মাহে রমজানের ফজিলত ও জরুরি প্রাসঙ্গিক মাসয়ালা

Spread the love

মুফতি খোন্দকার ক্বারী মাওলানা মুহাম্মদ আমিনুল ইসলাম আবদুল্লাহ

রোজা এমন একটি ইবাদত যা সরাসরি দেখা যায় না। কোনো ব্যক্তি হজ পালন করলে সেটা দৃশ্যমান হয়। নামাজ আদায় করলে দৃশ্যমান হয়। কিন্তু কেউ রোজা পালন করলে সরাসরি দেখা যায় না । যদি ওই ব্যক্তি না বলেন যে, আমি রোজাদার। পবিত্র কুরআন রমজান মাসে অবতীর্ণ হয়েছে। বদরের যুদ্ধ রমজান মাসেই সঙ্ঘটিত হয়েছিল। তাই রমজানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অন্যান্য মাসের তুলনায় অনেক বেশি। তা ছাড়া এ মাসের মধ্যে এমন একটি রাত আছে। যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম।
রোজার অর্থ : রোজা ফারসি শব্দ। এর অর্থ বিরত থাকা। আরবি ভাষায় রোজাকে সাওম বলা হয়। সাওম-এর শাব্দিক অর্থ হলো বিরত থাকা, উপবাস থাকা, অনশনে থাকা, আত্মসংযম পালন করা ইত্যাদি। রোজার সংজ্ঞা : ইসলামী পরিভাষায় মহান আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কোনো প্রকার পানাহার ও দৈহিক যৌন তৃপ্তি থেকে বিরত থাকাকে সাওম বা রোজা বলে। রোজা একটি মৌলিক ইবাদত । ইসলামের মৌলিক পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে সাওম অন্যতম। মৌলিক ইবাদতগুলোর মধ্যে ঈমান ও সালাতের পরেই সাওম বা রোজার স্থান। অর্থাৎ সাওম ইসলামের রোকনগুলোর মধ্যে তৃতীয় রোকন। প্রাপ্ত বয়স্ক প্রত্যেক নর-নারী হোক ধনী-দরিদ্র, ফকির, মিসকিন সব মুসলমানের ওপর সাওম একটি ফরজ বা অবশ্য পালনীয় ইবাদত। রমজানের রোজা ফরজ : ঈমানদার ব্যক্তিদের ওপর রমজানের রোজা ফরজ করা হয়েছে। পূর্ববর্তী উম্মতদের ওপরও রোজা ফরজ করা হয়েছিল। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে করে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো ( সূরা বাকারাহ: ১৮৩)।
সাওমের শিক্ষা : সাওম পালনের মাধ্যমে রোজাদারের আত্মিক উন্নতি ও মানসিক উৎকর্ষ সাধিত হয়। অন্তরে তাকওয়া জাগ্রত হয় ও আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। সাওম পালনকারী ‘রাইয়ান’ নামক দরজা দিয়ে বেহেশতে প্রবেশ করবে। হজরত সাহাল ইবনে সায়াদ রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেছেন : বেহেশতের আটটি দরজা আছে। তার মধ্যে একটি দরজার নাম ‘রাইয়ান’। ওই বিশেষ দরজা দিয়ে শুধু রোজাদার ব্যক্তিরাই বেহেশতে প্রবেশ করবে (সহিহ আল বুখারি ও মুসলিম)। সহনশীলতা অর্জন : সহনশীল মানুষকে আল্লাহতায়ালা খুব পছন্দ করেন ও ভালোবাসেন। সাওম পালনের মাধ্যমে ঈমানদার ব্যক্তি মহান আল্লাহতায়ালার সান্নিধ্য অর্জনের চেষ্টা করেন। তাই তিনি বিপদে-আপদে ও মুসিবতের সময় বেশি বেশি ধৈর্য ও সহনশীল মনোভাবের অভ্যাস গড়ে তুলতে সক্ষম হন। আত্মশুদ্ধি অর্জন : সিয়াম সাধনার মাধ্যমে একজন রোজাদার নিজের মধ্যে আত্মসমালোচনার অভ্যাস গড়ে তোলেন। কাজেই নিজেই নিজের ভুলত্রুটি সংশোধনের মাধ্যমে নিজেকে পরিশুদ্ধ করার চেষ্টা করেন। ফলে তিনি আত্মশুদ্ধি অর্জনে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলে করিম সা: ঘোষণা করেছেন; যে লোক ঈমান ও ইহতেসাবের সাথে রমজানের রোজা পালন করবে তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে (বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ ও মুসনাদে আহমাদ)।
হিংসাবিদ্বেষ বর্জন : মানুষ লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, ক্ষোভ ও কামভাবের বশবর্তী হয়ে অনেক অপকর্মে লিপ্ত হয়। সাওম মানুষকে এসব খারাপ কাজ থেকে মুক্ত থাকতে শিক্ষা দেয়। সাওম মানুষকে হিংসা ও বিদ্বেষ থেকে বাঁচারও শিক্ষা দিয়ে থাকে। রোজা ঢালস্বরূপ : ঢাল হচ্ছে আত্মার বাহন। ঢাল যেমন মানুষকে বিপদের মুহূর্তে আত্মরক্ষা করে, তেমনি রোজা জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করে। অর্থাৎ রোজা হচ্ছে ঢালস্বরূপ। নবী করিম সা: বলেছেন, আসসিয়ামু জুন্নাতুন। অর্থাৎ ‘রোজা ঢালস্বরূপ’ (বুখারি ও মুসলিম)। দরিদ্রের প্রতি দানশীলতা : রোজা মানুষকে দানশীল হতে শিক্ষা দেয়। রমজান মাসে রাসূল সা: দরিদ্র ও অসহায় মানুষের দান-সদকা করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি নিজেও দান-সদকা করেছেন। হজরত ইবনে আব্বাস রা: বলেন, রাসূল সা: লোকদের মধ্যে অধিক দানশীল ছিলেন। বিশেষ করে রমজান মাস এলে তাঁর দানশীলতা অনেক বেড়ে যেত (বুখারি ও মুসলিম)। সুতরাং সহিহ হাদিস অনুযায়ী আমরা পরিষ্কার উপলব্ধি করতে পারি যে, সাওম অসহায় ও দরিদ্রকে দান করতে উদ্বুদ্ধ করে।
সাওমের প্রতিদান : সব সৎ কাজের প্রতিদান আল্লাহতায়ালা ১০ থেকে ৭০ গুণ পর্যন্ত বর্ধিত করে দেবেন। কিন্তু রোজার প্রতিদান আল্লাহ নিজ হাতে বান্দাকে দেবেন। সাওমের প্রতিদান সম্পর্কে হাদিসে কুদসিতে ান আল্লাহতায়ালা বলেন, আসসিয়ামুলি ওয়া আনা উজ্যিবিহি অর্থাৎ ‘সাওম আমার জন্য এবং আমি নিজেই এর প্রতিদান দেবো (সহিহ আল বুখারি)।
অশ্লীলতা পরিহার : আমাদের সমাজে প্রতিনিয়ত অশ্লীলতা ও অসামাজিক কার্যকলাপের সয়লাব বয়ে যাচ্ছে। সাওম পালনকারী ব্যক্তি এসব অন্যায় ও অশ্লীলতা পরিহার করে চলে। হানাহানি থেকে দূরে থাকে। অন্যের ক্ষিত করা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করে। চোগলখোরি ,গিবত ও পরনিন্দা থেকে দূরে থাকে। পরশ্রীকাতর মনোভাব পরিত্যাগ করে। ফলে সমাজে ও রাষ্ট্রে শান্তি বিরাজ করে। মিথ্যা পরিত্যাগ : মিথ্যা হচ্ছে সব পাপ কর্মের মূল। একজন রোজাদার ব্যক্তি রোজা রাখা অবস্থায় মিথ্যা কথা বলা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করে। ফলে সে নিজেকে একজন সত্যবাদী মুমিন হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ পায় এবং মিথ্যা কথা ও কাজ পরিত্যাগ করার গৌরব অর্জন করতে সম হয়। হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, নবী করিম সা: বলেছেন, যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলা ও মিথ্যা কাজ পরিত্যাগ করতে পারল না, তার খানাপিনা ত্যাগ করায় আল্লাহর কোনোই প্রয়োজন নেই (সহিহ আল বুখারি)। পরিশেষে বলা যায়, মহান আল্লাহতায়ালার নৈকট্য হাসিলের প্রত্যাশায় এবং তাকওয়া অর্জনের উদ্দেশ্যে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক নারী ও পুরুষের নিষ্ঠার সাথে সাওম পালন করা অবশ্য কর্তব্য।

রোজা ভঙ্গের কারণসমূহ
যেসব কারণে রোযার কাযা ও কাফফারা উভয়টি জরুরী হয়ে পড়ে:
১. রোযা রেখে কোনো প্রকার শরীয়তসম্মত ওযর ছাড়া ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার করলে কাযা ও কাফফারা উভয়ট জরুরি হবে। এক ব্যক্তি রমযানে রোযা রেখে (ইচ্ছাকৃতভাবে) পানাহার করল। তখন রাসূলুল্লাহ সা: তাকে আদেশ করলেন, যেন একটি দাস আযাদ করে বা দুই মাস রোযা রাখে বা ষাট মিসকীনকে খানা খাওয়ায়। (সুনানে দারে কুতনী ২/১৯১) । ইমাম যুহরী রাহ. বলেন, ‘রমযানে রোযা রেখে যে ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার করবে তার হুকুম ইচ্ছাকৃতভাবে দিনে সহবাসকারীর অনুরূপ।’ অর্থাৎ তাকে কাযা ও কাফফারা উভয়টি আদায় করতে হবে। (মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক, হাদীস : ৭৪৬৮)। ২. রমযানে রোযা রেখে দিনে স্ত্রী সহবাস করলে বীর্যপাত না হলেও স্বামী-স্ত্রী উভয়ের উপর কাযা ও কাফফারা জরুরি হবে। একটি দীর্ঘ হাদীসে আছে, এক ব্যক্তি মহানবী সা. -এর নিকট এসে বলল, আমি রোযা রেখে স্ত্রী সহবাস করেছি। রাসূলুল্লাহ সা: তার উপর কাফফারা আবশ্যক করেছিলেন।( দেখুন : সহীহ বুখারী ৬৭০৯; জামে তিরমিযী ৭২৪; মুসান্নাফ আবদুর রযযাক ৭৪৫৭; মুসনাদে আহমদ ২/২৪১) মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব রা. বলেন রাসূলুল্লাহ সা: ঐ ব্যক্তিকে (যে স্ত্রীসহবাসে লিপ্ত হয়েছিল) কাফফারা আদায়ের সাথে কাযা আদায়েরও আদেশ করেছিলেন। (মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৭৪৬১) বিখ্যাত তাবেয়ী আতা রাহ. বলেন, ‘স্বামী-স্ত্রী যখন মিলিত হয় তখন তাদের রোযা ভেঙ্গে যায়।’ (প্রাগুক্ত ৭৪৬৭) । ৩. বিড়ি-সিগারেট, হুক্কা পান করলেও রোযা ভেঙ্গে যাবে এবং কাযা ও কাফফারা উভয়টি জরুরি হবে। ৪. সুবহে সাদিক হয়ে গেছে জানা সত্ত্বেও আযান শোনা যায়নি বা এখনো ভালোভাবে আলো ছড়ায়নি এ ধরনের ভিত্তিহীন অজুহাতে খানাপিনা করা বা স্ত্রী সহবাসে লিপ্ত হওয়া হারাম। এতে রোযা সহীহ হবে না। আর যদি রোযার নিয়ত করার পর কেউ এমনটি করে থাকে তাহলে কাযা-কাফফারা দু’ টোই জরুরি হবে। (সূরা বাকারা : ১৮৭; মাআরিফুল কুরআন ১/৪৫৪-৪৫৫)।
(লেখক : সাবেক সম্পাদক : অনলাইন নিউজ পোর্টাল বিডি নিউজ পোর্টাল বিডি নিউজ ২৬।সচিব দাওয়াহ : কুরআন মজলিস বাংলাদেশ ।সদস্য : জাতীয় মুফাসসির পরিষদ বগুড়া জেলা ।)

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD