঁর সরকারি বাসভবনে যেতে বলেন। শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আসমা বেগম, ইঞ্জিরা বেগম, রাবিয়া বেগম, রিজিয়া বেগম, হাবিয়া বেগম, সাহারা বেগম ও মমতাজ বেগম ইউএনওর বাসভবনে যান। সেখানে প্রায় ৩ ঘণ্টা ধরে অভিযোগকারীদের সঙ্গে বৈঠক করেন ইউএনও। বিষয়টি গোপন রাখার শর্তে অভিযোগকারী ৭ জনের মধ্যে ৪ জনকে ৫০ হাজার টাকা করে এবং একজনকে ৪০ হাজার টাকা ফেরত দেওয়া হয়।প্রাচীর টপকে পার হওয়া নারীদের মধ্যে আসমা বেগম সাংবাদিকদের বলেন, সাংবাদিকদের দৃষ্টি এড়াতে ইউএনওর পরামর্শে তাঁর গাড়িচালক জয়নাল হোসেনের সহায়তায় মই বেয়ে প্রাচীর টপকে বেরিয়ে যান তিনি

ভুক্তভোগী নারীরা আরও জানান, গত বৃহস্পতিবার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মাসুম আহমেদ অভিযোগের বিষয়ে শুনানির পর রাতে নজরুল ইসলাম তাঁদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে আসেন এবং ইউএনওর মাধ্যমে তাঁরা সবাই টাকা ফেরত পাবেন বলেও আশ্বাস দেন। ইউএনও শ্রাবণী রায় জানান, নজরুল ইসলামের কাছ থেকে আদায় করেই টাকাগুলো ভুক্তভোগীদের টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে। এখানে কোনো শর্ত দেওয়া হয়নি। টাকা ফেরত দিতে এত গোপনীয়তা কেন—তার কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি ইউএনও। তিনি বলেছেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমাকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে। আমি শুধু আমার সরকারি দায়িত্ব পালন করেছি। কোনো নেতার প্রতি দুর্বলতা থেকে আমি কিছু করিনি।’  টাকা ফেরত দেয়ার ঘটনা বিভিন্ন গনমাধ্যমে গুরুত্ব সহকারে ভাইরাল হলে দলের হাই কমান্ডের নির্দেশে গুরুদাসপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সকল পদ ও পদবি থেকে বহিস্কার করা হয়েছে। এলাকাবাসির ধারণা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবারও দলে ফিরিয়ে নেওয়া হবে।

অভিযুক্ত নজরুল বলেন  ‘আমি পুকুর খননে বাধা দেওয়ায় সাংবাদিক ও স্থানীয় প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের ষড়যন্ত্রের শিকার। আমার বিরুদ্ধে আমার প্রতিপক্ষ গৃহহীনদের দিয়ে মামলা করিয়ে আমাকে জেল খাটিয়েছে। জেলে যাওয়ার আগে আমি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে পুকুর খননের সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার ব্যাপারে চিঠি দিই। এই চিঠিতে গুরুদাসপুর থানার তৎকালীন ওসি আব্দুল মতিনের সংশ্লিষ্টতার কথা উল্লেখ ছিল। এরপর তিনি বদলি হয়েছেন। আমি জেল থেকে বের হয়ে লাইভে বলেছিলাম যে, আমি ওসিকে বদলি করিয়েছি। শুক্রবার ইউএনও আমার থেকে কোনো টাকা নিয়ে ভুক্তভোগী কাউকে দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। তবে ইউএনও অত্যন্ত ভালো মানুষ।’ তাহলে ইউএনও কার স্বার্থ রক্ষা করতে কার টাকা ভূক্তভোগীদের দিলেন? আবার কেনইবা মূল অভিযোগকারিদেরকে মামলা তুলে নেওয়ার শর্তের বেড়াজালে ফেলে তাদের টাকা ফেরত দিলেননা? তিনি কী নিজেকেও অভিযুক্ত করলেননা?

এলাকায় তাঁকে ‘মিনি এমপি’ ডাকা হয় কেন জানতে চাইলে নজরুল পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, ‘আমি মিনি এমপি হলে আমার বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করবে কী করে? আমি এমপি কুদ্দুসের রাজনীতি করি।’

নাজিরপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী বলেন, ‘নজরুল পেশায় একজন ফার্নিচার ব্যবসায়ী। কিন্তু এলাকায় প্রভাবশালী। প্রতারণা করে বিপুল অর্থের মালিক হয়েছেন। কেউ প্রতিবাদ করলে হয়রানি করেন। প্রশাসনও তাঁর কথায় চলে। এমপির ঘনিষ্ঠ এই নজরুলের বিরুদ্ধে এলাকার মানুষের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।’

গুরুদাসপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহনেওয়াজ আলী বলেন, ‘নজরুল সংসদ সদস্য আব্দুল কুদ্দুসের ডান হাত হিসেবে পরিচিত। তিনি প্রতারক হিসেবে নানা অপকর্মে জড়িত। আমাদের লজ্জা হয় প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের আশ্রয়ণ প্রকল্প বেচে যিনি গরিবদের থেকে টাকা আদায় করার পরও সাংসদের সঙ্গে থাকেন।’

এ ঘটনার পর থেকে ‘ মিনি এমপি’র কাহিনি টক অব দ্যা কান্ট্রি  ছড়িয়ে পড়েছে। তাই কথিত মিনি এমপি থেকে সব দলের নেতারা শাবধান! ###

#  আবুল কালাম আজাদ, গুরুদাসপুর, নাটোর, ০১৭২৪ ০৮৪৯৭৩# ১২/৫/২৩#



Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD