বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ শুকুর মাহমুদ
আমি কে, কি আমার পরিচয়, আমি কোথায় ছিলাম, এখানে কেন এসেছি, এখানে আমার কাজ কী? প্রথম যেখানে ছিলাম আল্লাহ পাক রুহ সৃষ্টি করে রুহানী জগতে রেখে দিয়েছেন সেখান হতে পর্যায়ক্রমে পাঠাচ্ছেন। ঐ জগতে হয়তো বা আমার কোন আত্মীয় স্বজন, পরিবার পরিজন অথবা বন্ধু বান্ধব ছিল না অথবা ছিলই। সে জগতে অর্থ সম্পদ, বাড়ি-গাড়ি প্রয়োজন হয়নি। তাই সেখানে কোন শত্রুও ছিল না। এজন্য সে জগতের কোন হিসাব নিবেন না। সেখানে থেকে নিশ্চয়ই আমার ইচ্ছায় এখানে আসা হয়নি, কোন প্রেরক আমাকে পাঠিয়েছেন। ইচ্ছে করলে আমার এখানেও থাকা হবে না। ঐ প্রেরকের ইচ্ছাতেই চলে যেতে হবে অন্যস্থানে। সেখানে কোন সঙ্গী সাথি, অর্থ সম্পদ সাথে থাকবে না। একাকি সে জগতে অবস্থান করতে হবে। কত সময় কত দিন থাকতে হবে তাও জানা নেই। নিশ্চিত করে বলা হয়েছে সেটাও চিরস্থায়ী ঠিকানা নয়। সেখান থেকে আসল ঠিকানায় যেতে আরও একটি মুঞ্জিল হাশর ময়দান। সেই মুঞ্জিলে অপেক্ষা করতে হবে, সেখানে বিচার হবে। কিসের বিচার? কে বিচারক? বিচারে সাজা না জাজা হবে তা সেই বিচারকই জানেন। কিসের বিচার! তার জন্য জানতে হবে আত্ম তথ্য।
প্রেরক আমাকে দুনিয়ার জগতে পাঠিয়েছেন সরাসরি নয়। আসার পথে ছিল দু’টি ‘বাহন’। পিতা নামক ব্যক্তি মগজে বহন করেছেন অনেক দিন। সেখান থেকে বাহন বদলায়ে আরোহন করেছিলাম মাতৃ জঠরে কিছুদিন। তারপর অবতরণ করলাম সেই প্রেরকের পরীক্ষাগারে। দুনিয়ার জগতে অবতরণের সাথে সাথেই দায়িত্ব দেয়া হয়নি নবাগতকে। আগন্তুককে বুঝতে দেয়া হয়েছে, পরিচয় করানো হয়েছে। ধীরে ধীরে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে পরিক্ষার বিষয়বস্তু। প্রেরক কত বড় দয়ালু। শেষ বিচারের দিনে যে বিষয়ের উপর বিচার হবে তার প্রশ্নগুলো নিজেই ফাঁস করে দিয়েছেন সঠিক উত্তর দিতে। প্রতি বিষয়ের নাম্বারও ঘোষণা করে দিয়েছেন। সঠিক পথে জীবন পরিচালনার সুবিধার্থে মানব সৃষ্টির বহু পূর্বেই রচনা করেছেন তাঁর সংবিধান যা গাইড লাইন হিসেবে অবরতণ করানো হয়েছে মানবের মাঝে এবং তা বুঝা ও জানার জন্য পাঠিয়েছেন দক্ষ প্রকৌশলীও। পৃথিবীতে কোন বিজ্ঞানী বা কোম্পানী যে কোন যন্ত্র আবিস্কার করলে তার গাইড লাইন বা পরিচালনা পদ্ধতি সাথে দিয়ে থাকেন। একই সাথে সেটি বুঝানোর জন্য যে দেশে যন্ত্রটি প্রথমে বাজারজাত করা হয় সেখানে ঐ যন্ত্রের উপযোগী প্রকৌশলীও নিয়োজিত করেন। এ লক্ষ্যে মানবের জীবন বিধান/গাইড লাইন হিসেবে প্রেরক মানবের মাঝে দিয়েছেন ধর্মগ্রন্থ পবিত্র কোরআন মাজিদ এবং তা বুঝানোর জন্য দক্ষ প্রকৌশলী হিসেবে প্রেরণ করেছেন নবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (স.) কে। মহান আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় মাখলুক মানবের জন্য সৃষ্টি করে রেখেছেন অনন্তকালের সুখ শান্তিপূর্ণ জান্নাত। তিনি কখনই চান না একটি বান্দাও জাহান্নামে যাক। এতে যদি কেউ ঐ গাইড লাইনের বাইরে বা প্রকৌশলীর নির্দেশনা বাদ দিয়ে ভিন্ন পথে জীবন চালায় তাতে ঐ ব্যক্তির পরিণতি অনন্তকালের শাস্তিপূর্ণ জাহান্নাম।
তথ্য অনুসন্ধান করে দেখা যায় প্রেরক কাউকে নিঃসঙ্গ করে পাঠাননি। শক্তি সাহস দিতে, সহযোগিতা দিতে পিতা-মাতা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন পরিচয়ের অনেককেই নিয়োজিত করেছেন। আসলে তারা কিন্তু কেউই আপন নয়। তাঁর পরিক্ষার হলে সহযোগিতা করতে স্বজনদের সাথে সম্পর্ক গড়ে দিয়েছেন সৃষ্টিকর্তা আমার আল্লাহ। প্রশ্ন উঠতে পারে যিনি প্রেরক, সৃষ্টিকর্তা, যিনি আমাকে মায়া করে এতগুলো সঙ্গীসাথী দিলেন আমার সহযোগিতা করতে তবে তাঁর আদালতেই কিসের বিচার? বিচার আমার নিজের বিবেকের কাছেই। যিনি আমাকে এত ভালবাসেন আমি তাকে কতটুকু ভালবাসি (স্মরণ করি) তারই পরীক্ষা নিতেই এই বিচারিক ব্যবস্থা। তাঁর প্রতি আনুগত্যের পরীক্ষা নিতে পিছু লাগিয়ে দেয়া হয়েছে দুই শ্রেণির শত্রু। এক, বিতাড়িত ইবলিশ শয়তান যার কাজ পরীক্ষাগারে ভুল করাতে। দুই,নিজের ভিতরের শত্রু নফসে আম্মারা যার কাজ হচ্ছে তার বহনকারী মানুষকে বিপথগামী করা, পরিক্ষার খাতায় অসত্য বা ভুল লেখাতে। পক্ষান্তরে প্রেরক মাওলার পক্ষ থেকে দুইজন সহযোগী নিয়োজিত করা হয়েছে যারা অতন্দ্র প্রহরীর মত সার্বক্ষণিক ব্যক্তির জীবনের প্রতিটি কাজ খাতায় লিখছেন। তারা এমন একটি কিতাব (আমলনামা) রচনা করছেন যাতে ব্যক্তির জীবনের একটি চিন্তা-ভাবনাও বাদ না পরে। এমনকি দৃষ্টির একটি পলকও যেন লেখার বাইরে না থাকে। বিচারের কাঠগড়ায় সারা জীবনের কৃতকর্মের কিতাব (আমলনামা) নিজেই পাঠ করে বিচারককে শুনাতে হবে অথবা সবার সন্মুখে পড়ে শোনানো হবে। দেখা যাবে এতে জীবনের একটি অক্ষর তথা একটি ফোটাও বাদ পরেনি।
সেদিন বিচারিক আদালতে প্রেরক নিজেই বিচারকের আসনে আসীন। প্রথম বাসস্থান (রূহানী জগত)-এ অবস্থানের কোন হিসেব দরকার হবে না, বাহন দু’টিতে থাকাকালীন সময়েরও কোনো হিসেব নেয়া হবে না, আগন্তুক দায়িত্ব প্রাপ্ত হওয়ার পূর্বমুহূর্ত সময়েরও কোন হিসেব আমলনামায় লেখা হবে না। শুধু! প্রাপ্ত বয়সের পর হতে মৃত্যুর পূর্ব সময়কার হিসাব লেখা হবে এবং তার উপরই বিচার করা হবে। সেই বিচারেই সাজা/জাজা নির্ধারিত হবে।
আল্লাহ পাক তাঁর কালামুল্লাহ শরীফ পবিত্র কোরআন মাজিদে বলেছেনÑ আমি যা সৃষ্টি করার ইচ্ছে করি তখন শুধু বলি ‘কুন’ তখনই তা হয়ে যায়। আবার যা ধ্বংস করতে চাই তখন শুধু বলি “ফা-ইয়াকুন” তখন তা ধ্বংস হয়ে যায়। অথচ বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করতে ছয়দিন সময় লাগিয়েছেন। এখানে রয়েছে তাঁর সৃষ্টি রহস্য। একইভাবে মানুষ সৃষ্টিও তাঁর কোন সময়ের ব্যাপার ছিল না। তবুও তিনি ফেরেশতাদের মাধ্যমে মাটি সংগ্রহ করালেন, পানি সংগ্রহ করালেন, অতঃপর সেই মাটি খামির করে মানব দেহ তৈরি করালেন। কেন? এখানেও রয়েছে তাঁর কুদরতি সৃষ্টি রহস্য। যে কারিগর মানবের দেহ গড়ালো তার উপর এত সুন্দর চেহারা দিলেন কে? ভিতরে বিভিন্ন মেশিন বসালেন কে? বিভিন্ন অঙ্গে স্প্রিং লাগালো কে? এসবই তাঁরই কুদরত। তিনি মানব থেকে মানবের বংশবৃদ্ধি করবেন। ইচ্ছে করলে তিনি আদমের বিভিন্ন অঙ্গে ফলের মত সন্তান ঝুলিয়ে দিতে পারতেন। তা না করে মানব সৃষ্টির কৌশল সৃষ্টি করলেন। রূহ্ তো দিবেন তিনি। অথচ এমন একটি রং এর খেলা জুড়ে দিলেন মানব-মানবির মাঝে। নর ও নারীর আনন্দ-বিনোদনের ফসল এক ফোটা নির্যাস তরল পদার্থ তার মধ্যে জীবাণু শুক্রকীট। সেই শুক্রকীট থেকে মানুষ সৃষ্টি করছেন। এ কেমন তাঁর সৃষ্টি রহস্য? হে মানুষ ভুলে যেও না প্রেরকের ভালবাসার কথা। পিতার মগজ নামক বাহন বদলায়ে যখন মাতৃ জঠরে আশ্রয় পেলে, দিনে দিনে মানব আকৃতিতে প্রবর্তন হতে শুরু করলে, যখন তোমার আহার ও পানীয় প্রয়োজন হলো তখন তোমার মুখের পবিত্রতা ঠিক রাখতে মায়ের নাড়ীর সাথে তোমার নাভিমূলের সংযোগ দিয়ে খাইয়েছেন। জগতে আসার পর তুমি কী খাবে তা তোমার জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন মায়ের স্তনে। না গরম না ঠান্ডা, করা মিষ্টিও নয় মিষ্টি ছাড়াও নয়। তোমার সহনীয় ক্ষমতা বুঝে কে এই খাবার প্রস্তুত করলেন? তারপর ক্রমাগতভাবে বড় হতে লাগলে তোমার একই খাদ্য ভান্ডারে পরিবর্তন করতে লাগল কে? আজ তুমি বড় হয়ে ভুলে যাচ্ছো সেই মাওলার দয়ার কথা। তোমার যে মুখ দিয়ে নাপাকি প্রবেশ করতে দেননি, সেই পবিত্র মুখ দিয়ে আজ খাওয়া হচ্ছে মাদকের মত নিষিদ্ধ খাবার, খাওয়া হচ্ছে হারাম খাবার। একবার মিলিয়ে নাও তোমার আত্ম তথ্য।
আল্লাহুপাক দয়া করে মায়া করে সৃষ্টি করেছেন দিবা রাত্র, দিন দিয়েছেন মানুষের আয় রোজগার-জীবিকা নির্বাহের জন্য রাত দিয়েছেন শান্তি আরাম ও নিদ্রার জন্য। কমল ও নরম দেহের অধিকারী নারী দিয়েছেন সেবা,দেহ মনের শান্তি ও জৈবিক চাহিদা মেটাতে এগুলো সবই তার নেয়ামত। পবিত্র কালামুল্লাহ শরিফে সূরা আর রহমানে বার বার উল্লেখ করেছেন “ফাবি আইয়ে আলাইয়ে রব্বিকুমাতুকাযিবান” অর্থ হচ্ছে তোমার রবের কোন কোন নেয়ামত অস্বীস্কার করবে ভেবে দেখো । যার হাতে তোমার জান জীবন ও মরন তার কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো তার কাছে শির নত করে সিজদায় লুটিয়ে পরো। তার কুদরতী পায়ে গাদ্দারী করো না, তার কাছে আত্মসমর্পণ করো। এ যুগের গাদ্দার হল বুশ ব্লেয়ার তারাও মৃত্যুর পর ঐ মালিকের হাতে ধরা পরতেই হবে। বাদশা সাদ্দাদ নিজে জান্নাত বানিয়ে সেখানেই থাকতে চেয়েছিলো ধরা দিবে না ঐ সত্তার কাছে সেও চলে গেছে। ফেরাউন বাদশা নিজেই খোদা দাবী করেছিলো তারও মরণ হয়েছে। গাদ্দার ছিলো কারুন, হামান, বাদশা নমরুদ কেউ টিকে থাকতে পারেনি। খুব শিগ্রই তোমারও গাদ্দারি থাকবে না সময় থাকতে আত্মসর্ম্পন করো তার কাছে, যিনি সকল ক্ষমতার মালিক। আত্ম তথ্য অনুসন্ধান করো তার সৃষ্টি রহস্য অনুসন্ধান করাই মানবের দায়িত্ব। তার জন্য আগে নিজেকে জানা (আত্ম তথ্য অনুসন্ধান করা)। আর আত্ম তথ্য জানলেই সৃষ্টির রহস্য জানা সম্ভব। তা করতে পারলেই সে আত্মা-পরমাত্মায় পরিণত হওয়া সম্ভব। সেই আত্মার লয় নেই, ক্ষয় নেই। অনন্তকালের সুখ-শান্তি অর্জন করতে পারলেই মানব জন্ম সার্থক হবে। তাঁর জাত নামের পরিচয়: বিশ্ব প্রতিপালক সমগ্র সৃষ্টি জগতের ¯্রষ্টা, তাঁকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, তাঁর জাতি নাম ‘আল্লাহ’। ইসলামী বিভিন্ন কিতাবে আল্লাহ’র নিরানব্বই’টি নামের উল্লেখ রয়েছে। আসলে তাঁর জাতি নাম একটাই ‘আল্লাহ’। অন্যান্য সকল নাম তাঁর গুণাবলির পরিচয়। এর বাইরেও কিছু নামে কেউ কেউ তাঁর পরিচয় দিয়ে থাকে অথবা তাঁর নামকরণ করে যেমন- ইংরেজ’রা বলে গড, ফারসি ভাষায় খোদা, খ্রিষ্টীয় সূত্রে ধরে ঈশ্বর ইত্যাদি। এগুলোর কোনটাই ঠিক না। সর্ব ভাষায় সকল মতবাদের উর্দ্ধে তাঁর নাম আল্লাহ। অতএব কোন মুসলমানের পক্ষে আল্লাহ নামের পরিবর্তে গড, খোদা বা ঈশ্বর বলা সমীচিন হবে না। যে নিজেকে চিনতে পেরেছে, সে আল্লাহ’কে চিনতে পেরেছে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, শাহজাদপুর,সিরাজগঞ্জ। মোবাইল নং- ০১৭৮২-৪৫৭৭৮৩