|
সদকায় ফিতর এবং যাকাতের ধর্মীয় ও সামাজিক গুরুত্ব :
মুফতি খোন্দকার ক্বারী মাওলানা মুহাম্মদ আমিনুল ইসলাম আবদুল্লাহ
হযরত আবদুল্লাহ ইবনু ওমর থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল বলেছেন ইসলাম ৫টি বিষয়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত। যথা – এ সাক্ষ্য দেওয়া যে ১. আল্লাহ তা’আলা ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল, ২. সালাত কায়েম করা, ৩. যাকাত প্রদান করা, ৪. রামাযানে রোযা রাখা এবং ৫. হজ করা। ’ [আস-সহীহ আল-বুখারী, ১/১১, হাদিস:৮]
সদকায় ফিরত কী ?
সদকা অর্থ দান, ফিতর মানে রোজা সমাপন; সদকাতুল ফিতর অর্থ হলো রোজা শেষে ঈদুল ফিতরের দিনে সকালবেলায় শোকরিয়া ও আনন্দস্বরূপ যে নির্ধারিত সদকা আদায় করা হয়। এর দ্বারা রোজার ত্রুটিবিচ্যুতি মার্জনা হয়। গরিব মানুষ ঈদের আনন্দে শামিল হতে পারে। এই সদকা ঈদের নামাজের আগেই আদায় করতে হয়; সময়–সুযোগ না পেলে পরে হলেও আদায় করতে হবে। অনেকেই ঈদের আগে তথা রমজানেই আদায় করে থাকেন; এতেও কোনো অসুবিধা নেই; বরং এর দ্বারা গ্রহণকারী তা ঈদ উদ্যাপনে কাজে লাগাতে পারে।
কারা ফিতরা দেবেন, কাদের দেবেন?
ঈদের দিন সকালবেলায় যিনি সাহেবে নিসাব থাকবেন, তাঁর নিজের ও পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব। ছোট-বড় সবারই ফিতরা দিতে হবে। যাঁরা সাহিবে নিসাব নন, তাঁদের জন্যও ফিতরা আদায় করা সুন্নত ও নফল ইবাদত। অসহায় গরিব, ফকির, মিসকিন যারা জাকাত পাওয়ার যোগ্য, তারাই ফিতরার হকদার। ফিতরা নির্ধারিত খাদ্যসামগ্রী বা তার মূল্যে টাকায়ও আদায় করা যায় এবং অন্য কোনো বস্তু কিনেও দেওয়া যায়।
সদকাতুল ফিতরের ইতিহাস
আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, নবীজি (সা.)-এর জমানায় আমরা সদকাতুল ফিতর দিতাম এক সা (প্রায় সাড়ে তিন কেজি) খাদ্যবস্তু, তিনি বলেন, তখন আমাদের খাদ্য ছিল: যব, কিশমিশ, পনির ও খেজুর। (বুখারি, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ২০৪)। তিনি আরও বলেন: আমরা সদকাতুল ফিতর আদায় করতাম এক সা খাদ্যবস্তু বা (১) এক সা যব বা (২) এক সা খেজুর বা (৩) এক সা পনির অথবা (৪) এক সা কিশমিশ। (বুখারি, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ২০৫)।
সাহাবায়ে কিরামদের (রা.) অধিকাংশই খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় করতেন। ইবনে কুদামা (রা.) আবু মিজলাজের বর্ণনা উল্লেখ করে বলেন, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে উমরকে (রা.) বললেন, ‘আল্লাহ তাআলা যখন প্রাচুর্য দিয়েছেন আর গম যেহেতু খেজুর অপেক্ষা উত্তম, তবুও আপনি খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় করছেন কেন?’ এর উত্তরে তিনি বলেছেন, ‘সাহাবিরা যে পথে চলেছেন আমিও সে পথে চলা পছন্দ করি।’
কীভাবে নিসফ সা (পৌনে দুই কেজি) প্রচলন হলো
নবী করিম (সা.)-এর যুগে মদিনায় গমের প্রচলন ছিল না বললেই চলে। পরবর্তী সময়ে যখন হজরত ওমর (রা.) খলিফা ও হজরত মুআবিয়া (রা.) শামের গভর্নর তখন মদিনায় গমের প্রচলন হয়। এ সময় হজরত মুআবিয়া (রা.)-এর ব্যাখ্যা ও খলিফা হজরত উমর (রা.)-এর নির্দেশে গম দ্বারা ফিতরা আদায়ের নিয়ম প্রবর্তন করা হয়। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন আমাদের মাঝে ছিলেন তখন আমরা ছোট, বড়, মুক্ত ক্রীতদাস সবার পক্ষ থেকে সদকাতুল ফিতর আদায় করতাম এক সা পনির বা এক সা যব বা এক সা খেজুর অথবা এক সা কিশমিশ। আমরা এভাবেই আদায় করছিলাম। একবার মুআবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান (রা.) হজ বা ওমরাহ করার জন্য এলেন, তিনি জনগণের উদ্দেশে মিম্বারে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিলেন। তখন তিনি বললেন, আমি দেখছি শামের দুই মুদ (নিসফ সা বা পৌনে দুই কেজি) আটা সমান হয় (মূল্যমান হিসেবে) এক সা খেজুরের। অতঃপর মানুষ এই মত গ্রহণ করলেন।
চার মাজহাবের ইমামদের মতামত
ইমাম আজম আবু হানিফা (রা.)-এর মতে, সদকাতুল ফিতর যেকোনো খাদ্যবস্তু এক সা; তবে গম হলে নিসফ সা। ইমাম মালিক (রা.), ইমাম শাফিয়ি (রা.) ও ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রা.)-এর মতে, সদকাতুল ফিতর এক সা পরিমাণ যেকোনো খাদ্যবস্তু।
ইমাম আজম আবু হানিফা (রা.)-এর মতে, বেশি মূল্যের দ্রব্য দ্বারা ফিতরা আদায় করা অতি উত্তম; অর্থাৎ যা দ্বারা আদায় করলে গরিবদের বেশি উপকার হয়, সেটাই উত্তম ফিতরা। ইমাম মালিক (রা.)-এর মতে, খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় করা উত্তম। ইমাম শাফিয়ি (রা.)–এর মতে, হাদিসে উল্লিখিত বস্তুসমূহের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বোচ্চ মূল্যের দ্রব্য দ্বারা সদকা আদায় করা উচিত। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রা.)-এর মতে, সাহাবায়ে কিরাম (রা.)-এর অনুসরণ হিসেবে খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় করা উত্তম।
কোনো কোনো ফকিহ মনে করেন, যেকোনো খাদ্যদ্রব্য দ্বারা ফিতরা আদায় করা যায় এবং যেখানে যা প্রধান খাদ্য তা দ্বারা আদায় করাই শ্রেয়। অনেক গবেষক ফকিহ মনে করেন, বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য চাল, তাই আমাদের সদকাতুল ফিতর এক সা চাল হতে পারে। মুজতাহিদ ইমামদের মতে, যেসব খাদ্যবস্তু ১. সহজে সংরক্ষণযোগ্য, ২. সহজে বিনিময়যোগ্য ও ৩. বাজারমূল্য স্থিতিশীল থাকে; সেসব খাদ্যদ্রব্য দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করা যায়।
উত্তম ও ইনসাফপূর্ণ ফিতরা
খেজুর বা চাল বিভিন্ন দামের রয়েছে, এর মধ্যে কোনটি দ্বারা ফিতরা আদায় করা হবে? আসলে উত্তম হলো সর্বোচ্চ মূল্যের খেজুর বা চাল আদায় করা। তবে ধনীদের সর্বোচ্চ এবং সাধারণ মানুষদের মাঝামাঝি মূল্যে আদায় করাই শ্রেয়। ইনসাফ হলো যাঁরা যে চালের ভাত খান বা যাঁরা যে খেজুর দ্বারা ইফতার করেন, তাঁরা সে সমমানের বা সমমূল্যে ফিতরা আদায় করবেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ‘তা-ই উত্তম, দাতার কাছে যা সর্বোৎকৃষ্ট এবং যার মূল্যমান সবচেয়ে বেশি।’ (বুখারি, খণ্ড: ৩, পৃষ্ঠা: ১৮৮)।
যাকাতের আর্থ-সামাজিক গুরুত্ব
যাকাতের সামাজিক গুরুত্ব নিম্নরূপ:
১. ধনী দরিদ্রের বৈষম্য দূর করে:
যাকাত ধনী দরিদ্রের মাঝে বৈষম্য দূর করে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ সৃষ্টি করে। যাকাত দরিদ্রের প্রতি ধনীর করুণা নয়, বরং ধনীর সম্পদে দরিদ্রের অধিকার। যেমন- আল্লাহর বাণী:
এবং তাদের ধন সম্পদে প্রাথ ও বঞ্চিতের হক আছে।
২. সামাজিক নিরাপত্তা বিধান:
সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের ক্ষেত্রে যাকাতের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। সমাজের যে সকল লোক অর্থ উপার্জনে অক্ষম এবং সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় বাস করে, যাকাত ব্যবস্থা তা দূরীকরণে অনন্য ভূমিকা রাখে।
৩. অভাব-অনটন বিমোচন: অভাব-অনটন বিমোচনে যাকাত ব্যবস্থা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সমাজের ধনী শ্রেণী যদি সঠিকভাবে যাকাত প্রদান করে তাহলে সমাজে কোনো অভাবী মানুষের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না।
৪. সামাজিক অনাচার নির্মূল:
অর্থের অভাবে মানুষ সামাজিক অনাচার তথা চুরি, ডাকাতি, খুন,
রাহাজানি, ছিনতাই ও সন্ত্রাস ইত্যাদি অপরাধে লিপ্ত হয়ে পড়ে। ভেঙে পড়ে সামাজিক অবকাঠামো। যাকাত ব্যবস্থা এসব সামাজিক অনাচার নির্মূলে অনন্য ভূমিকা পালন করে।
৫. ভ্রাতৃত্ববোধ জাগরণ: যাকাত মানুষের মধ্যে বিশেষ করে ধনী-
দরিদ্রের মাঝে এক গভীরতম ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি করে।
৬. সহানুভূতি সৃষ্টি: যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে ধনীদের অন্তরে দরিদ্রদের প্রতি চরম সহানুভূতি সৃষ্টি হয়। ধনীরা দরিদ্রের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এগিয়ে আসে।
৭. জনহিতকর কার্যাবলি: যাকাতের অর্থ সংগ্রহ করে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে সমাজের অসংখ্য জনহিতকর কার্যাবলি সম্পাদন করা যায়।
৮. ভিক্ষাবৃত্তিক উচ্ছেদ:
ভিক্ষাবৃত্তি একটি সামাজিক ব্যাধি। যাকাতের অর্থ দিয়ে দরিদ্র কল্যাণ ও দরিদ্রের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে ভিক্ষাবৃত্তি নির্মূল করা যায়।
যাকাতের অর্থনৈতিক গুরুত্ব
অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে যাকাতের গুরুত্ব অপরিসীম। যা নিম্নে তুলে ধরা হল:
১. ইসলামি অর্থনীতির মূল ভিত্তি:
যাকাত ইসলামি অর্থনীতির মূল ভিত্তি। পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থার মূলভিত্তি। যেমন – সুদ,
সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার মূল ভিত্তি যেমন জাতীয়করণে তেমনি ইসলামি অর্থ ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হলো যাকাত।
২. রাষ্ট্রীয় আয়ের প্রধান উৎস:
ইসলামি রাষ্ট্রের আয়ের প্রধান উৎস যাকাত। ইসলামি রাষ্ট্রের সিংহভাগ অর্থই যাকাত থেকে সংগৃহীত হয়ে থাকে।
৩. জাতীয় আয় বৃদ্ধি: যাকাত ইসলামি রাষ্ট্রের জাতীয় আয়কে বৃদ্ধি করে। রাষ্ট্রের অন্যান্য আয়ের সাথে যাকাতের অর্থ একত্রিত হয়ে জাতীয় আয় বহুলাংশে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়।
৪. অর্থনৈতিক ভিত্তিকে সুদৃঢ় করে:
কোনো রাষ্ট্রকে উন্নতি ও অগ্রগতির মূলে রয়েছে সুদৃঢ় অর্থনৈতিক ভিত্তি। যাকাত ইসলামি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে সুদৃঢ় করে।
৫. অর্থনৈতিক ভারসাম্য সৃষ্টি:
রাষ্ট্রে ধনী-দরিদ্রের মাঝে যে বিশাল ব্যবধান রয়েছে। যাকাত ব্যবস্থা যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে তা নিরসন করে ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ অর্থ ব্যবস্থা গড়ে তোলে।
৬. অর্থনৈতিক বন্ধ্যাত্ব দূরীকরণ:
যাকাত অর্থনৈতিক বন্ধ্যাত্ব দূরীকরণের মহৌষধ। কেননা যাকাত ব্যবস্থার কারণে বিত্তশালীদের অর্থ এক স্থানে সঞ্চিত থাকতে পারে না। সম্পদ সমাজের দরিদ্রদের মাঝে আবর্তিত হতে থাকে।
৭. দারিদ্র্য বিমোচন: দারিদ্র্য বিমোচনে যাকাতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সঠিকভাবে যাকাতের অর্থ দরিদ্রদের মাঝে বণ্টন করলে সমাজ থেকে দারিদ্র্য দূর হতে বাধ্য।
৮. ঋণমুক্তি: যাকাতের অর্থ দ্বারা ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রকে ঋণমুক্ত করা যায়।
৯. চাকরির সুযোগ: রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় যাকাত উত্তোলন ও বিতরণের ব্যবস্থা করলে যাকাত বিভাগে অসংখ্য লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
১০. পুঁজিবাদের অবসান: যাকাত ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে পুঁজিবাদের অভিশাপ থেকে জাতি মুক্তি পাবে। ইসলামি অর্থ ব্যবস্থার এ মূলনীতিকে সামনে রেখেই আল্লাহর ঘোষণা:
যাতে ধনৈশ্বর্য কেবল তোমাদের বিত্তশালীদের মধ্যেই পুঞ্জিভূত না হয়।
১১. বেকারত্ব দূরীকরণ: বেকার জীবন অভিশপ্ত জীবন। ইসলামের যাকাত ব্যবস্থা সমাজ থেকে বেকারত্ব দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যাকাতের অর্থ দিয়ে বেকার লোকদের কোনো না কোনো কাজের ব্যবস্থা করা যায়।
১২. অর্থনৈতিক প্রতারণা বন্ধ :
যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষের মাঝে প্রচলিত অর্থনৈতিক প্রতারণা বন্ধ করা যায়। আধুনিক কর ব্যবস্থায় ফাঁকির প্রবণতা থাকলেও যাকাত ব্যবস্থায় ফাঁকি অকল্পনীয়। কেননা বিত্তশালীরা একান্তই ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে আল্লাহর নির্দেশ পালনের লক্ষ্যে স্বেচ্ছায় যাকাত দিয়ে থাকে।
১৩. কর্মসংস্থানের সৃষ্টি: যাকাতের অর্থ একত্রিত করে শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অনেক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়।
১৪. সমবায় সমিতি গঠন: যাকাতের অর্থ একত্রিত করে দরিদ্র জনসাধারণের মাঝে যদি সমবায় সমিতি গঠন করা যায়, তাহলে এর মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক উন্নতি সাধন করতে পারে।
১৫. তারা বলে, কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে আমরা তোমাদেরকে আহার্য দান করি এবং তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা কামনা করি না’। [সূরা আল-ইনসান ৭৬: ৯]
৩. আর্থিক ইবাদত: যাকাত হলো ইসলামের আর্থিক ইবাদত। কারণ অর্থ সম্পদের নির্দিষ্ট একটা অংশ আল্লাহর রাস্তায় নিঃশর্তভাবে দান করার নামই যাকাত।
৪. জাহান্নাম থেকে মুক্তির উপায়: যাকাত জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণের অন্যতম উপায়। কেননা যাকাত প্রদান না করলে পরকালে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে।
৫. তাকওয়ার গুণ অর্জন: যাকাত আদায়ের মাধ্যমে তাকওয়ার গুণ অর্জিত হয়। কেননা মুসলমানগণ একমাত্র আল্লাহর ভয় এবং নির্দেশের প্রতি সম্মান দেখিয়েই নিজের কষ্টার্জিত সম্পদের নির্দিষ্ট অংশ আল্লাহর রাস্তায় দান করে। আর আল্লাহকে ভয় করে কোনো কাজ করার নামই তাকওয়া।
৬. আত্মিক শান্তি লাভ: ভোগে সুখ নেই, ত্যাগেই প্রকৃত সুখ। আল্লাহর হুকুম ও তাঁর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আর্থিক ত্যাগের মধ্যেই রয়েছে আত্মিক প্রশান্তি।
৭. সফলতার চাবিকাঠি: যাকাত আদায়ের মাধ্যমে ব্যক্তি ইহকাল ও পরকালে সফলতা লাভ করতে পারে। মহান আল্লাহর বাণী: মুমিনগণ সফলকাম হয়ে গেছে, যারা নিজেদের নামাযে বিনয় নম্ন; যারা অনর্থক কথাবার্তায় নির্লিপ্ত, যারা যাকাত দান করে থাকে এবং যারা নিজেদের যৌনাঙ্গকে সংযত রাখে। [সূরা আল-মুমিনুন ২৩:১-৪]
৮. ঈমানী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ: মহান আল্লাহ মুমিনদেরকে বিভিন্ন পরীক্ষায় নিপতিত করেন। যাকাত প্রথা সম্পদশালীদের জন্য একটি ঈমানী পরীক্ষা। সঠিকভাবে যাকাত আদায়ের মাধ্যমে মুসলমান ব্যক্তি ঈমানী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে।
৯. যাকাত সম্পদ ও ব্যক্তিকে পবিত্র করে: যাকাত আদায়ের মাধ্যমে দাতা ব্যক্তির চরিত্র যেমন পবিত্র হয়, তেমনি সম্পদও পবিত্র হয় এবং বৃদ্ধি পায়। আল্লাহর বাণী: তাদের মালামাল থেকে যাকাত গ্রহণ কর, যাতে তুমি সেগুলোকে পবিত্র করতে এবং সেগুলোকে বরকতময় করতে পার এর মাধ্যমে। [সূরা আত-তাওবা ৯:১০৩]
১০. আল্লাহর নিয়ামতের শুকর: ধন সম্পদ আল্লাহর এক বড় নিয়ামত। আর নিয়ামতের শুকর করাই ঈমানদারদের একান্ত কর্তব্য। যাকাত আদায়ের মাধ্যমে নিয়ামতের শুকর আদায় হয়।
যাকাতের সামাজিক গুরুত্ব :
১. ধনী দরিদ্রের বৈষম্য দূরীকরণ: যাকাত ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সমাজে ধনী দরিদ্রের মধ্যে বিরাজমান গগনচুম্বী বৈষম্য ধীরে ধীরে কমে আসে এবং সমাজে অর্থনৈতিক সাম্যের পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
২. অভাব মোচন: সমাজের বিত্তবান ব্যক্তিরা যদি সততা ও আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর নির্দেশমত নির্দিষ্ট খাতে যাকাত আদায় করে তাহলে সমাজে কোনো মানুষ অন্ন বস্ত্র এবং গৃহহীন থাকতে পারে না। তাই সমাজের সামগ্রিক আর্থিক অভাব মোচনে যাকাতের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
৩. ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি : যাকাত আদায়ের মাধ্যমে সমাজে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব সহৃদয়তা ও সহনশীলতার উন্মেষ ঘটে।
৪. সহানুভূতি সৃষ্টি: সমাজে অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ জনসমষ্টির প্রতি বিত্তবানদের সহানুভূতি প্রকাশের উত্তম মাধ্যম হলো যাকাত। এ ব্যবস্থায় গরিব জনগোষ্ঠী ধনীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়। ফলে শ্রেণীবিভেদ দ্রুত কমে আসে।
৫. সমাজে শান্তি স্থাপন: যাকাত ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে সমাজে বেকার সমস্যার সৃষ্টি হয় না। অসহায় লোকদের চাহিদা পূরণের ফলে সমাজে প্রশান্তি বিরাজ করে।
৬. ভালোবাসার উদ্ভাবক: যাকাত প্রদানে ধনী ব্যক্তির সাথে তার সমাজ সমষ্টির ঘনিষ্ঠতা ও ভালোবাসা সৃষ্টি হয়, যা কখনো ম্লান হয় না।
৭. সহনশীলতার সৃষ্টি: ধনীরা গরিবের দুঃখ কষ্ট অনুধাবন করত যাকাতের মাধ্যমে তা মোচনের জন্য নিজেকে নিয়োজিত করার মধ্যে দিয়ে গরিবদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়।
৮. ধনীর ব্যক্তিত্ব বিকাশ: যাকাত প্রদানের মাধ্যমে সমাজে ধনীর ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে। ফলে সমাজে তার মর্যাদাপূর্ণ স্থান অর্জিত হয়।
৯. পুঁজিবাদের অভিশাপ থেকে মুক্তি: যাকাত ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে পুঁজিবাদীদের ধন সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখার প্রবণতা হ্রাস পায়। এতে ধীরে ধীরে জাতি পুঁজিবাদের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে পারে।
১০. জনকল্যাণমূলক কার্যাবলি সম্পাদন: যাকাতের অর্থ নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় করার মাধ্যমে বহু সমাজকল্যাণ ও জনকল্যাণমূলক কাজ সম্পাদন সম্ভব হয়।
১১. অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধকরণ: যাকাতের অর্থে মিলকারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান তৈরি করে গরিব বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলে সমাজে চুরি ডাকাতি ছিনতাই রাহাজানি ইত্যাদি হ্রাস পাবে।
১২. সাম্য ও মানবতাবোধ সৃষ্টিকারী: যাকাত ব্যবস্থা মানুষের মধ্যে উঁচু নিচু ভেদাভেদ দূর করে সকলের মধ্যে সমতা আণয়ন করে। এটা পারস্পরিক ঘৃণা বিদ্বেষ দূর করে মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ববোধের বিকাশ ঘটায়।
১৩. মানব চরিত্রের অনুপম পরীক্ষা: যাকাত মানব চরিত্রে অর্থলোলুপতা দূর করে তা আল্লাহর নির্দেশিত পথে ব্যয় করতে উৎপাদিত করে যাকাত প্রদান করে মানুষ এ অনুপম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়।
দারিদ্র বিমোচনে যাকাতের গুরুত্ব:
যাকাত দারিদ্র বিমোচনে একটি কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা। দারিদ্র দূরীকরণে যাকাতের অবদান বিস্ময়কর। যাকাতের দ্বারা গরিব, অক্ষম, অভাবগ্রস্ত লোকদের পূর্ণ অর্থনৈতিক নিরাপত্তাদানের ব্যবস্থা করা যায়। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
১. জাতীয় আয়: যাকাত ইসলামি রাষ্ট্রের আয়ের একটি অন্যতম প্রধান উৎস। বিত্তবান ব্যক্তিরা তাদের সম্পদের শতকরা আড়াই ভাগ জাতীয় তহবিলে প্রদান করে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করতে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা দান করে।
২. অর্থনৈতিক ভারসাম্য: যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে ধনী-দরিদ্রের মাঝে অর্থনৈতিক ভারসাম্য দূর হয়। ব্যক্তিরা তাদের প্রয়োজনাতিরিক্ত অর্থ সম্পদ থেকে কিছু দরিদ্র জনগণের মাঝে বিতরণ করায় উভয় শ্রেণীর মাঝে অর্থনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা হয়।
৩. সর্বজনীন অর্থনৈতিক নিরাপত্তা: যাকাত মানুষের সর্বজনীন অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধান করে। অক্ষম ও অসামর্থ্য ব্যক্তিদের জাতি ধর্ম বর্ণ যাকাতের অর্থ দিয়ে পুনর্বাসন কার্যক্রম দেওয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। সুতরাং যাকাত সর্বজনীন অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধানে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
৪. অর্থনৈতিক অভাব বিমোচন: যাকাত সমাজের অভাবগ্রস্ত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অভাব-অনটন বিমোচনের এবং জীবন জীবিকার যোগদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৫. কর্মসংস্থান: যাকাত ইসলামি রাষ্ট্রের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে। যাকাতের অর্থ ব্যয়ে ক্ষুদ্র কুটিরশিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে দরিদ্র বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়।
৬. ঋণমুক্তি: যাকাতের অর্থ দ্বারা ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রকে ঋণমুক্ত করা যায়। ঋণের শৃঙ্খল থেকে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রকে মুক্ত করার বিধান আল্লাহ যাকাতের মাধ্যমে দান করেছেন।
৭. অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা আণয়ন: যাকাত সমাজ ও রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং স্থিতিশীলতা আণয়নে ও মুনাফাখোরী নিয়ন্ত্রিত হলে সম্পদ কোথাও পুঞ্জিভূত হতে পারে না। ফলে সমাজে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও স্থিতিশীলতা আছে।
৮. মজুতদারী দূরীকরণ: যাকাত অলসভাবে অর্থ মজুদ রাখার প্রবণতা নাশ করে এবং সঞ্চিত সম্পদ বিনিয়োগে উৎসাহ যোগায়। এতে অর্থনৈতিক মজুদদারী দূরীভূত হয়।
৯. অপচয় রোধ: সরকারের বিভিন্ন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রচুর আর্থিক অপচয় হয়, কিন্তু যাকাতের উদ্দেশ্য এবং ব্যয়ের খাতসমূহ সুস্পষ্টভাবে নির্ধারিত। এজন্য এ খাতে অপচয়ের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
১০. ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা রোধ: আধুনিক কর ব্যবস্থায় কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়, কিন্তু যাকাতে ফাঁকি দেওয়া প্রবণতা বিরল। মহান আল্লাহর ভয়ে ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে স্বেচ্ছা প্রণোদিতভাবে মানুষ যাকাত দেয়। সুতরাং এ অনুভূতি সর্বক্ষেত্রে ফাঁকি দেওয়া প্রবণতা রোধ করে।
১১. বেকারত্ব দূরীকরণ: সরকার যাকাত আদায়ের জন্য পৃথক একটি মন্ত্রণালয় খুলে অনেক লোকের চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করে বেকারত্ব দূর করতে পারে।
১২. জাতীয় উন্নতি: যাকাত সরকারের জন্য জাতীয় উন্নতি বিধানে একটি অনন্য ব্যবস্থা। যাকাতের নির্দিষ্ট ব্যয়খাতে যাকাতের অর্থ বিনিয়োগ করে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন দিকের উন্নয়ন করা সম্ভব।
১৩. সম্পদ পুঞ্জীভূতকরণ রহিত: যাকাত প্রদান করলে সম্পদ পুঞ্জীভূত থাকে না, বরং তা গরিবদের মাঝে পৌঁছে যায়। ফলে তাদের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ে, সাথে সাথে বাজার চাহিদা উৎপাদন ইত্যাদিও বৃদ্ধি পায়।
১৪. অর্থ অহমিকার বিলোপ সাধন: যাকাত প্রদান করলে ব্যক্তির মন থেকে অর্থের অহমিকা বিলুপ্ত হয়।
১৫. পুঁজিবাদের অবসান: ইসলামি রাষ্ট্রে যাকাত ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে সমাজে পুঁজিবাদীদের ধন-সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখার প্রবণতা হ্রাস পেয়ে পুঁজিবাদের অবসান ঘটে।
১৬. জনকল্যাণমূলক ব্যবস্থা: শতকরা আড়াই টাকা গরিব জনসাধারণকে দেওয়ার ফলে বিত্তশালীদের মন-মানসিকতার সুস্থ বিকাশ ঘটে। নির্দিষ্ট ব্যয় খাতে যাকাতের অর্থের প্রয়োজন শেষ হয়ে গেলে রাস্তাঘাট হাসপাতালসহ বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা যায়।
১৭. যাকাত অর্থনৈতিক ভিত্তি: ইসলামের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ গড়ে ওঠেছে যাকাতের ওপর ভিত্তি করে। আর যাকাতই ইসলামি রাষ্ট্রের আয়ের প্রধান উৎস।
১৮. অর্থনৈতিক বন্ধ্যাত্ব দূরীকরণ: যাকাত প্রদানের ফলে সম্পদ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে সম্পদের অর্থনৈতিক বন্ধ্যাত্ব দূরীভূত হয় ।
যাকাত আদায়ের নিয়ম :
আপনার নিকট নগদ ৪২ হাজার টাকা জমা থাকলেই (১০৫০) টাকা যাকাত দিতে হবে।
রুপার ভরি-৮০০ টাকা। ২.৫% প্রতি ভরির যাকাত আসে-২০ টাকা।
১ লাখে-২৫০০ টাকা যাকাত দেবেন
আজ ২২ ক্যারেট স্বর্নের বাজার মুল্য- ৬৯,০০০ টাকা। ২০% বাদে বিক্রয় মুল্য -৫৫,২০০ টাকা।২.৫% যাকাত-১৩৮০ টাকা।
প্রতিভরি যাকাত ১৩৮০ টাকা।
আপনার যত ভরি সোনা আছে, সেখান থেকে সাড়ে সাত ভরি বা ৮৫ তোলার অতিরিক্ত যদি থাকে, তাহলে সম্পূর্ণ সোনার জাকাত দিতে হবে। শুধু অতিরিক্তটার নয়।
আপনার কাছে ১৫ ভরি থাকলে ১৫ ভরিই জাকাত দেবেন, পুরাটারই জাকাত দিতে হবে। আপনি সাড়ে সাত ভরি বাদে জাকাত দেবেন, এ কথা শুদ্ধ নয়।
যাকাত বণ্টনের খাত সমূহ :যাকাত বণ্টনের খাত আটটি যা আল্লাহ তা‘আলা সূরা তওবার ৬০ নং আয়াতে বর্ণনা করেছেন।তা নিম্নরূপ : (১) ফকীর (২)মিসকীন (৩) যাকাতআদায়কারী ওহেফাযতকারী (৪) ইসলামেরপ্রতি আকৃষ্ট করার জন্যকোন অমুসলিমকে (৫) দাসমুক্তির জন্য (৬) ঋণগ্রস্তব্যক্তি (৭) আল্লাহ্র রাস্তায় (৮) মুসাফির।উল্লেখ্য যে, আল্লাহকর্তৃক নির্ধারিত ৮টি খাতের মধ্যেই যাকাতবণ্টন সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।এর বাইরে যাকাতপ্রদান
করা সিদ্ধ নয়।তবে যাকাতকে সমান ৮ভাগে ভাগ করতে হবে না।বরং ৮টি খাতেরমধ্যে যে খাতগুলো পাওয়া যাবে সেগুলোরমধ্যে প্রয়োজনের
দিকে লক্ষ্য রেখে কম-বেশী করে যাকাত বণ্টনকরতে হবে।এমনকি প্রয়োজনের উপরভিত্তি করে কোনএকটি খাতে সম্পূর্ণযাকাত প্রদান করলেও
তা আদায় হয়ে যাবে।
ইসলামে সদকায়ে ফিতরের গুরুত্ব অপরিসীম। মহান আল্লাহ পাক কোরআন মাজিদে একাধিকবার তার নির্দেশিত পথে বান্দাকে ব্যয় করতে বলেছেন। এতে তার পক্ষ থেকে উত্তম প্রতিদানের কথা বলা হয়েছে।ঈদ উল ফিতরের দিন সদকায়ে ফিতর আদায় করার ব্যাপারে প্রিয়নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসংখ্য হাদিস রয়েছে। তিনি বিধান অনুযায়ী ঈমানদারদের সদকায়ে ফিতর আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন।
এক হাদিসে আছে, মহানবী (সা.) এক ব্যক্তিকে নির্দেশ দিলেন যেন মক্কার অলিগলিতে এ ঘোষণা দেয় ‘সদকাই ফিতর ওয়াজিব’। (তিরমিজি ২য় খণ্ড ১৫১ পৃষ্ঠা)।ইসলামে সদকায়ে ফিতরের অনেক ফজিলত রয়েছে। সদকায়ে ফিতর রাসূলুল্লাহ (সা.) এর পছন্দনীয় আমলের মধ্যে একটি। সদকায়ে ফিতরের মাধ্যমে একমাস সিয়াম সাধণা মাহে রমজানের রোজা আল্লাহর দরবারে কবুল হয়।হাদিসে আছে হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) বলেন, হুজুরে আনোয়ার (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘‘যতক্ষণ পর্যন্ত সদকায়ে ফিতর আদায় করা হয় না, ততক্ষণ পর্যন্ত বান্দার রোজা জমিন ও আসমানের মাঝখানে ঝুলন্ত থাকে।’’(কানযুল উম্মাল, ৮ম খণ্ড)।আরেক হাদিসে আছে, হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘‘রাসূলে আকরাম (সা.) সদকায়ে ফিতর নির্ধারণ করেছেন, যাতে অনর্থক কথাবার্তা থেকে রোজাগুলোর পবিত্রতা অর্জিত হয়, অনুরূপভাবে মিসকিনদের খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যায়।’’ (সুনানে আবু দাউদ, ২য় খণ্ড)।
সদকাতুল ফিতর কী, কার উপর?ইসলামী বিধান অনুযায়ী সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব (ফরজের কাছাকাছি)। মৌলিক চাহিদার অতিরিক্ত নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে এক সা পরিমাণ যব, খেজুর, পনির কিংবা কিসমিস কিংবা এর সমপরিমাণ টাকা আদায় করতে হবে। সদকায়ে ফিতর আদায় করা না হলে বড় গুনাহগার হবেন।সদকায়ে ফিতর আদায়ের পরিমাণ উল্লেখ করে এ সম্পর্কে অসংখ্য হাদিস রয়েছে।হযরত ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, প্রত্যেক গোলাম, আযাদ, পুরুষ-নারী, প্রাপ্ত বয়স্ক, অপ্রাপ্ত বয়স্ক মুসলিমের উপর রাসূলুল্লাহ (সা.) সদকাতুল ফিতর হিসেবে খেজুর হোক যব হোক এক সা পরিমাণ আদায় করা ফরজ করেছেন। লোকজনদের ঈদের সালাতে বের হওয়ার আগেই তা আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। (সহিহ বুখারী)।
রাসূলের যুগে সাহাবিগণও এ পরিমাণ সদকায়ে ফিতর আদায় করেছেন।এ প্রসঙ্গে হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে তিনি বলেন, আমরা এক সা পরিমাণ খাদ্য, এক সা পরিমাণ যব অথবা এক সা পরিমাণ খেজুর অথবা এক সা পরিমাণ পনির, অথবা এক সা পরিমাণ কিসমিস দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করতাম। (সহিহ বুখারী)।গম কিংবা আটার বাজারমূল্য হিসাব করে
১ কেজি ৬৫০ গ্রাম গম বা আটা অথবা খেঁজুর, কিসমিস, পনির বা যবের মধ্যে যে কোনো একটি পণ্যের ৩ কেজি ৩০০ গ্রামের বাজার মূল্য ফিতরা হিসেবে গরিবদের মধ্যে বিতরণ করা যায়। এই হিসাবে এবার সর্বনিম্ন ৬৫ টাকা থেকে ১ হাজার ৬৫০ টাকা ফিতরা নির্ধারণ করা হয়েছে।সদকায়ে ফিতর কখন আদায় করবেনঃইসলামী শরীয়তের বিধান অনুযায়ী- ঈদুল ফিতরের নামাজের আগেই প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব। নাবালক ছেলেমেয়ের পক্ষ থেকে বাবাকে ফিতরা আদায় করতে হয়।প্রসিদ্ধ ফতোয়াগ্রন্থ ‘ফতোয়া আলমগীরী’ এর প্রথম খণ্ডে উল্লেখ আছে, মৌলিক চাহিদার অতিরিক্ত নিসাব পরিমাণ (সাড়ে সাতভরি স্বর্ণ কিংবা সাড়ে ৫২ ভরি রূপা) সম্পদের অধিকারি প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর উপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব।এতে আরো বলা হয়েছে, সদকায়ে ফিতর আদায়ের উত্তম সময় হচ্ছে ঈদের দিন সুবহে সাদিকের পর থেকে ঈদের নামাজ আদায় করার পূর্ব পর্যন্ত। যদি চাঁদ রাত কিংবা রমজানের কোনো একদিন বরং রমজানের আগেও যদি কেউ আদায় করে থাকে তাহলে তার ফিতরা আদায় হয়ে যাবে।সদকায়ে ফিতর তাকে দিতে হবে যে জাকাতের উপযোগী। যাকে জাকাত দেওয়া যায় না তাকে ফিতরাও দেওয়া যায় না। (ফতোয়া আলমগীরী, ১ম খণ্ড, ১৯৪ পৃষ্ঠা)।সদকায়ে ফিতর ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) এর বংশধররা কখনো নিতে পারেন না। অর্থাৎ তাদের সদকায়ে ফিতর দেওয়া যাবে না। (ফতোয়া আলমগীরী)।ঈদ উল ফিতরের আগেই ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের উচিত সদকায়ে ফিতর আদায় করা। আল্লাহ আমাদের আল্লাহর নির্দেশিত পথে সদকায়ে ফিতর ও যাকাত আদায় করার তওফিক দিন।
আমীন।
লেখক : তরুণ আলোচক ও গবেষক ।
সচিব দাওয়াহ : কুরআন মজলিস বাংলাদেশ ।
সদস্য : জাতীয় মুফাসসির পরিষদ বগুড়া জেলা ।
ও সাবেক সম্পাদক : অনলাইন নিউজ পোর্টাল বিডি নিউজ ২৬ ।
01734-608489
2 Attachments
|
|
|