বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ শুকুর মাহমুদ
রাজনৈতিক দলের দূধর্ষ ক্যাডার, তৃণমূল থেকে শুরু করে একেবারে সেন্ট্রাল পর্যন্ত যার পরিচয়। স্থানীয় সাংসদ ওর কাঁধে ভর করে চলেন, প্রশাসন তাকে গুণে চলে, সে সূত্রে যখন যা খুশি তাই করে যাচ্ছে। বাধা দেয়ার কেউ নেই। যার বাম চোখের ইশারায় ভাংচুর হত্যা তান্ডব ঘটে, ডান চোখের ইশারায় অজেয়কে জয় করে। সে এলাকায় “বড় ভাই” নামে পরিচিত। বড় ভাই কারো উপর মাইন্ড করলে তার আর রক্ষা নেই। কিছুক্ষণ পূর্বেই একটি তান্ডব ঘটিয়ে ফিরছে, হঠাৎ পিছন দিক থেকে সামনে এসে দাঁড়ালেন এক বুযুর্গ ব্যক্তি। বড় ভাই তাকে পূর্বে কখনো দেখেছে বলে মনে হচ্ছে না।
আগন্তুক হাত বাড়িয়ে দিলেন যুবকের দিকে, ইতস্ততঃ ভরে যুবকও হাত এগিয়ে দিল আগন্তুকের দিকে। যুবকের হাতে হাত দিয়ে বললেন, ভাল আছো? উত্তর এলো ভালো, অনেক ভাল আছি। প্রবীন বুযর্গ বললেন ভুল বলেছো, আমি দেখছি তুমি মোটেই ভাল নেই। যুবক উত্তর দিল আপনি জানেন না, বর্তমানে আমার চেয়ে ভাল কেউই না। আমার মনে যখন যা চায় আমি তাই করতে পারি। রাজনৈতিক দলের তৃণমূল থেকে শুরু করে সেন্ট্রাল পর্যন্ত আমার পরিচয়। স্থানীয় সাংসদ আমার উপর নির্ভর করে চলেন, প্রশাসন আমার হাতের মুঠোয়। এলাকার সকলেই আমাকে বড় ভাই বলে সম্মান করে আবার ভয়ও করে। সব মিলে আমি ভালো আছি। আমার চেয়ে ভালো আর কে? আগন্তুক বললেন, এই ভালোর স্থায়িত্ব কতটুকু? তোমার জীবনের নিশ্চয়তা কি বলতে পারো? তুমি না হয় একটি এলাকায় গাদ্দারি করে বেড়াচ্ছ। সরকারের অধিনস্থ প্রশাসন সাময়িক সম্মান দেখাচ্ছে। সুযোগ পেলে ওরাই তোমাকে গ্রেফতার করবে! যে সাংসদ তোমার কাঁধে ভর করে চলে যে কোনো সময়ে তোমার লাশ তার কাঁধে উঠতে পারে, নয়তো বা তাঁর লাশই তোমার কাঁধে বহনের দায়িত্ব আসতে পারে। গাদ্দারির সীমাবদ্ধতা আছে, যে কোন মূহুর্তে তোমার গাদ্দারী শেষ হয়ে যাবে। নিশ্চয়ই শুনেছো! এই দুনিয়ায় যত বড় বড় গাদ্দার ছিল আজ আর তাদের কোন অস্থিত্বই নেই। জগতের এক অংশের রাজত্ব পেয়ে নিজেকে খোদা দাবি করেছিল ফেরাউন বাদশা, আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল নমরুদ বাদশা, সে যুগের শ্রেষ্ঠবীর ছিল হামান, ধনকুবের মহারাজা ছিল কারুন, আল্লাহর ঘর ধ্বংস করতে এসেছিল আবরাহা বাদশা। সমূলে বিনাশ হয়েছে তারা, তাদেরও কোন অস্তিত্ব নেই। তুমি নিজেই দেখেছো তোমার উত্থানের পূর্বে কত নেতা গড়ে উঠেছিল আবার তারা ধ্বংস হয়েছে। তোমার পূর্ববর্তী নেতা, যার ইশারায় চলন্ত গাড়ি থেমে যেত, অসাধ্যকে সাধ্যে পরিণত করেছে। প্রতিপক্ষও টিকে থাকতে পারেনি তার দাপটে, একক ক্ষমতা ধরে রাখত নিজের হাতে। তার মৃত্যুতে শোকাহত খচিত কালো কাপড়ে ছেয়ে গিয়েছিল পুরো শহর। মরদেহ সামনে রেখে রাজনৈতিক বক্তব্যের মঞ্চ গড়ে উঠেছিল, ফুলে ফুলে ভরে দেয়া হয়েছিল তার কফিন। অনুসারীদের শোকের মাতম দেখে মনে হচ্ছিল ওদের হাটু ফেঁটে কান্না বেরুচ্ছে। কিন্তু! পরলোকায়িত নেতার লাশ কবরে রেখে আসতে না আসতেই তার পরিত্যক্ত আসনের দখল নিতে নেতা-কর্মীরা আত্মকলহে জড়িয়ে পড়েছে।
ভুলেই গেছে তাঁর সকল স্মৃতি। নিশ্চয়ই জানো না কবরে গিয়ে সেই নেতা মেহমান আদরে আছে নাকি কবর আজাবে গ্রেফতার হয়ে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে জবাবদিহীতায় ব্যস্ত রয়েছে। এখন কেউ আর তার জন্য কাঁদে না, আল্লাহই ভাল জানেন তার শেষ পরিনতি কি হচ্ছে। নিজের চোখ দু’টি বন্ধ করে একটু পিছনে ফিরে তাকাও আর ভাব, তুমি কে এবং কি তোমার পরিচয়? কোথায় ছিলে তুমি, কোথায় রয়েছো এবং কোথায় যাচ্ছ? প্রবীনের কথা শুনে যুবক থেমে গেল। বিনয়ের সাথে বলল, বলুনতো আমি কে এবং কি আমার পরিচয়? বুযর্গ বললেন জানি পরিচয়ে তুমি মানব সন্তান একজন মানুষ তোমার পরিচয় তুমিও একজন কবরের যাত্রী, যখন তোমার কোন অস্তিত্ব ছিল না তখন তোমার বাবা মায়ের মিলনের নির্যাস এক বিন্দু পানি থেকে তোমার অস্তিত্ব গড়ে উঠেছে। প্রথমে ঐ পানিকে রক্তপিন্ডে পরিণত করা হয়েছে, রক্ত থেকে মাংস, তারপর মানব আকৃতির দেহ, এটাই তোমার পরিচয়। যখন এলে নবজাতক হয়ে এ ধরায় তখন ছিলে দারুণ অসহায়। সেই অসহায়কে সহায়তা দিতে কে দিয়েছে তোমার মায়ের হৃদয়ে মায়া। ভালবাসা নিয়ে এলো স্বজনেরা। অনুকূল পরিবেশ আর সুষম খাবার দেয়া হলো তোমাকে বেড়ে উঠতে। এখন বড় হয়ে ভুলে গেছো অতিতে পাওয়া সহায়তার কথা। তাই জগতের ঐ সকল কোন পরিচয়ই তোমার আসল পরিচয় নয়। কেননা দুনিয়ার বাহাদুরি ক্ষণিকের, কচুর পাতার পানি।
প্রতিটি জীব আগমনের পর থেকেই তার পরিসমাপ্তির হিসেব কষতে থাকে জীবের মালিক। হয়তো বা তোমারও হায়াতের পুঁজি শেষ হয়ে আসছে। মৃত্যু ঘোষণা হলেই শেষ হয়ে যাবে তোমার সকল দাপট তোমার ইশারায় আর কোন কিছুই হবে না। অস্তিত্ব বিলীন হবে, তোমার সংগ্রামী সাথীরা আর বড় ভাই বলে সম্মান করবে না। তোমার লাশ সামনে রেখেই বলবে বড় ভাই আর নেই, তখন সে বড় ভাই কোথায় থাকবে, তোমার লাশ রেখে আসা হবে কবরে। তোমার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে যখন কোন কিছুই আর থাকবে না। তখনও থাকবে তোমার নাম আর জীবনের ভাল-মন্দ কাম। সমগ্র জগৎ শেষ হয়ে গেলেও এ দু’টি জিনিস শেষ হবে না। শেষ বিচারের দিনেও তোমার নাম ধরে ডাকা হবে জিবনের ভাল-মন্দের বিচার করা হবে হিসেব ধরে ধরে। তোমাকে কবরে রেখে আসার পর তোমার দেহ ফুলে ফেঁপে কবর ভরে যাবে। একসময় দেহ ফেটে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। পোকা মাকড়ের খাদ্য হবে তোমার প্রতিটি অঙ্গ। তারপর আর কি হবে তা জানেন সেই মালিক যিনি পাঠিয়েছিলেন তোমাকে এ ধরায়। পুনরায় ফেরৎ নিবেন তার কাছে। তখন আর তোমার গুণগ্রাহী কেউ আসবে না সহায়তা দিতে। তাই সময় থাকতে ফিরে এসো জগতের এ পরিচয় থেকে। আসল পরিচয় নিয়ে একবার ভাব কে তুমি এবং কি তোমার পরিচয়। মনে রেখো জগতের শেষ মানুষটি যে দিন মৃত্যু হবে তারও ৪০ হাজার বছর পর পুনরুথান করা হবে বিচারের জন্য, তাই আখেরাতের জগতের কাছে দুনিয়ার এই সময় টুকু এক মুহুর্ত মাত্র।
কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট,শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ। আলাপচারিতা: ০১৭৮২-৪৫৭৭৮৩