স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও গুরুদাসপুরের তিন বধ্যভূমির রাষ্ট্রিয় স্বীকৃতি মেলেনি

Spread the love

মো. আবুল কালাম আজাদ

বাঙ্গালী জাতির বিজয়ের ঐতিহাসিক ডিসেম্বর মাস থেকেই জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের মধ্য দিয়ে সুচনা হয়েছিল মহান স্বাধীনতার। আবার এই ডিসেম্বর মাসেই পাক হানাদারদের বীর বাঙ্গালির কাছে নয় মাসের যুদ্ধে নিরস্ত্র বীর বাঙ্গালির কাছে নির্লজ্জভাবে পরাস্ত হয়ে আত্মসমর্পনের মধ্যদিয়ে অর্জিত হয়েছিল মহান বিজয়।শত্রæমুক্ত হয়েছিল বাঙলাদেশ। ফিরে পেয়েছিল লাল সবুজের পতাকা আর স্বাধীন সার্বভৌম মানচিত্র।আমরা হলাম স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন নাগরিক। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি নাটোরের গুরুদাসপুরের গনহত্যার তিন বধ্যভূমির।
১৯৭০ সালে ৭ ডিসেম্বর পুর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনে বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগের বিজয় দেখে সেনা শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। নির্বাচনের ফলাফলটি ছিল পাক বাহিনীর কাছে অবিশ^াস্য-পুর্ব পাকিস্তানের ১৬২ টি আসনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটের ব্যবধানে ১৬০টি আসন পায়। জাতীয় পরিষদের ৩১৩ টি আসনের মধ্যে পুর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি , পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্রোর দল পিপলস পার্টি ৮৮টি এবং অন্যান্য সব দল পেয়েছে বাকী ৫৮টি আসন। পাকিস্তানী সেনা শাসক তখনই পরাজয়ের গøানি সহ্য করতে না পেরে সিদ্ধান্ত নিল, কোনভাবেই বাঙালীদের হাতে পাকিস্তানের শাসনভার তুলে দেওয়া যাবে না। জেনারেল ইয়াহিয়া আর তার দলবল নিজের অজান্তেই ‘বাংলাদেশ’ নামের আর একটি দেশ জন্ম দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে। চলে সংলাপের নামে প্রহসন।
১৯৭১ সাল । ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকা হয়। বাঙালী সবাই সেই দিনটির জন্য গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে। জাতীয় পরিষদের ঠিক ২ দিন আগে ১লা মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ¯’গিত করেন।এতে পুর্ব পাকিস্তানের বঙালিরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। বঙ্গবন্ধু সারাদেশে ৫ দিনের হরতাল ও অনির্দিষ্টকালের জন্য অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ২ মার্চ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা তোলেন ছাত্র নেতা আ স ম আব্দুর রব।বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে একটানা ৫ দিন হরতাল ও অসহযোগ আন্দোলনের পর ৭ ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে(বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ঐতিহাসিক ভাষনে ঘোষনা করেন- “ এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রম। প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রæর মোকাবেলা করতে হবে”।
২৫ শে মার্চ কাল রাত্রে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী বাংলাদেশকে চির পদানত করার লক্ষ্যে স্বাধীনতাকামী নিরিহ নিরস্ত্র বাঙাালীর উপর রাতের আঁধারে ঝাঁপিয়ে পড়ে গনহত্যা শুরু করে।গনহত্যার জন্য জেনারেল ইয়াহিয়া খান ২৫ শে মার্চ তারিখটা বেছে নেওয়ার কারন- সে বিশ^াস করতো এটা তার জন্য শুভদিন। দুই বছর আগে এইদিনে সে জেনারেল আয়ুব খানের কাছ থেকে ক্ষমতা পেয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হয়েছিল।২৫ শে মার্চ ঢাকা শহর ছিল নরকের মত।পাকিস্তানীদের এই আক্রমনের মোকাবেলায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ শে মার্চ মধ্যরাত শেষে ২৬ শে মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষনার প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান বেতার-টিভির ভাষনে ঘোষনা করেছিলেন-“মুজিব ইজ এ টেরর টু দি নেশান, দিস টাইম হি উইল নট গো আন পানিশড” অর্থৎ-মুজিব একজন জাতীয় বেঈমান,এবার তাঁকে শাস্তি পেতেই হবে। শুরু হয় “সার্চলাইট অপারেশনের” নামে দেশব্যাপী গনহত্যা।নাটোরের গুরুদাসপুরেও ৪ টি গনহত্যা চালায় বর্বর পাক হায়েনারা। চারটি গনহত্যায় অর্ধশতাধিক নিরিহ মানুষ অকাতরে জীবন দেন। আহত হন অনেকে। ঘর-বাড়ি,সোনা দানা সবকিছু লুটকরে নেয় পাকিস্তানের দালালেরা। গনহত্যা তিনটি হচ্ছে- গুরুদাসপুর পৌর সদরের উত্তর নারিবাড়ি, বিয়াঘাট ইউনিয়নের বিয়াঘাট গ্রামে এবং ধারাবারিষা ইউনিয়নের পোয়ালশুড়া পাটপাড়া গ্রামে।
নারিবাড়ি দুই দফা গনহত্যায় ২৬ জন শহীদ হন :
১৭ এপ্রিল মঙ্গলবার চলনবিলের বৃহৎ ব্যাবসা বন্দর চাঁচকৈড় হাটের দিন বেলা সাড়ে ১০ টার দিকে ৩ ট্রাক পাক বাহিনী নারিবাড়ি গ্রামে দালালদের নির্দেশিত হিন্দু পাড়ায় অতর্কিত হামলা করে গনহত্যা চালায়। নারিবাড়ির পাকবাহিনীর এই গনহত্যায় ১৪/১৫ জন নিহত হন। নিহতরা হলেন-১.নারায়ন মজুমদার-শিক্ষক,২. মানিকচন্দ্র মালাকার-শিক্ষক, ৩.মহিন্দ্র নাথ সরকার-ডাক্তার,৪. বলরাম সরকার-ব্যবসায়ী, ৫. নিলরতন সরকার-শিক্ষক,৬. দিলীপকুমার- শিক্ষক,৭. সুরেশ মজুমদার-ব্যবসায়ী,৮.শীতনাথ সরকার-ব্যবসায়ী, ৯. বিন্দু ঘোষ, ১০. গেদু মালাকার,১১. নবরাম মজুমদার ,১২. যদুনাথ কর্মকার, ১৩. উপেন্দ্র নাথ অধিীকারী- শিক্ষক এবং ১৪.ছাত্র নেতা মোবারক হোসেন ও অজ্ঞাত ১জন।১৯ এপ্রিল বৃহস্পতিবার পাকসেনারা পুনরায় হামলা চালিয়ে আরো ১১ জনকে হত্যা করেছিল। নারিবাড়ির গনহত্যায় শহীদদের স্মরণে ৩টি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান করা হয়েছে। স্মৃতিস্তম্ভের ফলকে শহীদদের নাম লেখা আছে। পাকসেনাদের বুলেটের আঘাতে বীর শহীদদের স্মরণে নারিবাড়ি বিয়াঘাট ও পোয়ালশুরা পাটপাড়ায় নির্মিত স্মৃতিসৌধ থাকলেও সরকারিভাবে সংরক্ষনের কোন ব্যব¯’া নাথাকায় অযতেœ অবহেলায় পড়ে আছে।গুরুদাসপুরের গনহত্যায় নিহত শহীদদের স্মরনে সরকারিভাবে কোন কর্মসুচিও গ্রহন করা হয়না।অথচ তারাই মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে গুরুদাসপরে সর্বপ্রথম গনহত্যার শিকার হন। বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনকে দেখার জন্য স্বাধীনতাকামী সচেতন জনগন বিশেষভাবে কামনা করছেন।

বিয়াঘাট গ্রামে ৩৩ জন শহীদ হন :
গুরুদাসপুরের বিয়াঘাট গ্রামে সবচেয়ে ভয়াবহ গনহত্যা চালিয়েছিল পাকহানাদার বাহিনী। রাজাকার আর দালালদের মাধ্যমে দেওয়া তথ্যে পাকবাহিনীরা জানতে পারে গুরুদাসপুর উপজেলা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে নন্দকুঁজা নদীর উত্তরপাড় বিয়াঘাট গ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা লুকিয়ে আছে। পাকসেনারা গোয়েন্দা তথ্যে জানতে পেরে ১৫ জুলাই রবিবার পাকবাহিনী হামলাইকোল নন্দকুঁজা নদীর খেয়াঘাটে খেয়া নৌকায় পার হয়ে ছহির উদ্দিন সরকার মেম্বরের বাড়িতে যায়। সেখানে বেশকিছু দিনমজুর ছিল। পাকবাহিনী গ্রাম থেকে আরো নিরিহ মানুষ ধরে এনে নির্মমভাবে গুলি করে ৩৩ জনকে হত্যা করে। মিলিটারির আসার খবর পেয়ে এলাকার সব মানুষ প্রানভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে জ্ঙ্গলে, মাঠের ফসলের জমিতে, অন্য গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল।বিয়াঘাট গ্রামে পাকবাহিনীর গুলিতে নিহতরা হ”েছন-১. আফাজ উদ্দিন, ২. আব্দুল জব্বার, ৩. আব্দুর রাজ্জাক,৪. আব্দুল মৃধা, ৫. গাজেদুর রহমান, ৬. আসকান আলী, ৭. দুখু মিয়া,৮. কার্তিক শেখ, ৯.লোকমান হোসেন, ১০. তছের আলী, ১১. নিতু পরামানিক, ১২. হাকিম উদ্দিন, ১৩.ছাইফুর রহমান, ১৪. আজিজুর রহমান,১৫. কায়েম উদ্দিন , ১৬.আলিমুদ্দিন , ১৭. আহম্মেদ সরকার ,১৮. যদু শেখ, ১৯. হযরত আলী খান, ২০.মোজাহার আলী, ২১. আরমান আলী, ২২. মজিবর রহমান, ২৩. ওসমান গনি, ২৪. মগরব আলী,২৫. আশু মৃধা, ২৬. রিয়জ উদ্দিন মুন্সি, ২৭. আলিমুদ্দিন, ২৮. মজিবর রহমান, ২৯. নিয়ামত আলী, ৩০. জাদু মিয়া ও অজ্ঞাত আরো ২ জনের মধে একজন বামনকোলা গ্রামের।
পোয়ালশুড়া পাটপাড়া গ্রামে গনহত্যা :
১৯৭১ সাল ১৫ জুলাই রবিবার। বিয়াঘাট আর পোয়ালশুড়া পাটপাড়া গ্রামের গনহত্যা একই দিনে হয়েছিল। পোয়ালশুড়া পাটপাড়া গ্রামের কৃষকরা ধান-পাটের জমিতে নিড়ানী দি”িছল। এসময় পাকবাহিনী পাকা সড়ক দিয়ে গাড়ি নিয়ে যাওয়ার পথে গ্রামের উত্তরে নীলকুঠিবাড়ি ধানের জমিতে গুলি করে তিনজন দিনমজুরকে হত্যা করে। পাকবাহিনীর গুলিতে নিহতরা হ”েছন-১. এজের উদ্দিন, ২. নাছির উদ্দিন এবং ৩. আক্কাস আলী । এই গ্রামে শহীদদের স্মরনে ২০০৫ সালে মৎস্যজীবি পাড়ায় “স্বাধীনতা স্মৃতিস্তম্ভ” ¯’াপন করা হয়েছে।
গুরুদাসপুরে পাকবাহিনীরা পরপর চারটি গনহত্যা চালানোর পর এলাকায় চরমভাবে ভীতির কারন হয়ে দেখা দেয়। পাকবহিনির নিয়োজিত রাজাকার , আলবদর, আলশামস বাহিনী এবং পিস কমিটির দালালেরা স্বাধীনতার স্বপক্ষের লোকজনের উপর নজরদারি বাড়ায়ে দিয়ে তালিকা করে এবং ভয়ভীতি দেখাতে থাকে। রাজাকার আর দালালদের ভয়ে আওয়ামী লীগের লোকজন এবং হিন্দুরা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে কেউ ভারতে আবার কেউ দুরে কোথাও নিরাপদ আশ্রয়ে চলেযায়। জনশুন্য হয়ে যায় গুরুদাসপুর, নারিবাড়ি, নারায়নপুর, পারগুরুদাসপুর, বিয়াঘাট, চাঁচকৈড়,নাজিরপুর, শিকারপুর, কাছিকাটাসহ আশপাশের গ্রামগুলো। সেই সুযোগে ঘর-বাড়ি, গরু ,ছাগল, সোনাদানা,আসবাবপত্র, গোলার ধান,পাটসহ সবকিছু লুট-পাট করে নিয়ে যায় লুটেরারা। কেউ বাধা দেয়ার সাহস পায়নাই।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তি যুদ্ধকানিলন সময়ে বর্বর পাকিস্তানী বাহিনী এবং রাজাকারদের হাতে তিনটি গনহত্যা হলেও সরকারীভাবে আজও গনহত্যার স্বীকৃতি মিলেনাই। ¯’ানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকেও গনহত্যায় বীর শহীদদের প্রাতি কোন কোন শ্রদ্ধা বা সম্মান জানানো হয়না। এতে গুরুদাসপুরের স্বাধীনতাকামী জনগন এবং নতুন প্রজন্ম পাক হানাদারদের বুলেটের আঘাতে নিহত বীর শহীদদের ঋনের কথাা ভূলতে বসেেেছ।তাই মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরুদাসপুরের এই তিটি গনহত্যায় নিহত বীর শহীদদের জাতীয় বীর হিসেবে রাষ্ট্রিয়ভাবে বধ্যভূমি স্বীকৃতি দিয় স্মৃতিসৌধ নির্মান করে সংরক্ষন করার জোর দাবি উঠেছে স্বাধীনতাকামী জনগন এবং বীর শহীদদের পরিবারের পক্ষ থেকে। আশা করছি মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয় বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবে।

# মো. আবুল কালাম আজাদ # সভাপতি, চলনবিল প্রেসক্লাব, গুরুদাসপুর, নাটোর # ০১৭২৪ ০৮৪৯৭৩ # ২৪/৩/২৩#

 

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD