‘বিজয়’ অর্জিত হলে ও ‘মুক্তি’ এখনও অধরা

Spread the love

আবদুর রাজ্জাক রাজু
সদ্য বিগত ১৬ ডিসেম্বর ছিল বাঙ্গালী জাতির মুক্তিযুদ্ধের ৫০তম বিজয় দিবসের সুবর্ণজয়ন্তী।। ১৯৭১ সালের এই দিনেই পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে অর্জিত হয়েছিল বিশ্বনন্দিত বাংলাদেশের বিজয়। আমাদের স¦াধীনতা যুদ্ধ মূলত: মুক্তিযুদ্ধ নামেই বেশি ও বহুল পরিচিত। কারণ মুক্তির স্বপ্নই ছিল বাঙ্গালী জাতির চরম ও পরম চাওয়া ও পাওয়া। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মাচের্র ভাষনে তাই বলেছিলেন,এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম , এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। পাকিস্তানী দু:শাষন ও অমানবিক শোষন থেকে বাচাঁর তথা মুক্তির লক্ষ্যই ছিল বাঙ্গালীর র্দীঘ সংগ্রাম ও আন্দোলনের মুল উদ্দেশ্য। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৬৪ এর ছয় দফা, ৬৯ এর গণআন্দোলন এবং ১৯৭০ এর ঐতিহসিক নির্বাচন শেষে ১৯৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রাম প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের দুঃশাষনের যাঁতাকল ও শোষণ-বৈষম্যের নাগপাশ হতে মুক্তির সংগ্রাম। তাই আমাদের মহান সংবিধানেও যুক্ত হয়েছিল সেই মৌলিক মানবাধিকারের ৪ মূলমন্ত্র যার মধ্যে ছিল: গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতিয়তাবাদ। একটি ন্যায় ও সমতা ভিত্তিক অসম্প্রদায়িক চেতনার ন্যায্য সমাজ এবং জাতীগঠন ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্তর্নিহিত স্বপ্ন।
আমাদের আশা ছিল মুক্ত ও উদার গণতন্ত্র, মৌলবাদ বিবর্জিত প্রগতিশীল বহুত্ববাদী আধুনিক সমাজ ব্যবস্থা, ন্যায় বিচার,বাক, ব্যক্তি চিন্তা ও মতামত প্রকাশের এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, বৈষম্যহীন, শোষন মুক্ত একটি সভ্য ও উন্নত দেশ। আজ দেখা যাচ্ছে জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃেত্ব দেশ উন্নতির পথে এগিয়ে চলেছে। ইতোমধ্যে জাতীসংঘ এমডিজি অর্জিত হয়েছে। সেটা আমাদের বৈশি^ক সফলতার অংশ। বর্তমানে এসডিজি লক্ষ্যসমুহ অর্জনে সরকার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে ২০৩০ সালের মধ্যে স্বল্পনোœত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য জাতিসংঘের অনুমোদন মিলেছে। আমরা উন্নয়নশীল দেশ থেকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে উপনীত হওয়ার উচ্চভিলাসী স্বপ্নে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। সেটা বাঙ্গালী জাতীর জন্য বিশেষ গর্বের ব্যাপার। তা হবে বৈশি^ক উন্নয়নের ইতিহাসে এক মাইলফলক অর্জন। এছাড়া দেশে পদ্মাব্রীজ নির্মাণ, মহাকাশে স্যাটালাইট স্থাপন সহ বেশ কিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। জাতীয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আছে আরো কিছু অর্জন ও সাফল্য। এসব মিলে বলা যায়, দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে আশাব্যঞ্জক গতিতে ধাবমান। একদা একটি তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে আখ্যায়িত দুর্নামের তকমা হতে উত্তীর্ণ হয়ে আজ স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধির এই অগ্রযাত্রা অবশ্যই শেখ হাসিনার সরকারের বড় কৃতিত্ব ও সফলতা যা বিশে^ প্রশংসিত হচ্ছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং উচ্চাকাংখী অভিলাষে দেশকে উন্নয়নের পথে অব্যাহতভাবে এগিয়ে নিয়ে চলেছে তা দেশে বিদেশে নন্দিত হচ্ছে। এখন আমাদের নজর দিতে হবে স্বাধীনতার মূলমন্ত্রের কোন দিকগুলো এখনো ঘাটতি তথা অপূরণ রয়ে গেছে সেদিকে। যে স্বচ্ছ অবাধ নিরপেক্ষ ভোট তথা নির্ভেজাল নির্বাচনের জন্য , কথা বলার স্বাধীনতার জন্য , ন্যায় বিচার ও সমান অধিকারের জন্য, অর্থনৈতিক শোষনমুক্তির, অসাম্প্রদায়িক এবং সবশেষে মজবুত গণতন্ত্রের জন্য আমরা পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে সুর্দীঘ লড়াই-সংগ্রাম করেছিলাম তা আজো আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি।
আজ রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, দুর্নীতি , অসাম্য, বৈষম্য, গুম, খুন, অপহরণ, ভোট চুরি, নির্বাচন নিয়ে প্রহসন-তামাশা, বিভিন্ন সেক্টরে অব্যবস্থাপনা, বিশৃংখলা সর্বোপরি রাজনৈতিক বিভেদ ও বিভাজন প্রকট আকার ধারণ করেছে।বিশেষ করে শুধু শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতেই নয়, সব খাতেই সীমাহীন নৈরাজ্য এবং বাণিজ্য চলছে। ক্ষুধা, দারিদ্র, বঞ্চনা, মানবাধিকার লংঘন, সুদ, ঘুষ, অশান্তি, হানাহানি , হিংসা, প্রতিহিংসা, কালো টাকা, পেশিশক্তি, দেশের অর্থ বিদেশে পাচার , নারী-শিশু নির্যাতন , ধর্ষণ সংখ্যালঘু নির্যাতন, পার্বত্য চুক্তির অপূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা না হওয়া, সংবিধান সম্মত পন্থায় স্থায়ী আইনী উপায়ে নির্বাচন না হওয়া এবং বিভিন্ন নির্বতনমূলক কালাকানুন ইত্যাকার বহু সমস্যায় দেশ নিমজ্জিত। এর বাইরে শিক্ষা ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা , দখল, দূষণ, অপরিকল্পিত নগরায়ন,শিল্পকারখানা,পরিবেশ বিনষ্ট, বাল্য বিবাহ, দুর্বল স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা , অনিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থাপনা এবং সর্বত্র ভয়াবহ দলীয় রাজনৈতিকীকরণ আর এক দলীয় কর্তৃত্ববাদ এবং স্বৈরতন্ত্রের আদলে সরকারী আমলতন্ত্রের দাপট-দৌরাত্ম্য সব মিলে দেশ সম্পদে ও উন্নয়নে এগিয়ে গেলেও সভ্যতার ও গণতন্ত্রের মাপকাঠিতে এখনও পিছিয়ে পড়ে আছে। এদেশে শতভাগ দুর্নীতিগ্রস্ত সবকিছু। এই দুর্নীতি ও দুঃশাসন সব কিছুকে ম্লান ও অকার্যকর করে দিচ্ছে।খোদ দুদকেও অনিয়ম ও দুর্নীতি বিরাজমান। বিশেষত দুর্বল গণতন্ত্র, সুশাসন ও জবাবদিহিতার অভাব সব অপকীর্তির মূল কারণ। এটা সুসম উন্নয়নের প্রতিবন্ধক এবং আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রের চেতনা বিরোধী।
এমতাবস্থায় সাধারণ মানুষের সত্যকার মুক্তির লক্ষ্যে দেশের নেতৃত্ব ও সরকারের নতুনভাবে চিন্তা করা উচিত। কেননা স্বাধীনতা অর্জন যতটা সহজ আপামর জনতার মানবিক মুক্তি ও সবার জীবন মানের সম উন্নতি নিñিদ্র শান্তি ও অগ্রগতি বিধান ততটা সহজ নয়। কেবলমাত্র জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় ও আয়ুবৃদ্ধিসহ আর্থ-সামাজিক নানা সূচকে ক্রমোন্নতি দেশের মঙ্গল এনে দিতে পারে না। বিজয়ের ৫০তম বছরেও যদি দেশ ও জাতির মুক্তি নিয়ে কথা বলতে হয় তবে তা কিছুটা লজ্জার ও মানসিক কষ্টের ব্যাপার। আমাদের সব ভেদাভেদ ও সংকীর্ণতা ভুলে, রাজনৈতিক হিংসা-বিদ্বেষ দূরে রেখে, দলমতের হীণমন্যতা বিসর্জন দিয়ে, দেশ ও দেশের মানুষের জন্য সভ্য ও উন্নত দেশের নাগরিক সমাজের মতো প্রগতিশীল মানসিকতা নিয়ে জাতীয় স্বার্থকে সবার উর্দ্ধে স্থান দিয়ে কাজ করতে হবে। তাই গণতন্ত্র ও উন্নয়নকে সমান্তরাল দৃষ্টিতে গুরুত্ব দিতে হবে। একটা আগে আরেকটা পরে, একটা বেশী অন্যটা কম এই মতবাদ গ্রহণযোগ্য নয়। মনে করতে হবে একটা হৃদযন্ত্র আর অপরটা ফুসফুস। এর একটি ছাড়া অন্যটা অকল্পনীয়। বস্তুগত উন্নয়ন ও সম্পদ বৃদ্ধির পাশাপাশি মানবিক সভ্যতার উৎকর্ষের প্রতি সমধিক প্রাধান্য দেয়া বাঞ্চনীয়। কেননা আর্থ-সামজিক বিভিন্ন সেক্টরে আমরা উন্নতি করলেও মানব উন্নয়ন সূচকে আমরা কখনো ভাল করতে পারিনি , পারছি না। এর কারণ আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় আজ তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে। কাউকে দমন পীড়ণ করে, পেছনে ঠেলে দিয়ে দেশের সত্যকার টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। কোন বিশেষ শ্রেণি-গোষ্ঠির ধনী হওয়ার বা ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। সকল মানুষের সুসম উন্নয়ন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠাই ছিল দেশ স্বাধীনের মোক্ষ লক্ষ্য। এসব কারণে এখনও প্রকৃত মুক্তি মনে হয় দিল্লী দূর অস্ত। তবে সেদিকে আমাদের মনোনিবেশ ও প্রচেষ্টা নিয়োগ করা আশু দরকার।

লেখক : সম্পাদক, সাপ্তাহিক চলনবিল বার্তা, তাড়াশ, সিরাজগঞ্জ।

 

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD