তাড়াশের আধুনিক “রাজনৈতিক আইকন” এর মহাপ্রয়াণ

Spread the love

তার জীবন এক সংগ্রামী জীবন পরিক্রমার জলন্ত প্রতীক। তার জীবন শুধু মুক্তিযুদ্ধে উৎসর্গিত, মহিমান্বিত হয়নি, গোটা জীবনই ছিল তার নানা চরাই-উৎরাইয়ের উত্তাল তরঙ্গ অভিঘাতে ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সাগরের অথৈ জলে টামাটাল তরীর মত। জীবনের শেষ মুহুর্তেও তিনি রাজনীতির জটিল ও কুটিল প্রতিযোগীতায় নিজেকে অজেয় ও উত্তীর্ণ রাখতে আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। জনপ্রিয়তা ও দলীয় কর্মী সমর্থনের সেই সর্বশেষ স্বাক্ষর রেখে গেলেন তাড়াশ উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতির পদে পূনরায় প্রত্যাবর্তন করে। তিনি ম. ম. আমজাদ হোসেন মিলন। তাড়াশ-রায়গঞ্জ-সলঙ্গার সাবেক সংসদ সদস্য, উপজেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি ও সম্পাদক, মাগুড়াবিনোদ ইউপির প্রাক্তন চেয়ারম্যান, সাবেক তাড়াশ উপজেলা চেয়ারম্যান,পলাশডাঙ্গা যুবশিবিরের সহ সর্বাধিনায়ক এবং তাড়াশ ডিগ্রি কলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সহ তাড়াশের অনেক শিক্ষা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান এবং উন্নয়ন কর্মকান্ডের সাথে ওতপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে তার নাম। সেই হেতু তাকে অন্যকথায় তাড়াশের রাজনৈতিক কিংবদন্তী কিংবা আইকন বললে ভুল হবে না। সদাহাসিমুখের আকর্ষণীয় প্রীতির জাল ফেলে সহসাই তিনি মানুষকে কাছে টানতে পারতেন।
উল্লেখ. ম. ম. আমজাদ হোসেন মিলন ১৮ এপ্রিল ২০২১ সকাল ১১টায় সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর খাজা ইউনুছ আলী মেডিকেল কলেজ-হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭২ বছর। তার তিরোধানের সাথে সাথে তাড়াশের রাজনৈতিক দিগন্তের এক উজ্জল নক্ষত্র অস্তমিত হল। কেননা, রাজনীতি, সমাজসেবা, মুক্তিযুদ্ধ ও বর্ষীয়ান পার্লামেন্টারিয়ান সব মিলে তার ছিল এক বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন। যা সমকালীন তাড়াশের ইতিহাসে বিরল। অর্থাৎ তাড়াশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি নিজেই হয়ে উঠেছিলেন এক জীবন্ত ইতিহাস। এম. সেরাজুল হকের পরবর্তী প্রজন্মের সাড়িতে তাড়াশে মিলনের মত ক্ষুরধার অভিজ্ঞ ও দক্ষ রাজনীতিবিদের আবির্ভাব আর দেখা যায় নি। অবশ্য মুখে সোনার চামচ নিয়ে জন্ম নেন নি আমজাদ হোসেন মিলন। তার পিতা মরহুম আব্দুর রহমান বিনোদী ব্রিটিশ বিরোধী চারণ কবি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হলেও সেকালে তাদের পরিবার ছিল দরিদ্র ও অসচ্ছল। পিতার একমাত্র সন্তান হিসেবে অভাব অনটন সত্বেও মিলন লেখাপড়ায় এগিয়ে যান। তিনি ছিলেন ¯œাতকোত্তীর্ণ। ছাত্র জীবন থেকেই প্রগতিশীল রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ৬৫’র আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, ৬৯ এর গণ আন্দোলন এবং ৭১’র মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নিয়ে তিনি এলাকার জন প্রতিনিধিত্বে ও সেই সাথে শীর্ষ দলীয় নেতৃত্বে দীর্ঘকাল সাফল্যের পরিচয় দেন। তারই ধারাবাহিকতায় ও কৃতিত্বের নজির হিসেবে তিনি তাড়াশ-রায়গঞ্জের স্বনামধন্য সংসদ সদস্য হিসেবে জায়গা করে নেন। মৃত্যুর অল্প কিছুদিন পূর্বে তিনি তাড়াশ উপজেলা আ’লীগের সভাপতি পদে পূনঃ নির্বাচিত হয়েছিলেন। বেঁচে থাকলে তিনি আবারো ৬৪ সিরাজগঞ্জ-৩ আসনের পরবর্তী সংসদ সদস্য হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যোগ্যতা ও সামর্থ রাখতেন তা অনেকেই বিশ^াস করেন। কারণ এই সংসদীয় এলাকায় মিলনের মত চৌকষ ও প্রাজ্ঞ রাজনীতিকের আজও শুন্যতা রয়েছে যা ভবিষ্যতে কবে পূরণ হবে তা কেউ বলতে পারে না। বিশেষত রাজনৈতিক অঙ্গনে তার উদয় তৃণমূল থেকে। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক রাজনৈতিক কেরিয়ারের অধিকারী। রাজনীতিতে তার জ্ঞানগভীরতা সবাইকে মুগ্ধ করতো। মঞ্চে ও জনসভায় তার দরাজ গম্ভীর কন্ঠের বক্তৃতা ও ভাষণ এক স্বতন্ত্র আবহ তৈরী করতো যা স্থানীয় রাজনীতিকদের মাঝে ব্যতিক্রম। পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের সহ সর্বাধিনায়ক মর্যাদায় তাড়াশের নওগাঁ মুক্তিযুদ্ধে তার ঐতিহাসিক অবদান অবিস্মরণীয়। এক্ষেত্রে তিনি জাতীয়ভাবে সরকার কর্তৃক খেতাব প্রাপ্তির যোগ্য ছিলেন। মিলন ছিলেন গোবরে পদ্মফুল। চলনবিলের সামান্য একটি গ্রামীণ পরিবার থেকে উঠে এসে এক অসামান্য ইতিহাস সৃষ্টি করলেন তিনি তাড়াশের বুকে। একদা সাপ্তাহিক চলনবিল বার্তার সাথে তার এক একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, একবার তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে পুলিশে চাকুরীর জন্য সুপারিশ চেয়েছিলেন। প্রতিক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, তুই যদি চাকুরী করবি তো তোর এলাকার মানুষের নেতৃত্ব দেবে কে। তুই ফিরে গিয়ে দলের জন্য কাজ করে যাবি। তাই প্রথমেই বলছিলাম এম সেরাজুল হক উত্তরকালে তাড়াশে মিলনের মত বৈচিত্র্যময় ও বর্ণাঢ্য রাজনীতিক ও সমাজসেবক এখনও আমাদের সামনে দ্বিতীয়টি নেই। আবার তার পরিবারের আপনজনদের মধ্য থেকেও কেউ তার রাজনৈতিক গুন-বৈশিষ্টের উত্তরাধিকার সেভাবে অর্জন করতে পারেন নি। সেই দৃষ্টিকোনে তার অন্তর্ধানে তাড়াশের এক রাজনৈতিক ইতিহাসের যবনিকাপাত ঘটলো যা পূরণ হতে হয়তো সময় লাগবে এবং অপেক্ষা করতে হবে দীর্ঘদিন। তিনি আমাদের গর্ব বটে। আমরা মরহুমের আত্মার চির শান্তি কামনা করি।

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD