কোভিড-১৯ তথা করোনার তান্ডবে কঠোর লকডাউনের কারণে সদ্য গত ৯ জুলাই ২০২১ সাপ্তাহিক চলনবিল বার্তার চতুর্থ বর্ষ পূর্তির অনুষ্ঠান আমরা উদযাপন করতে পারলাম না। গত বছরও একই দিনে একই পরিস্থিতিতে তৃতীয় বর্ষ পূতি উপলক্ষে সভা-সমাবেশ করা সম্ভব না হলেও পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। এবার লকডাউনে বগুড়ায় প্রেস বন্ধ থাকায় পত্রিকা প্রকাশও সম্ভব হল না। এ ব্যর্থতায় আমাদের অনুতাপ থাকলেও করোনার প্রভাবে দেশ-দুনিয়া সমানভাবে বিপর্যস্ত হওয়ার প্রেক্ষাপটে আমরা সেই মহাদুর্যোগে সংবেদনশীল ও সমব্যাথী। আর সেই অস্থীরতা ও অচলাবস্থার মধ্যে আমাদের অপারগতার সান্তনা নিহিত। দেশের অনেক সংবাদপত্র করোনাকালে আমাদের মতই দুর্দশার সম্মুখীন।
চলনবিল বার্তার পরিচিত সবারই মনে হয় স্মরণে আছে, ৯ জুলাই ২০১৭ বাংলা ২৫ আষাঢ় ১৪২৪ সালে এই পত্রিকার সর্ব প্রথম পথ চলা শুরু হয়। সেই হিসাবে এবার ৪র্থ বছর পেরিয়ে ৫ম বর্ষে পদার্পণ করল। যাত্রা আরম্ভ থেকে নানা সমস্যা-প্রতিকুলতা এমনকি বিগত দেড় বছরের করোনা অতিমারির মাঝেও পত্রিকাটির নিয়মিত প্রকাশনা প্রায় অব্যাহত ছিল। চলনবিল বার্তার সাফল্য- ব্যর্থতা সেভাবে মূল্যায়নের সময় বোধ হয় এখনো আসেনি। কারণ এটা সবে মাত্র পাঁচ বছরে পা ফেলেছে । যেখানে বিশে^র নামীদামী কাগজের বয়স শতবর্ষের বেশী। তবে একটা বিষয় বিশেষ লক্ষ্যনীয়, গণমাধ্যমের কোন নতুন মুখ যত কনিষ্ঠই হোক না কেন, সংগ্রাম ও চ্যালেঞ্জ মোকবেলা সবার জন্য প্রায় একই রকম। যেমন ধরুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কোন মামলা হলে তা বড় সংবাদপত্র কিংবা ছোট খবরের কাগজ যেটাই হোক না কেন, ঝুঁকিটা অভিন্ন এবং সমান নিপীড়নমূলক। তাতে জাতীয়-স্থানীয় বলে কোন পার্থক্য নেই। তাছাড়া চলনবিল বার্তার মত গ্রামীণ এলাকা থেকে প্রকাশিত ক্ষুদে পত্রিকার টিকে থাকার ক্ষেত্রে সমস্যা ও অন্তরায় অধিক ও ভিন্নতর।
কেননা এটা শিল্প- ব্যবসা-বানিজ্য নির্ভর কর্পোরেট সেক্টর অথবা রাজনৈতিক নেতৃত্বের কোন পৃষ্ঠপোষনা পায় না। গ্রাম এলাকায় জুটে না কোন বিজ্ঞাপনও। সে কারণে এর অস্তিত্ব এবং সক্রিয় গতিশীলতা নিয়ে আশংকায় থাকতে হয়। তাই টুকটাক ব্যক্তিগত সৌজন্যমূলক বিঞ্জাপন এবং আপন ভর্তুকীতে চলা সমাজসেবা, স্বেছাসেবা ও মানবসেবার মধ্যে আপাতত আমাদের আদর্শ নিহিত। বাণিজ্যিক স্বনির্ভরতার স্বপ্ন এখনও দিল্লী দূর অস্ত। আজকাল গণমাধ্যম অঙ্গনে নতুন আর একটা প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে, তাহল কাকের মাংস কাকে খাচ্ছে যা প্রচলিত প্রবাদের পরিপন্থী। অর্থাৎ সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকদের নিজেদের মধ্যে বৈরিতা ও এক অপরে আক্রমন-প্রতিআক্রমন। এটা তাদের সাংগঠনিক শক্তি এবং ঐক্য দুর্বল করে দিচ্ছে, বিভক্তি-বিভাজন প্রকট হচ্ছে। পাশাপাশি তাদের পেশাগত ভাবমূর্তি ও মর্যাদা ক্ষুন্ন হচ্ছে। এতে করে রাষ্ট্র, রাজনীতি, ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী শ্রেণি যারা সাধারণত গণমাধ্যমকে তাদের বিপক্ষ বলে মনে করে তারা এই সুযোগটা নিচ্ছে খুব ভালভাবে। ফলে রোজিনা ইসলামের মত প্রতিবাদী ও আদর্শ সংবাদকর্মীরা মার খায়, বিচার পায় না।
পরিণামে নানা কালাকানুনের চাপে দেশের সমগ্র গণমাধ্যমে বর্তমানে একটা মাজা ভাঙা ধরনের দুর্বলতা ও নিস্তেজ পরিবেশ বিরাজ করছে। কারণ তারা যা বলার তা বলতে পারে না , যা লেখার তা লিখতে পারে না। মূলত দেশে রাজনীতি, গণতন্ত্র ও সুশাসনের সংকট দেখা দিলে বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাও সংকুচিত হতে থাকে। মনে রাখতে হবে, মানুষের মৌলিক অধিকার, স্বাধিকার , মুক্ত চিন্তা ও স্বাধীনভাবে কথা বলার লক্ষ্যেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, এসেছিল মহান স্বাধীনতা। এখন সেই কাঙ্খিত মানবাধিকারের বিকাশ ও প্রসার হতে না দিয়ে তা বাধাগ্রস্থ করা স্বাধীনতার মূল চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক। আশা করি আগামীতে এ দুরাবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে। সবশেষে আমরা সকলের দোয়া চাই, সহযোগিতা কামনা করি, যেন আমরা আগামীতে সাপ্তাহিক চলনবিল বার্তাকে দৈনিকে উন্নীত করতে পারি। সেই সাথে মনুষ্যত্ব ও মানবতাকে প্রাধান্য দিয়ে আমরা যাতে ন্যায় ও সত্যের পথে অবিচল থেকে নির্ভয়ে কাজ করে যেতে পারি তেমনটিই একমাত্র প্রত্যাশা। আল্লাহ আমাদের সকলের সহায় হোন।