চলনবিলের নানা সমস্যা

Spread the love

শহিদুল ইসলাম সুইট
এক সময়ে চলনবিলের কই মাছ, বাচা মাছ, ধোদা মাছ, বড় বড় বোয়াল, শিং, টেংরা পাতাশি মাছ যারা জীবনে একবার খেয়েছে তারা কখনও ভূলতে পারবে না। চলনবিলের গ্রামের দাদা-নানাদের কাছে এসব গল্প শোনা যায়। সেসময় সৌঁতিজাল, খোরাজাল, বয়াজাল দিয়ে এসব মাছ ধরে পরিবার-পরিজন নিয়ে আনন্দের সাথে খেত সবাই। কোথায় গেল সেইদিন আক্ষেপ করে বলেন বয়োবৃদ্ধ দাদা-নানারা।
বর্ষা মৌসুমে দেশের বৃহত্তম বিল চলনবিলসহ নিচু অঞ্চল তলিয়ে যায়। নদী-নালা, খাল-বিল থৈ থৈ করে পানিতে। তবে এবার চলনবিলে ভরা বর্ষাতেও পানি নেই। এর প্রভাব পড়েছে তিন জেলার ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া এই বিলের ওপর নির্ভরশীল মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই-তিন দশক আগেও আষাঢ় মাসে চলনবিল থাকত পানিতে টইটম্বুর। এখন গোটা বিল পানিশূন্য থাকে বছরের বেশী সময়। জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মম উদাহরণ হতে চলেছে এই চলনবিল। এক সময় ধান ও মাছের প্রাচুর্য ছিল চলনবিলে। বিল ঘেঁষে থাকা শত শত দ্বীপসদৃশ গ্রাম অনেক পর্যটককে আকর্ষণ করত। বর্ষাকালে দূর-দূরান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ তাই চলনবিলে বেড়াতে আসতেন। নৌভ্রমণের মাধ্যমে চলনবিলের নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতেন তারা। সে সময় নির্মল আবহাওয়ায় স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতেন চলনবিল পাড়ের মানুষ। অথচ বর্তমানে চলনবিলে দিন দিন তাপমাত্রা বাড়ছে। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত ‘চলনবিলের ইতিকথা’ বইয়ে লেখক এম এ হামিদের বর্ণনা ধরে এখন চলনবিলে গেলে হতাশই হতে হয়। দখল-দূষণে মরা খালে পরিণত হয়েছে দেশের বৃহত্তম চলনবিলের নদ-নদী। পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে বিলের বিভিন্ন খাল। ভূ-উপরিস্থ পানি না থাকায় নেমে গেছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। ফলে বিলুপ্ত হতে বসেছে বিলের জীববৈচিত্র্য ও মৎস্য সম্পদ। ব্যাহত হচ্ছে কৃষি আবাদ।ইতিহাস থেকে জানা যায়, রাজশাহী বিভাগের ৬ জেলার ১ হাজার ৮৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে ছিল চলনবিল। বর্তমানে পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ এই তিন জেলার ১০টি উপজেলার, ৬২টি ইউনিয়নের ১ হাজার ৬০০ গ্রাম নিয়ে বৃহত্তর চলনবিল। বিলে রয়েছে ২১টি নদ-নদী, ৭১টি নালা-খাল ও ৯৩টি ছোট বিল।
পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ জেলা মৎস্য অফিসের তথ্যমতে, চলনবিলে ১৯৮২ সালে মাছের উৎপাদন ছিল ২৬ হাজার ৯৯০ মেট্রিক টন। এরপর ১৯৮৭ সালে ২৪ হাজার ৩৩৬ মেট্রিক টন, ১৯৯২ সালে ১৮ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন, ১৯৯৭ সালে ১৫ হাজার ৪২১ মেট্রিক টন, ২০০২ সালে ১২ হাজার ৪৬০ মেট্রিক টন এবং ২০০৬ সালে উৎপাদন হয়েছে ১২ হাজার ১১৭ মেট্রিক টন। এই হিসাবে ২৫ বছরে চলনবিলে মাছের উৎপাদন কমেছে ৭২ দশমিক ৫ শতাংশ। গড় উৎপাদন কমেছে ১২ দশমিক ১ শতাংশ। প্রতিবছর উৎপাদন কমেছে ৩ শতাংশ।
চলনবিলের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, আঁকাবাঁকা রাস্তায় ছেয়ে আছে পুরো বিল। মাঝে মধ্যেই ছোট-বড় ব্রিজ-কালভার্ট সহ নানা স্থাপনা। বর্ষা মৌসুমে চলনবিলে যে পরিমাণ পানি থাকার কথা, বর্তমানে তা নেই।বিল এলাকার বাসিন্দারা বলেন, চলনবিলে একসময় সারা বছর পানি থাকত। উঁচু জমিতে ফসল আবাদ, নদী-খালে মাছ শিকার চলত। অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণেই বৃহৎ এই বিল এখন পানিশূন্য। এতে একদিকে মৎস্য সম্পদ নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে কৃষি আবাদ। চলনবিল থেকে ধরা ছোট মাছ থেকে তৈরি করা হয় শুঁটকি। তবে দিন দিন মাছ কমে যাওয়ায় আগের মত আর বসে না শুঁটকির চাতাল। চলনবিল, চাটমোহর, পাবনা চলনবিল থেকে ধরা ছোট মাছ থেকে তৈরি করা হয় শুঁটকি। চলনবিলের মাছের কথা মনে হলে কিংবা কারো কাছে চলনবিলের মাছের কথা শুনলেই মুখে রস না এসে পারে না। চলনবিলের মানুষ যদি রাজধানী বা কোন এলাকায় চলনবিলের মাছ উপঢৌকন হিসেবে নিয়ে গেলে তার আদর আপ্যায়নই হয় অন্য রকম। সেই চলনবিলের মিঠা পানির শুটকি মাছের চাহিদা দিন দিন বা ছেই । দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশের প্রায় ১২ টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে এ শুটকি মাছ । ক্রমবর্ধমান এ চাহিদাকে সামনে রেখে অনেক ব্যবসায়ীরা আকৃষ্ট হচ্ছেন। দাম চড়া হলেও বাড়ছে চাহিদা।বিলের পানি দীর্ঘায়িত হওয়ায় এবং অবৈধ জাল দিয়ে বিলে ও নদীতে মাছ ধরা বন্ধে প্রসাসনের কঠোর পদক্ষেপে পোনা মাছ ধরা বন্ধ হওয়ায় মাছের উতপাদন বাড়বে। যার প্রেক্ষিতে মৌসুমের এক মাস বাকি থাকতেই বিগত বছরের তুলনায় এ বছর শুটকি মাছের উৎপাদন প্রায় ১০০ মেট্রিক টন বাড়বে বলে শুটকি উতপাদনকারিরা আশা করছেন । মাছ সংরক্ষণাগার থাকলে শুটকির উৎপাদন আরও বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করছেন শুটকি উতপাদনে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
নাটোর – হাটিকুমরুল মহাসড়কের মান্নান নগর, মহিষলুটি, চলনবিন, হান্ডিয়াল, চাটমোহরের খলিসাগারি, নিমাইচড়া এবং নাটোর- বগুড়া মহাসড়কে নিংগইন , ডাহিয়া বাঁশের ছাউনিতে বসানো হয়েছে শুঁটকির অস্থায়ী চাতাল। সেখানে মিঠা পানির বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু বিভিন্ন প্রজাতের মাছের শুঁটকি উৎপাদন করতে দেখা যায়।
নাটোর জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সিংড়ায় ৪/৫ টি চাতাল ও ৩০টি এলাকায় বিলের মাছ সংগ্রহ করে শুটকি তৈরির কাজ করছেন প্রায় ৪ শতাধিক নারী-পুরুষ। ২০২০ সালে সিংড়ায় ৩১৯ মেট্রিক টন শুটকি উৎপাদিত হয়। চলতি বছর বন্যা দির্ঘস্থায়ী হওয়ায় জানুয়ারি পর্যন্ত মিঠা পানির মাছের উৎপাদন বেড়ে ৫শত মেট্রিক টন হওয়ার আশাবাদী । নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের ধারে নিংগইন ও তাড়াশের মহিশলুটি এলাকায় গড়ে উঠেছে চলনবিলের সর্বববৃহৎ শুটকি মাছের চাতাল। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাছ কাটা, বাছাই, ধোয়া, রোদে শুকানো, তোলার কাজে শ্রমিকরা ব্যস্ত সময় পার করেন।
নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার ব্যবসায়ী নান্নু মিয়া বলেন, চলনবিলের শুঁটকি আমেরিকা, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার, বাহরাইন, দুবাইসহ ১০-১২টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। চলতি মৌসুমে এখানে ১৫০-২০০ মেট্রিক টন শুঁটকি বিদেশে রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে। যার আর্থিক মূল্য হবে প্রায় ৫০ কোটি টাকা। শুঁটকি ব্যবসায়ীরা জানান, চলতি বছর চলনবিলের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ২৫০টি অস্থায়ী চাতাল বসেছে। এসব চাতালে শোল, বোয়াল, পুঁটি, খলশে, চেলা, টেংরা, বাতাসি, চিংড়ি, নলা, টাকি, বাইমসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করা হচ্ছে।
মানভেদে এই শুঁটকি মাছকে ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ গ্রেডে বাছাই করা হয়। এর মধ্যে ‘এ’ গ্রেডের বা ভালো মানের শুঁটকি মাছ রপ্তানি হয় আমেরিকা, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার, বাহরাইন, দুবাইসহ ১০-১২টি দেশে। মূলত ঢাকার ব্যবসায়ীদের হাত ঘুরেই এখানকার শুঁটকি বিদেশে যায়। আর ‘বি’ ও ‘সি’ গ্রেডের শুঁটকি মাছ বিক্রি হচ্ছে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, সৈয়দপুর, নীলফামারী, রংপুর, রাজশাহী, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। শুঁটকির আকারভেদে দাম হয় ভিন্ন ভিন্ন। ছোট আকারের মাছের শুঁটকি প্রতিমণ ১৬ থেকে ২৪ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। বড় আকৃতির মাছের শুঁটকি ৩০ থেকে ৭০ হাজার টাকা মণ।
চলতি বর্ষা মৌসুমের শুরুতে প্রথমে পানিশূন্যতায় ধুঁকেছে দেশের বৃহত্তম বিলখ্যাত চলনবিলের জলাশয়গুলো। ছিল না তেমন বৃষ্টি। বিলে নেই মাছ। তাই অলস সময় পার করছেন এ অঞ্চলের জেলেরা। অনাহারে অর্ধাহারে কাটছে তাদের জীবন।শুকনো মৌসুমে অন্যের জমিতে কাজ করে সংসার চলে জেলেদের। আর বর্ষায় শুরু হয় তাদের মাছ ধরার কাজ। কিন্তু এবার বর্ষায় বিলে পানি না আসায় তারা হতাশ। কারণ মাছ বিক্রি করেই ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়াসহ সংসারের যাবতীয় খরচ যোগাতে হয় তাদের।এক সময় বর্ষা এলেই চলনবিলের জেলেরা বিভিন্ন সরঞ্জাম দিয়ে মাছ ধরায় মেতে থাকতেন। মিলতো নানা জাতের ছোটবড় মাছ। সেই মাছ স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে দেশ-বিদেশে রপ্তানি হতো। জেলেদের পরিবার-পরিজন নিয়ে স্বচ্ছলভাবে দিন কাটতো। কিন্তু এবারের বর্ষা যেন বৈরী। ফলে তাদের মুখে নেই হাসি। মহাসংকটে চলছে তাদের সংসার। নেই কোনো সরকারি-বেসরকারি অনুদানও। পরে কোনরকম বন্যা হলেও বেশী পানি হয়নি এবং সে পানি ও মাছ তেমনটি থাকেনি অনেকদিন।
সিংড়ার চকসিংড়া, শোলাকুড়া গ্রামের মৎস্যজীবি আব্দুল¬াহ, শাহাদত হোসেন, করিম মৃধা বলেন, মাছ ধরেই চলে আমাদের জীবন জীবিকা। তাই বর্ষা শুরুর আগেই মাছ ধরার জন্য খেয়া জাল, জাকই জাল, ধুন্দি, চাঁই, দোয়ার, পলোসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম তৈরি করে রেখেছি। অথচ বর্ষা মৌসুমেও বিলে পানি আসেনি।শালমারা গ্রামের মৎস্যজীবি মাহাবুর শেখ বলেন, ভরা বর্ষায় মাছ বাজারে মাছ না থাকায় আমাদের উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। পরিবেশ ও প্রকৃতি আন্দোলনের সভাপতি মো. এমরান আলী রানা বলেন, দাদা-দাদীসহ গ্রামের বয়োবৃদ্ধদের কাছে চলনবিলের অনেক গল্প শুনেছি। এগুলো এখন শুধু ইতিহাস। অপরিকল্পিত উন্নয়ন, অবৈধ দখল ও দূষণে চলনবিল এখন বর্ষা মৌসুমেও পানিশূন্য হয়ে পড়ে প্রায় বছরই। ফলে গোটা চলনবিলের প্রকৃতি ও পরিবেশ ক্রমশ বদলে যাচ্ছে আশংকাজনকভাবে।

লেখক: সিংড়া প্রতিনিধি, সাপ্তাহিক চলনবিল বার্তা।

 

 

 

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD