রায়গঞ্জের পাঁচ জয়িতার জীবনের গল্প

Spread the love

“জয়িতা অন্বেষনে বাংলাদেশ”

স.ম আব্দুস সাত্তার,রায়গঞ্জ, প্রতিনিধি: সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জে জীবন যুদ্ধে হার না মানা ৫ জন জয়িতার গল্প অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী ঃ- আমি জাকিয়া বেগম, ধুনুুট থানার খাদুলি গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে আমার জন্ম। অল্প বয়সে সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ উপজেলায় ধানগড়া ইউনিয়নের করিলা বাড়ি গ্রামে আব্দুস সালামের সাথে বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকেই বিভিন্ন রোগ ব্যাধি হয়। এমতাবস্থায় একটি মেয়ে সন্তান হয়। আর্থিক সমস্যার কারণে স্বামীর সঙ্গে প্রতিনিয়ত ঝগড়াসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। স্বামী প্রায়ই অকারণে মারধর করতো। এ সময় আমার শরীরে রোগ-ব্যাধি দেখা দেয় এবং হাসপাতেলে গিয়ে ডাক্তার দেখাই। ডাক্তার আমাকে বলে যে, জরায়ুতে সমস্যা। পরবর্তীতে বাড়ি গিয়ে স্বামীকে সমস্যার কথা বলি। স্বামী ক্ষিপ্ত হয়ে বাড়ি ছেড়ে যায়। কোন উপায়ন্ত না পেয়ে মেয়েকে দিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে চিকিৎসার জন্য সকলের কাছে হাত পেতে যা পেয়েছি তাই নিয়ে রায়গঞ্জ হাসপাতালে ভর্তি হই। এবং চিকিৎসা নেই। প্রাথমিক চিকিৎসার পর ডাক্তার পরামর্শ দেয় উন্নত চিকিৎসার জন্য । এই সময় যেন আমার মাথার উপর আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। জরায়ু ক্যান্সারের ভয়ে ভীত জীবন জাপন করি। লোক লজ্জার ভয়ে অন্যের কিছু বলতেও পারি না। এর মধ্যে নিজেরা করি ও ভূমিহীন সমিতির আপাদের সাথে পরিচয় ঘটে। তাদের সাথে এ বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করি। এরপর তাদের সহযোগীতায় ঢাকায় গিয়ে তাদের অফিসে রেখে ভাল ডাক্তার দিয়ে আমার জরায়ুর অপারেশন করাই এবং ফিরে এসে ভূমিহীন সমিতি করি। ভূমিহীন সমিতি করার মধ্যে দিয়ে জেন্ডার, নেতৃত্ব উন্নয়ন যৌথ উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা, পিতৃতন্ত্র, মৌলবাদ, প্রজনন ও স্বাস্থ্য বিষয়ে বিভিন্ন প্রকার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। তারা আমাকে পরামর্শ ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য কিছু আর্থিক সহায়তা করেন। পরে উল্লাহপাড়া থেকে কাটা কাপড় ক্রয় করে গ্রামে গ্রামে ফেরী করে বিক্রি করি। এর থেকে কিছু অর্থ জমা রাখি এবং ব্যাংক একাউন্ট করি। যখন জমাকৃত টাকার পরিমান বাড়তে লাগল তখন আমার চিন্তা হল আমার শশুরের কাছ থেকে ৭ শতক জমি বসত বাড়ি করার জন্য ক্রয় করি। পরবর্তীতে ৩ বছর পর যখন উল্লাপাড়া মালিকের কাছ থেকে বেশি বেশি কাটা কাপড় কিনে আনতে থাকি এবং সেগুলো বিক্রি করে ১টি সেলাই মেশিন ক্রয় করি। এক দিকে গ্রামে গ্রামে বিক্রি করি, অন্যদিকে অবসর সময়ে সেলাই মেশিনে বসে কাজ করি। কিছু টাকা দিয়ে দুটো গাভীও ক্রয় করেছি। সাথে সাথে আমার স্বামীও ভাল ব্যবসা করছে। এখন মাসে ১০-১২ হাজার টাকা আয় করি। পলাশতলা বাজারে জায়গা কিনে একটি দোকান নির্মাণ করেছি। আমার ছেলে দোকানটি পরিচালনা করছে। আমি এখন স্বাবলম্বী।শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে সাফল্য
আর্জনকারী নারী ঃ- শিল্পী রানী মাহাতো, পিতা- খগেন্দ্রনাথ মাহাতো, মাত- রেশমী বালা, সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ উপজেলায় ১নং ধামাই নগর ইউনিয়নের ফরিদপুর গ্রামের বাবার বাড়ি। সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ উপজেলার ২নং সোনাখাড়া ইউনিয়নের পশ্চিমে আটঘরিয়া গ্রামে বিয়ে হয়। শিল্পীল স্বপ্ন ছিল লেখা পড়া শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে এবং স্কুল শিক্ষিকা হবে। কিন্তু শিল্পীর স্বপ্নের বাধা হয়ে দাঁড়ায় তার পরিবার। বাবা মায়ের শখের বসে পরিবারের সিদ্ধান্তে ১২ বছর বয়সে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে থাকাকালীন অবস্থায় শিল্পীর বিয়ে হয়। শশুর বাড়িতে সারা দিন পরিশ্রমের পরেও শিল্পী পড়াশোনা চালিয়ে যায়। এভাবে সে এস,এস,সি পাশ করে। এর মধ্যে শিল্পীর কোলে আসে একটি কন্যা সন্তান। শশুর বাড়ীর অমতে সে কলেজে ভর্তি হয়। শশুর বাড়ির লোকজন শারীরিক ও মানসিরক অত্যাচার করা শুরু করে। শিল্পীর স্বামীও মদ্য পান করত, জুয়া খেলত এবং কোন কাজ করত না। মেয়েকে নিয়ে শিল্পী বাবা বাড়ি চলে আসে। কিন্তু বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় তাকে সাহায্যে করতে পারে না। শিল্পী ছোট একটা চাকুরী নিল ব্র্যাক স্কুলে। সেই সাথে বিভিন্ন আয় বর্ধনমূলক কর্মকান্ডও চালিয়ে যেতে থাকে। সেলাই মেশিন কেনে এবং পাশের গ্রামে গিয়ে সেলাই কাজ শেখে। স্বাধী গাড়ী চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হলে চিকিৎসা শিল্পীকেই করতে হয়। এতো প্রতিকুল অবস্থাতে শিল্পী ডিগ্রীতে ভর্তি হয়। শিল্পী বর্তমানে কাষ্টোমার সার্ভিস অ্যাসিসটেন্ট পদে ব্র্যাক অফিসে কর্মরত আছেন। ৭,৫০০/- টাকা বেতন পাচ্ছে। মেয়েকে সে উচ্চ শিক্ষিত করবে। শিল্পী তার মেয়ে এবং স্বামীকে নিয়ে এখন সুখে দিন কাটাচ্ছে।
সফল জননী নারী ঃ- সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ উপজেলার সোনাখাড়া ইউনিয়নের বাঁশাইল গ্রামে সুনতী রানী উরাও এর স্বামী- অনন্ত চন্দ্র উরাও এর বাড়ি। সুনতী কোন দিন স্কুলের চৌকাঠ পার হয়নি। অল্প বয়সে বিয়ে হয়। বিয়ের কিছু দিনে ৮ সন্তানের মা হন। সংসারে ২ জনের পরিশ্রমে সুখের সংসার ছিল। কিন্তু কিছু দিন পর তার স্বামী অসুস্থ্য (মৃগী রোগ) হয়। তখন তার স্বামী সংসারের কোন কাজ করতে পারত না। তখন তার ছেলে মেয়েরা ছোট ছিল। সংসারের ভার পরে সুনতীর উপর। সুনতীর জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। সংসারে লোক সংখ্যা বেশি, সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। এর মধ্যে বড় মেয়ের বিয়ে দেয়। শুধুমাত্র বাড়ির ভিটা ২৫ শতক। সুনতী দিনমজুরের কাজ করেন। স্বামীর সেবার পাশাপাশি ছেলে দুটির লেখা পড়া চালিয়ে যান। ছেলেরা টিউশনি করত। এত কষ্টের মাঝেও তিনি সন্তানদের লেখাপড়ার সুযোগ দেন। বছর আগে হঠাৎ সুনতির স্বামী মারা যান। সুনতির জীবনে আরও অন্ধকার নেমে আসে। তখন তার বড় ছেলে সবে মাত্র এনজিওতে চাকরি নেয়। এবং ছোট ছেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। সুনতি ও তার বড় ছেলে ছোট ছেলের পড়ার খরচ যোগায়। এর মধ্যে ছোট মেয়ের বিয়ে হয়। কঠিন সংগ্রামের মাঝেও সুনতি তার ছেলেদের পড়াশোনার ক্ষতি হতে দেয়নি। কিন্তু আজ সুনতির জীবন স্বার্থক হয়েছে। তার দুই ছেলে এনজিওতে চাকুরি করে। সুনতি বাড়িতে আয়মূলক কাজ কারে। সে বলে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছি এতেই আমি খুশি। আমার মত মায়েরা যেন তাদের সন্তানদের মানুষ করে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।
নির্যাতনের বিভিষিকা মুছে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করেছে যে নারী ঃ- সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জে ঘুড়কা ইউনিয়নের চকগোবিন্দপুর গ্রামের মেয়ে শাপলা। ছোট থেকেই তার বুকের ভিতর অনেক স্বপ্ন ছিল। লেখা পড়া শিখে একদিন সে বড় চাকরি করবে, পরিবারের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনবে, গ্রামের অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু হঠাৎ একদিন বিয়ে নামের শব্দ তার স্বপ্ন শেষ করে দেয়। ৮ম শ্রেণিতে পড়ার সময় (বয়স ১৩) তার বাবা-মায়ের পছন্দের ছেলের সাথে জোর করে বিয়ে দেয়। তার পড়া লেখা বন্ধ হয়ে যায়। সংসার পরিচালনা করা সে বুঝতে পারে না। স্বামী ও শাশুড়ির অত্যাচারে অতিষ্ট হয়। ১ বছর পর কোলে আসে প্রথম সন্তান। গুডনেইবারস এনজিওতে প্রশিক্ষণ নিয়ে টুকটাক সেলাই কাজ করে। ১৮ বছর অতিবাহিত করতেই ২য় সন্তানের মা হন। অর্থনৈতিক দৈন্যদশায় সংসারের প্রকোট অশান্তিতে শেষ পর্যন্ত সন্তানদের নিয়ে স্বামীর বাড়ি তাকে ছড়তে হয়।২০১৫ সালে গুডনাইবারস এনজিওতে ব্যাঙ্গল সুইং আইজি গ্রুপের একজন সদস্য এবং সহযোগী সুইং ট্রেইনার হিসেবে কাজ শুরু করে। বর্তমানে শাপলা খাতুন নিজে একটি সেলাই মেশিন ক্রয় করে বাড়িতে কাজ করে। এবং গুড নেইবারস এনজিওতে ব্যাঙ্গল সুইং আইজি গ্রুপের মাধ্যমে কাজ করে প্রতি মাসে ৭,০০০ টাকা আয় করে। স্বপ্ন পূরণে ভোকেশনালে ৯ম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে। তার ছেলে পলিটেকনিক কলেজে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়াশোনা করছে। মেয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। বর্তমানে ২জন সন্তানকে নিয়ে শাপলা ভালভাবে দিন অতিবাহিত করছে। সমাজ উন্নয়নে অদম্য অবদান রেখেছে যে নারী ঃ- সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ-৬৭২০ ডাকঘর এর তিননান্দিনা গ্রামে বাস করেন রোজিনা খাতুন। ৮ম শ্রেণিতে পড়ার সময় তার বিয়ে হয়। অল্প বয়সে কোলে আসে বাচ্চা। ছেলে মেয়েকে লালন পালন করতেই তার অনেক সময় কেটেছে। তিনি ২০১৪ সাল হতে গুডনেইবারস নলকা মহিলা সমবায় সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। তার দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে নলকা মহিলা সমবায় সমিতির মূলধন, ঋণ বিতরণের পরিমান, বিভিন্ন আয় বৃদ্ধিমূলক গ্রুপ গঠন ও সমিতির সদস্য সংখ্যা বাড়ায়। সমিতি পরিচালনা করে প্রতিমাসে ৭,৫০০ টাকা আয় করেন যা তার পরিবারের জন্য অনেক বড় সহায়তা হিসেবে কাজ করে। করোকালীন সময়ে ৩০০ জন হত দরিদ্র পরিবারের খাদ্য বিতরণ, ৪০০ পরিবারে নিরাপদ পানি ব্যবস্থাসহ সমাজের অসুস্থ, নিপীড়িত এবং অসহায়দের সহযোগীতা করছেন রোজিনা। নলকা ইউনিয়নের ২৫৫ জন নারীকে নিয়ে সমবায় সমিতি গঠন করেছেন। তাদের পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা আনায়নে বিভিন্ন গ্রুপে কাজ করছে। তার এই গতিশীল কাজের জন্য বিভিন্ন সময়ে সমবায় দিবসে নলকা সমবায় সমিতি থেকে শ্রেষ্ঠ সর্বোচ্চ সম্মাননা স্বারক পুরস্কার পেয়েছেন। অক্লান্ত পরিশ্রমেই রোজিনা সমাজে উন্নয়নে অবদান রাখছেন।

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD