নওগাঁ তথা তাড়াশের মুক্তিযুদ্ধের পুর্ণাঙ্গ ইতিহাস লেখা জরুরী

Spread the love

আবদুর রাজ্জাক রাজু

মুক্তিযুদ্ধকালে দেশে মনে হয় বেসরকারীভাবে সংগঠিত মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিক বৃহৎ যুদ্ধক্ষেত্র সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলার নওগাঁ ইতিহাসখ্যাত পলাশডাঙা যুব শিবির। গোটা উত্তর বঙ্গে এটা ছিল বৃহত্তম বেসরকারী সেক্টর। স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম আঞ্চলিক সংগঠক কিংবদন্তী মুক্তিযোদ্ধা মরহুম আব্দুল লতিফ মির্জার সার্বিক তত্বাবধানে ও নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল এই বিশাল মুক্তিসেনা সংগঠন।তিনি ছিলেন এর সর্বাধিনায়ক। এখানে ১৯৭১ সালের ১১ নভেম্বর পলাশডাঙা যুব শিবিরের মুক্তিবাহিনীর সাথে পাক সেনাদের সম্মুখ লড়াই সংঘটিত হয়।এতে অংশ নিয়েছিলেন উত্তররঙ্গের বিভিন্ন জেলার প্রায় ৫ শত অকুতোভয় মুক্তিফৌজ সদস্য। এখানে প্রায় অর্ধশত পাকসেনা এবং দেড় শত রাজাকার নিহত হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের কেউই নিহত বা তেমনটি আহত হননি বলে জানা যায়। অবশ্য এখন পর্যন্ত তাদের মধ্যে কোন নারী মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণের কথা শোনা যায় না। আব্দুল লতিফ মির্জাসহ এই রণাঙ্গনের শীর্ষ নেতৃত্বের কয়েকজন ইতোমধ্যে ইন্তেকাল করেছেন। তবে তাদের সহযোদ্ধাদের অধিকাংশই এখনও জীবিত থাকলেও তারা বয়সের ভারে ন্যূব্জ প্রায়। এরই মধ্যে নওগাঁয় মুক্তিযুদ্ধের স্মারক স্মৃতিস্তম্ভ সহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মিত হয়েছে। ভবিষ্যতে আরো কিছু হতে পারে যার মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধদের কিছু স্বপ্ন ও একান্ত চাওয়া-পাওয়া হয়তো থাকবে- তা প্রত্যাশা করা যায়। দিনটি স্মরণে ইত্যবসরে ঐতিহাসিক ১১ নভেম্বর নওগাঁ দিবস উদযাপিত হচ্ছে প্রতিবছর। সেই ধারাবাহিকতায় এবারও ওইদিন যথারীতি আয়োজন করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা জনতা মিলন মেলা ২০২১ নওগাঁ জিন্দানী ডিগ্রী কলেজ মাঠে। এর আগেও জাতীয় পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ এই মহান সমাবেশে যোগ দিয়েছেন, এবারও হয়তো থাকবেন। বোধকরি, আলোচনাকালে এই রণক্ষেত্রের মুক্তিযোদ্ধাদের হৃদয়বিগলিত স্মৃতিতর্পণে উঠে আসবে মুক্তিযুদ্ধকালীন নানা লোমহর্ষক ঘটনা যা বর্তমান প্রজম্মের জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও অনুপ্রেরণার খোরাক হয়ে থাকবে। সাথে থাকতে পারে বর্তমান বীর-গাজীদের পুরোনো কিছু চাওয়া-পাওয়া – সেটা বিচিত্র কিছু নয়। তার মধ্যে নওগাঁ মুক্তিযুদ্ধ ক্ষেত্রের সরকারী স্বীকৃতি, এখানকার মুক্তিযোদ্ধাদের খেতাব ও সম্মাননা ইত্যাকার।
কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ হল – এই যুদ্ধক্ষেত্রের এবং একই সাথে পলাশডাঙা যুব শিবির এর অভ্রান্ত এবং পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস লেখা। যাদের সীমাহীন ত্যাগ ও অমূল্য অবদানে এই চির স্মরণীয় ঘটনা তথা মহান কীর্তি স্থাপিত হয়েছে, তাদের অর্থাৎ সেই কীর্তিমানদের অতুলনীয় কীর্তিগাথা লিখিত দলিল আকারে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা অত্যাবাশ্যক তথা অতীব জরুরী। যুগপৎ তাড়াশের মুক্তিযুদ্ধকালীন ইতিকথাও লিখে তা বই হিসেবে প্রকাশ করা অপরিহার্য। এখনো তাড়াশে স্থানীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধ সময়ের সংগঠক ও নেতৃস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা অনেকেই বেঁচে আছেন। তাদের স্মৃতিচারণ থেকেই বেড়িয়ে আসতে পারে তাড়াশের স্থানীয় প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত কাহিনী। অন্তর্ভূক্ত হতে পারে তাড়াশে প্রথম পাকবাহিনীর মিলিটারী অপারেশন ও প্রতিরোধের গল্প, শহীদ মুক্তিযোদ্ধ্ াএবং আমবাড়িয়া গণহত্যার প্রসঙ্গসহ যাবতীয় বিষয়াবলী। যা বই আকারে প্রকাশিত হলে পরবর্তী প্রজম্ম জানতে পারেব মুক্তিযুদ্ধের স্থানীয়ভিত্তিক প্রকৃত ইতিহাস। কেননা আমাদের ভবিষ্যত প্রজম্মের এসব কাহিনী জানা ও উপলব্ধি করা বিশেষ দরকার। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সঠিকভাবে না জানলে আগামী নতুন প্রজম্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ কীভাবে ধারণ ও লালন করবে। কীরুপেই বা তারা স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের প্রতি অবিচল আস্থা রেখে এর অতন্দ্র প্রহরী হয়ে থাকবে। পাশাপাশি তারা জাতীয়ভাবে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভান্ডার এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা বই “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” ও “কারাগারের রোজনামচা”র মত বইগুলো পড়তে পারে। তানাহলে আজো মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার মত অপশক্তি মাঝে মাঝেই মাথাচাড়া দিয়ে জাতিকে বার বার বিব্রত করতে কুণ্ঠাবোধ করবে না।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য,তাড়াশের খ্যাতিমান বীর মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক সাইদুর রহমান সাজু ইতোপূর্বে আমাদের সাপ্তাহিক চলনবিল বার্তায় তিন পর্বে “তাড়াশ ও নওগাঁ মুক্তিযুদ্ধের ইতিকথা” শীর্ষক নিবন্ধ লিখেছেন।স্মরণযোগ্য,সিরাজগঞ্জ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ইতোমধ্যে উপজেলাভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখা হয়েছে। অথচ তাড়াশে আজো সেই কাজটি করা হয়নি, কেউ আরম্ভই করেনি, অসমাপ্ত পড়ে আছে। এখন তাড়াশের মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনকথা ও মুক্তিযুদ্ধের সমগ্র ঘটনাবলী সমন্বিত করে একটি বিস্তৃত এবং পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস লেখা সময়ের দাবী। সেটা করার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্য থেকেই যৌথ প্রয়াস এবং প্রচেষ্টা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এজন্য বাইরের লেখক-সাহিত্যিকদেরও প্রয়োজনে সহযোগীতা নেয়া যেতে পারে। এর আগে অবশ্য এই নিবন্ধকারের তেমন উদ্যোগ হালে পানি পায়নি, অর্থাৎ কোন প্রকার সাড়া মেলেনি। সেক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বার্থ বা দাবীদাওয়া ব্যাপারে সোচ্চার দেখা গেলেও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণামূলক ইতিহাস লেখার জন্য তাদের কোন আগ্রহ নেই। তাই আমরা আশা করি, তাড়াশের মুক্তিযোদ্ধা, জ্ঞানীগুণী, বুদ্ধিজীবি, নাগরিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং সংশ্লিষ্ট সরকারী কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে সম্মিলিত ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ নিয়ে একটি মহতী ও ঐতিহাসিক স্বাক্ষর রেখে যাবেন। আর সময় ক্ষেপণ না করে সেই শুভ কর্মটি যত দ্রুত শুরু ও সম্পন্ন হয় ততই শ্রেয়।

লেখক ঃ সম্পাদক, সাপ্তাহিক চলনবিল বার্তা।

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD