সলঙ্গা(সিরাজগঞ্জ) সংবাদদাতা ফারুক আহমেদ: আধুনিক যন্ত্রপাতির জন্য মানুষের জীবন যাত্রী ও বদলে যাচ্ছে। সেই সাথে কালের বিবর্তনে আধুনিকতার ছোঁয়ায় পাতিলের ধানসিদ্ধ করা গ্রাম -বাংলার বৌধুদের ঐতিহ্য পাতিলের ধানসিদ্ধ আর চোখে পড়ে না। এক সময়ে আগের দিনে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে দেখা যেত ধানসিদ্ধ করা পাতিল। কিছু কাল আগেও ধানসিদ্ধর পাতিল মহিলাদের কাছে প্রয়োজনীয় একটি গৃহস্থালি উপকরণ ছিল। তাছাড়া পাতিলে করে গ্রামে গঞ্জের কৃষাণ -কৃষিণীর বধুরা রাত দশটা থেকে শুরু করে সকাল এগোরাটা পর্যন্ত পাতিলে ধানসিদ্ধ করা চোখে পড়তো কিন্তু বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিজ্ঞান আর তথ্য প্রযুক্তি যন্ত্রপাতি কলকারখানার কারণে গ্রামের কৃষাণ কৃষাণীর বধুরা আর পাতিলে ধানসিদ্ধ করে না। আমন ধানের ম ম গন্ধে এখন মাতোয়ারা দেশের সিরাজগঞ্জসহ সলঙ্গা অঞ্চলে ধান কাটা। বাড়িতে বয়ে আনা। গঙ্গা মেসিনে মারাই ঝাড়াই করে। সিদ্ধ-শুকানো। ছাঁটাই করা। বছরের খোরাকি ঘরে তোলা- এসব নিয়েই ব্যস্ত গাঁয়ের কৃষিনির্ভর নারী-পুরুষ সবাই। তাই শীত আর কুয়াশা উপেক্ষা করে দিন-রাত চলছে অন্য রকমের কর্মযজ্ঞ। বিশেষ করে পুরুষের তুলনায় নারীদের ব্যস্ততা যেন আরও বেশি। ধান সিদ্ধ, শুকানো আর সারা বছরের চাল মজুদের কাজটি যেন অঘোষিত ভাবে পুরুষরা তাদের ওপরেই বর্তে দিয়েছে। ঘরকন্নার নিয়মিত কাজের মাঝে তারাও চিরায়ত কাল থেকে এতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। দেশের উত্তরাঞ্চলসহ সিরাজগঞ্জের তিনটি উপজেলার বৃহত্তর চলনবিল বিশেষ করে সলঙ্গার অঞ্চলে কোন কোন জায়গায় বন্যার কারণে রোপা আমনের চাষ যেমন হয় কিছুটা বিলম্বে, তেমনি ফসলও আসে দেরিতে। সিরাজগঞ্জের বৃহত্তর চলনবিলসহ সলঙ্গার কোন কোন অঞ্চলের কৃষকেরা আমন ঘরে তুলে বোরো আবাদে প্রস্ততি শুরু করেছে। অথচ এ অঞ্চলের অধিকাংশ ক্ষেত এখনও বাইশ ধানে ভরা। বিশেষ করে বৃহত্তর চলনবিলের তিনটি জেলার নিম্নঅঞ্চের ক্ষেত-খামার আমন ও বাইশ ধানে পরিপূর্ণ। এখানকার ক্ষেত ভর্তি সোনালী ফসলের ডগায় জমছে শিশিরবিন্দু। এখন চলছে ফসল কাটা আর সিদ্ধ-শুকানোর ভর মওসুম। তাই তো এখন চারদিকে আমনের ম-ম গন্ধ। উত্তরঅঞ্চের বৃহত্তর চলবিলসহ সিরাজগঞ্জের সলঙ্গার যে কোন বাড়িতে গেলেই চোখে পড়বে ধানের স্তূপ। বিশেষ করে অবস্থাপন্ন কৃষকদের বাড়ির উঠোনের কোথাও এতটুকু ফাঁকা পড়ে নেই। সর্বত্র আঁটিবাঁধা ধানের স্তূপ। রাতভর চলছে ডিজেল চালিত পাওয়ার পাম্প মেশিন দিয়ে যন্ত্র বানিয়ে নিয়েছে। এগুলো ভাড়াতেও পাওয়া যায়। ধান মাড়াইয়ের কাজটি যেমন বেশির ভাগ রাতে হয়, তেমনি সিদ্ধ করার কাজটিও রাতেই বেশি চোখে পড়ে। সিদ্ধ করার আগে আবার কেউ কেউ ধান ভিজিয়ে নেয়। এতে সিদ্ধ হতে সময় কম লাগে। ধান ভেজানো হয় বস্তা,অথবা আতাল দিয়ে মাটিতে। ধান সিদ্ধ করার জন্য বানানো হয় কিছুটা কমবেশি পাঁচ-সাত ফুট দৈর্ঘ্য-প্রস্থের আড়াআড়ি মাটির চুলা কিংবা ইট খারা করে বানানো হয় চুলা। স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষায় চুলা বা উনুনকে বলা হয় ‘আফাল’। এ আফালের ওপরে বসানো হয় টিন দিয়ে বিশেষভাবে তৈরি করা চুঙ্গা। যাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ‘তাফাল’। আফাল আর তাফাল মিলেই চলে পাতিলের পরির্বতে ধান সিদ্ধ করার পালা। তাফাল বা চুলায় আগুন জ্বালানো হয় তুষ দিয়ে দিয়ে। যখনই চুলার মধ্যে ছিটিয়ে দেয়া হয় তুষ তখনই দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে আগুন। অথবা টিনের কারায়ে ইট খাড়া করে দিয়ে আগুনের চুলা সে আগুনে রাঙা হয়ে ওঠে গাঁয়ের কিষান বধূর মুখ। শীত আর কুয়াশা যতই তীব্র হোক, গভীর কিংবা শেষ রাতে শুরু হয় ধান সিদ্ধ করার পালা। যা চলে প্রায় দুপুর পর্যন্ত। পরে সিদ্ধ করা ধান মেলে দেয়া হয় রোদে। তিন-চার দিনেই শুকানো ধানে হয় চাল। যা হবে কৃষকের সারা বছরের খোরাকি। ধান ভিজানো, সিদ্ধ এবং শুকানোর এ প্রক্রিয়াকে গ্রামীণ জীবনের এক অনবদ্য চিত্রকল্প হিসেবে বিবেচনায় নেয়া গেলে, তা হবে আবহমান বাংলার এক অনন্য চিরায়ত দৃশ্যকাব্য। এর মাঝেই খুঁজে পাওয়া যাবে বাংলার প্রকৃত মুখ।
শীত ঠেকাতে কিষান বধূর গায়ে মোটা চাদর কিংবা কাঁতা। কোলে দুধের শিশু। কুয়াশা ভেদ করে তখনও উঁকি দেয়নি সূর্য। কিষান স্বামী দূর থেকে বয়ে আনছে ভেজা ধান। শালিক ও মোরগ-মুরগির দলবেঁধে ছড়ানো ছিটানো ধান ঠোঁটে কামড়ে ধরছে। চুলার আগুন জ্বলসে উঠছে। এমন সুমধুর দৃশ্য শুধু গ্রাম – গঞ্জেই মিলবে।
আমন ধান সিদ্ধ-শুকানোর এমন চিত্র কয়েকদিনে ঘুরে দেখা গেছে সিরাজগঞ্জের সলঙ্গাসহ তিনটি উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামে বা -গাঁয়ে। তাড়াশ উপজেলার কেশনাদিনাদীঘি গ্রামের এক বাড়ির উঠোনের কোনায় সকালে পুরাতন পদ্ধতিতে পাতিলে করে ধান সিদ্ধ করতে দেখা গিয়েছে।এক গৃহস্থ বধূ জানান, ধান সিদ্ধ শুকানোর কাজেও আছে নানা কৌশল। যা তিনি শিখেছেন তার শাশুড়ির কাছে। সিদ্ধ কমবেশি হলে চাল ভাল হবে না। আবার রোদেও শুকানো হবে পরিমাণ মতো। তা না হলেও চাল ভাল হবে না। দীর্ঘদিন ঘরে চাল রাখার জন্য পরীমিত সিদ্ধ এবং শুকাতে হবে। তিনি আরও জানান, তার শাশুড়ি ৬০ বছর ধান সিদ্ধ-শুকানোর কাজ করেছেন। তিনিও করছেন ১৮ বছর ধরে। এতে এখন তিনি যথেষ্ট অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছেন। পার্শ্ববর্তী মৃধা বাড়ির তিন সন্তানের মা আনোয়ারা বেগম জানান, ধান সিদ্ধ-শুকানোতে যে কত রকমের কৌশল আছে, যা শহরের মানুষ বুঝতে পারবে না। একত্রে যেমন ১৫-২০ মণ ধান সিদ্ধ করা যায়। আবার ১০-২০ কেজি ধানও সিদ্ধ করা যায়। ধানের পরিমাণ বুঝে সিদ্ধ করতে হয়। ভিজিয়েও রাখতে হয় একইভাবে পরিমাণ মতো। বেশি ভিজলে যেমন সমস্যা। আবার কম ভিজলেও সমস্যা। বাড়ির কর্তা আনোয়ার হোসেন জানান, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ, তাড়াশ ও উল্লাপাড়ার উপজেলার বিশাল অঞ্চলের বেশির ভাগ বাড়িতে ধান সিদ্ধ-শুকানোর কাজটি মহিলারাই করছে। এটি যুগ যুগের চিরায়ত ধারা, যা আজও বহমান। তবে পুরুষরাও সমানভাবে সহযোগিতা করে। তিনি আরও বলেন, এ তিনটি উপজেলার কৃষিসমৃদ্ধি এলাগায় কোন কোন অঞ্চলে ধান সিদ্ধ-শুকানোর যান্ত্রিক পদ্ধতি না থাকায় বাধ্য হয়ে প্রাচীন আমলের ধারাটি চলে আসছে। এটিকে গ্রামীণ জীবনের নিজস্ব ধারা বলা চলে।
সিরাজগঞ্জের সলঙ্গা অঞ্চলের অধিকাংশ কৃষক-চাষীর বাড়িতেই এখন যেন ধান সিদ্ধ-শুকানোর উৎসব চলছে। নারী-পুরুষ সবাই ব্যস্ত এ কাজ নিয়ে। যা চলবে আরও এক মাসের বেশি সময় জুড়ে। আবহমানকালের এ ঐতিহ্যে সমানে টিকে আছে মাটি আর মানুষের মাঝে।