এক কেজিতে নয়শ গ্রাম কি বলে ইসলাম
লেখক তরুণ আলোচক ও গবেষক
মুফতি খোন্দকার আমিনুল ইসলাম আবদুল্লাহ ।
ওজনে ও পরিমাণে কম দেওয়া বড় গুনাহ
লেনদেন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ওজন ও পরিমাণে কমবেশি করা জঘন্যতম গুনাহ। কাউকে ঠকানোর মাধ্যমে উপার্জন করা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও অপরাধ।
সীমাহীন লোভ ও দুষ্ট অভ্যাসের কারণেই অবৈধ পন্থায় উপার্জনের পেছনে ছোটে মানুষ। এতে বরকত নেই, বরং বিভিন্ন রকমের ক্ষতি রয়েছে।
পবিত্র কোরআন ও হাদিসে এ ধরনের কাজকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যারা এমন করে তাদের নিন্দা করা হয়েছে।এ কাজ তাদের পরকালীন দুর্ভোগের কারণ হবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। সম্প্রতিক পত্রিকায় প্রকাশিত কিছু বাস্তব ঘটনার পর আসছি মুল কথায়।
কয়েক বছর আগের ঘটনা। একটি রেস্টুরেন্টে বসে চা পান করছি, গল্প করছি। হঠাৎ মিরু কসাই কোত্থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে পায়ের উপর পড়লো।
: ভাই আমারে বাঁচান, আমারে মাইরা ফালাইছে। এই দেখেন মাইরা আমার কী অবস্থা করছে। বলেই গায়ের জামা খুলে দেখালো। দেখলাম, সত্যিই লোকটি মার খেয়েছে। শরীরে মারের চিহ্ন দেখলাম।
বগুড়া জেলার সান্তাহার পৌর এলাকার পরিচিত হার্ভে স্কুল মোড়ে প্রতি শুক্রবার গরু জবাই করে মাংস বিক্রি করে নুরু ও মিরু (ছদ্মনাম) নামের দুই কসাই। বলে রাখি, এ ব্যাপারে আমিই তাদেরকে মাংস বিক্রির অনুমতি দিয়েছিলাম।
রহিমা বেগমের মেয়ে জামাইয়ের বাড়ি থেকে আত্মীয় স্বজন এসেছে, গরুর মাংস না হলে কী আতিথেয়তা চলে! মেহমান বিদায় করতে হলে অন্তত ৪ কেজি মাংস লাগবে। রহিমা বেগমের বাজেট হাজার দেড়েক টাকা। সে হার্ভে স্কুল মোড়ে নুরুমিরুর দোকানে গিয়ে শুনলো প্রতি কেজি মাংসের দাম ৫’শ টাকা। বাজেট ফেল করার কারণে শেষ পর্যন্ত দেড় হাজার টাকা দিয়ে ৩ কেজি মাংস কিনে বাসায় ফিরছে। পথে এক মুদি দোকানি জানতে চাইলো, মাংস কত করে নিলেন আপা? রহিমা উত্তর দিলো। ভাই, কেজি ৫’শ টাকা। বাজেট ফেল করায় রহিমা বেগমের মধ্যে একটা আক্ষেপ ছিলো। দোকানদারকে বললো, ভাই মাংসটা মাপেন তো। দোকানদার ওজন করে দেখলো মোট ২ কেজি ৭০০ গ্রাম। অর্থাৎ ৩০০ গ্রাম মাংস কম।
ঘটনাচক্রে ওই সময়ে ওই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন পৌর কমিশনার নাজিমুদ্দিন খান বাচ্চু ভাই। রহিমা বেগম ওজনে কম দেওয়ার বিষয়টি কমিশনার সাহেবকে জানায়। বাচ্চু ভাই ওই দোকান থেকেই একটা বাঁশের ফাল্টি (লাঠি) নিয়ে রহিমাকে সাথে করে মাংসের দোকানের সামনে হাজির। নুরুমিরু বাচ্চু ভাইয়ের হাতে লাঠি, মাংসের ব্যাগ ও রহিমাকে দেখে ঘটনা আন্দাজ করতে পেরে উঠে দাঁড়ালো।
: এই মহিলা তোদের কাছ থেকে কয় কেজি মাংস কিনেছে?
কমিশনার ভাইয়ের প্রশ্ন শুনে মিরু পালানোর চেষ্টা করে। ইতিমধ্যে নুরু কসাই দৌড়ে সোজা দক্ষিণ দিকে পালালো। কিন্তু মিরু পালাতে গিয়ে ধরা খেলো। বাচ্চু ভাইয়ের লাঠিপেটা খেয়ে সোজা স্টেশনের দিকে এই দৌড়-না সেই দৌড়। মাংসের দোকান ফাঁকা। কীসের মাংস, কীসের টাকা, কীসের কী! আগে জীবন বাঁচাই।
কে বা কারা বলেছে, বাঁচতে চাইলে শাজাহান (পৌর কমিশনার) ভাই’র কাছে যা। তা ছাড়া বাঁচতে পারবিনা। কিছু বুঝলেন কি? এই ঘটনা এখানেই ইতি টানলাম।
২। মাছ বাজারে ঢুকলে সবাই ডাকাডাকি করে।
: ভাই এই খানে আসেন এইদিকে আসেন, ভালো তাঁজা মাছ আছে। একবার অনুরোধে ঢেঁকি গিললাম। ইলিশ মাছ কিনে ফেললাম। কেজি ১ হাজার ১০০ টাকা। বাজারের বাজেট ফেল হয়ে গেল। অন্যান্য সওদাপাতি কেনার টাকায় ঘাটতি পড়ে গেলো। যাই হোক, গেলাম তরকারির দোকানে।
: ভাই, মাছ কত করে নিলেন? জানতে চাইলো দোকানি।
: কেজি ১১’শ টাকা।
: মাছটা দেনতো ভাই, মেপে দেখি। মাপার পর দেখা গেল প্রায় এক’শ গ্রাম কম।
শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। কী করা যায় ভাবছিলাম। সব্জি বিক্রেতা বললো, ভাই চলেন মাছ বাজারে যাব।
মাছওয়ালা আমাকে দেখেই;
: ও ভাই ও ভাই, ভাইরে ভুল হয়ে গেছে ভাই। বলেই হাত থেকে মাছটি নিয়ে আর একটি মাছ ওজন দিলো।
: ভাই এক্কেবারে বেশী দিলাম। এইটার ওজন ১ কেজি ২০০ গ্রাম।
পাশের মাছওয়ালা বললো, শালা মানুষ চিনিস না। পড়বি তো পড় মালীর ঘাড়ে!
৩। গত বছর গ্রামের বাড়ি পিরোজপুরে গিয়েছিলাম। পুরাতন বাসস্ট্যান্ডে নেমে ভাবলাম, বহু দিন পর বাড়িতে যাচ্ছি, ফল ফলাদি নেওয়া দরকার। একটা দোকান থেকে আপেল, আঙ্গুর ও মালটা মিলিয়ে ৫ কেজি নিয়ে বাসে উঠলাম। ফলের দোকানি খাতির আর ভক্তি দেখে ভিতরে খটকা লাগলো। ১ ঘণ্টার পথ তুষখালী বাজারে গিয়ে পরিচিত দোকানে মাপলাম। দেখি সাড়ে ৪ কেজির একটু বেশী। মনটা চাইলো আবার পিরোজপুর ঘুরে যাই। আপডাউন ভাড়া ১’শ আশি টাকা লাগবে লাগুক। শালার ফলালারে দুই কথা বলে আসি।
৪। পত্রিকায় দেখলাম, কয়েকটা তেলের পাম্পে জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। অপরাধ, ওজনে কম। আচ্ছা প্রতি লিটারে যদি ৩০ মিলি লিটার তেল কম দেয়া হয়, আর একটা পাম্পে যদি গড়ে প্রতিদিন ১ হাজার লিটার তেল বিক্রি হয়। তাহলে দিনে ১০০০দ্ধ৩০= ৩০০০ মিলি লিটার হয়। অর্থাৎ ৩০ লিটার। প্রতি লিটারের দাম ১০০ টাকা হলে প্রতিদিন মোট ৩০দ্ধ১০০= ৩ হাজার টাকা হয়। অর্থাৎ বছরে কেবল মাত্র ওজনে কম দিয়েই লাভ হয় ১০ লক্ষ টাকার ওপরে।
আচ্ছা একজন তেল পাম্পের সম্মনিত মালিক কি এই ধরনের ব্যবসা করতে পারেন? কিন্তু কেউ মানুক আর না মানুক, এই দেশে মাপে কম শুধু ছোটরাই দেয় না, বড়রাও দেয়।
৪। একটা ঐতিহাসিক ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাই। সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি একজন খ্যাতিমান সুশাসক ছিলেন। তার সময়ে তার রাজ্যের সীমানার মধ্যে ওজনে হের ফের করার এক রোগ ব্যবসায়ী সমাজকে পেয়ে বসেছিল এবং তা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না।
তখন আলাউদ্দিন খিলজি আইন করেছিলেন, বাজারে বাজারে হঠাৎ হঠাৎ মনিটরিং হবে। ওজনে কম দেওয়ার কোনও বিষয় ধরা পড়লে যতটুকু কম প্রমাণিত হবে তাৎক্ষণিকভাবে তা দোকানীর শরীরের মাংস কেটে ক্রেতাকে পূরণ করে দেওয়া হবে। রাজ্যব্যাপী এমন বেশ কিছু ঘটনা ঘটার পর ব্যবসায়ীরা এত সতর্ক হয়ে গিয়েছিলো যে ঐতিহাসিকরা বলেন, দশকের পর দশক আর কখনও ওজনে কম দেওয়ার প্রবণতা ব্যবসায়ীদের মাঝে দেখা যায়নি।
৫। শেষে ছোট্ট একটি গল্প বলে শেষ করি। আমি তখন বরিশাল সরকারি বিএম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে পড়ি। আমার সাথে ম্যাসে থাকতেন এক ভদ্র লোক। তিনি বাজারে খোলা আটা বিক্রি করতেন। একদিন জিজ্ঞেস করলাম, ভাই কী ভাবে বেচাকেনা করেন, দৈনিক কত লাভ হয়? উত্তরে ভদ্র লোক বললেন, যে দামে কিনি, সেই দামে বেচি। লাভ না হলে চলি কেমনে? মনে খটকা লেগে গেলো। বললাম ভাই, তাহলে কীভাবে লাভ করেন? কেমনে কী? ভদ্র লোক বললেন, তুমি ছাত্র মানুষ। এই বয়সে লেখাপড়া করতেছো, লেখাপড়া করো। লাভ লোকসানের হিসাব করার বয়স এইটা না। আপনারা লাভের হিসাবটা কি কিছু বুঝলেন?
আল্লাহ বলেন, ‘যারা মাপে কম দেয়, তাদের জন্য দুর্ভোগ। এরা লোকের কাছ থেকে যখন মেপে নেয়, তখন পূর্ণ মাত্রায় নেয় এবং যখন মেপে দেয় তখন কম করে দেয়। তারা কি চিন্তা করে না যে, তারা পুনরুত্থিত হবে? সেই মহাদিবসে যেদিন মানুষ দাঁড়াবে বিশ্ব প্রতিপালকের সামনে। ’ (সূরা মুতাফফিফিন, আয়াত : ১-৬)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, তোমরা সঠিক ওজন কায়েম করো এবং ওজনে কম দিও না। ’ (সুরা রহমান, আয়াত : ৭-৯)। অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘তোমরা মাপ ও ওজন পূর্ণ করে দাও ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে। আমরা কাউকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত কষ্ট দিই না। ’ (সুরা আনআম, আয়াত : ১৫২)।
পরিমাপে ও ওজনে কম দেওয়ার ফলে আল্লাহ তাআলা ফসলের উৎপাদন কমিয়ে দেন ও দুর্ভিক্ষ দেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘দুর্ভোগ তাদের জন্য, যারা মাপে কম দেয়, যারা মানুষের কাছ থেকে ওজন করে নেওয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করে, আর যখন মানুষকে মেপে কিংবা ওজন করে দেয়, তখন কম দেয়। ’ (সুরা মুতাফফিফিন, আয়াত : ১-৩)
রাসুল (সা.) একবার পরিমাপকারী ও দাঁড়িপাল্লা দ্বারা ওজনকারী ব্যবসায়ীদের বলেন, ‘তোমাদের ওপর এমন দুইটি জিনিসের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে, যে জিনিস দুইটির দায়িত্ব পালনে অবহেলা করার কারণে তোমাদের আগের উম্মত ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ’ (তিরমিজি)
অন্য হাদিসে তিনি বলেন, ‘বিচারের দিনে (অসৎ) ব্যবসায়ীদের হাশর হবে ফাসিক, কাফির ও বদকারী হিসেবে, তবে তাদের মধ্যে যারা মুত্তাকি, পুণ্যবান ও সত্যবাদী, তাদের এমনটি হবে না। (মিশকাত, পৃষ্ঠা নং : ২৪৪)।
মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির অন্বেষায় কর্মকান্ড মূল্যায়ন করে আত্মসমালোচনার মাধ্যমে আগামী দিনের জন্য সুপাথেয় সংগ্রহের জন্য উদ্যমী হওয়া। মহান আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন- আমীন!
লেখক তরুণ আলোচক ও গবেষক
মুফতি খোন্দকার আমিনুল ইসলাম আবদুল্লাহ ।
ইমাম
ফকির তলা বায়তুল মামুর কেন্দ্রীয় শাহী জামে মসজিদ ।
ফকির তলা , ভবানীপুর , শেরপুর , বগুড়া ।
ReplyReply allForward
|