প্রায় শতভাগ কভারেজ ঃ তাড়াশে যৌতুক প্রথা ভয়াবহ রুপ নিয়েছে

Spread the love

গোলাম মোস্তফা
যৌতুকের জন্য বাবা নিজের শিশু সন্তানকে জিম্মি করে তার মাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন। যৌতুকের জন্য অন্তঃসত্ত্বা মায়ের পেটে লাথি মেরে সন্তান মেরে ফেলা হয়। যৌতুক হিসেবে দেওয়া গরু নিয়ে ঘটে যায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। শুধু তাই নয়, চাহিদা মতো যৌতুক দিতে না পারায় পাশবিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয় তানজিলা, সাবানা, তানিয়া, জাকিয়া, আয়েশা, সাথী, খুশি, শিরিনা, রোজিনা ও শারমিনদের।এই মাত্র ক’দিন আগে চলনবিলে জামাইয়ের যৌতুকের দাবীর মুখে মেয়ে তার মায়ের নিকট থেকে মোটর সাইকেলের লক্ষ টাকা না পেয়ে মাকে ঘুমন্ত অবস্থায় গলা কেটে হত্যা করেছে যা বিশ^াস করা কঠিন কিংবা কল্পনাও করা যায় না।
স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন সমীক্ষায় জানা যায়, গ্রামীণ সমাজে অধিকাংশ মানুষের যৌতুক বিষয়ে ইতিবাচক ধারণা। তারা যৌতুক লেনদেনের পক্ষে। মেয়েদের বিয়েতে যৌতুক সামগ্রী দিলে স্বামীর বাড়িতে সন্মান নিয়ে সংসার করতে পারেন। পক্ষান্তরে ছেলের বাবারা মনে করেন, ছেলে সন্তানকে বড় করে তুলতে অনেক টাকা খরচ হয়। তাই যৌতুক তাদের প্রাপ্য অধিকার। তাছাড়া যৌতুকের টাকায় সংসারের কিছুটা অভাব ঘুচে যায়। যে কারণে তাড়াশ উপজেলার প্রায় শতভাগ বিয়ে যৌতুক প্রথা মেনেই সম্পন্ন করা হয়!
এদিকে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, সামাজিক সংগঠন ও কিশোর-কিশোরী ক্লাবগুলো মনে করছেন, “যৌতুক নিলে বা দিলে আত্বসন্মান বাড়ে না, বরং ক্ষুন্ন হয়। যৌতুকের টাকায় অভাব দূর হয় না, বরং সেই অর্থ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই ফুরিয়ে যায়। যৌতুক প্রথা একটি শোষণমূলক ব্যবস্থা। সর্বোপরি যৌতুক দেওয়া ও গ্রহণ করা আইনগত অপরাধ এবং ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ তথা হারাম।” জনসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে যৌতুক লেনদেন হ্রাস করা সম্ভব। কিন্তু এ কাজটি জনসমাজে বাস্তবায়ন করা বড়ই চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। এখন পর্যন্ত দেশে কোথাও সত্যকার যৌতুকমুক্ত এলাকা গড়ে তোলার কোন জোড়ালো প্রমাণ নেই।
উপজেলার মাধাইনগর ইউনিয়নের ঝুরঝুরি লক্ষীপুর গ্রামের ইউনুছ আলীর মেয়ে নাজমা খাতুন। নগদ ৮০ হাজার টাকা, দেড়ভরি সোনার গহনা ও ঘরের প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র যৌতুক হিসেবে দিয়ে তার বিয়ে হয় চন্ডিভোগ গ্রামের আজিজুর রহমানের ছেলে বিদ্যুত হোসেনের সাথে। তারপরও যৌতুকের জন্য নাজমার উপর শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন চলতেই থাকে। এরই মাঝে তাদের ঘরে জন্ম নেয় নূর হোসেন। নাজমা খাতুন আরো বলেন, শেষপর্যন্ত যৌতুকের টাকার জন্য সাত মাস বয়সী শিশু নূরকেই জিম্মি করেন তার বাবা। ঘটনার চার দিন পর থানা পুলিশের সহায়তায় নূরকে বুকে ফিরে পান তিনি। ২০২০ সালের ১ ডিসেম্বর মাসের এ ঘটনা।
তনুশ্রী রায়। তাড়াশ পৌর শহরের ঘোষ পাড়া এলাকার বব্রু বাহন রায়ের মেয়ে। ২০১৮ সালের ২ ডিসেম্বর তার ঘটা করে বিয়ে হয় টাঙ্গাইল পৌর শহরের প্যারাডাইস পাড়ার ব্রজ গোপাল বণিকের ছেলে ও টাঙ্গাইল সদর হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক চন্দন বণিকের সঙ্গে। গত বছরের ৩০ নভেম্বর মাসে তিনি যখন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা তখন তার স্বামী ও শ্বশুর-শাশুড়ি মিলে তনুশ্রীর বাবার বাড়ি থেকে যৌতুকের টাকা আনতে চাপ দেন। কিন্তু তাদের কথায় মতো টাকা টাকা আনতে রাজি না হওয়ায় স্বামী চন্দন পেটে সজোরে লাথি মারে। আর সেই আঘাতে তার অনাগত সন্তানটি পেটের মধ্যেই মারা যায়। তনুশ্রী রায় আরো বলেন, যৌতুকের জন্য তার সন্তানকে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় তিনি সিরাজগঞ্জ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুন্যাল-২ এ মামলা দায়ের করেছেন। মামলা নং ১১৩/২০। তার চিকিসক স্বামী কারাগার থেকে বেড়িয়ে জামিনে রয়েছেন। কিন্তু তনুশ্রী তার পাষন্ড স্বামীর প্রকৃত বিচার ও শাস্তি দেখতে চান।
সগুনা ইউনিয়নের পতিরামপুর গ্রামের চাঁদ আলী বলেন, তার মেয়ে চম্পা খাতুনকে ধাপতেতুলিয়া তেলিপাড়া গ্রামের আলাল ফকিরের ছেলে রাশিদুল ইসলামের সাথে বিয়ে দেন। যৌতুক হিসেবে ঐ বিয়েতে নগদ টাকা ও বিভিন্ন সামগ্রীর সঙ্গে একটি গরু প্রদান করেন। সেই গরুটি নিজের কাছে রেখেই লালন-পালন করতে থাকেন। এরই মধ্যে তার মেয়েটি মারা যান। তখন তিনি গরুটি বিক্রি করে দেন। কিন্তু তা মানতে নারাজ চম্পার স্বামী রাশিদুল ইসলাম। এ নিয়ে শুরু হয় নিকটবর্তী দুই গ্রামের মধ্যে চরম দ্বন্দ্ব। শেষপর্যন্ত তা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে পরিণত হয়। হতাহত হয় অনেকেই। ২৭ মে ২০২০ সালের এ ঘটনা।
সগুনা ইউনিয়নের লালুয়ামাঝিরা গ্রামের বাবলু মন্ডল তার স্ত্রী তানজিলা খাতুনকে যৌতুকের টাকার জন্য পাশবিকভাবে নির্যাতন করে হত্যা করেন। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে এ হত্যাকন্ড সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তানজিলার বাবা রেজাউল করিম বলেন, বিয়ের পর থেকে যৌতুকের দাবীতে তানজিলাকে তার স্বামী শারীরিকভাবে নির্যাতন করে আসছিলেন। শেষপর্যন্ত চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা তানজিলাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ ঘটনা ২০২০ সালের জুলাই মাসের।
যৌতুক না পেয়ে স্ত্রী সাবানা খাতুনকে হত্যার দায়ে তার স্বামী নূর হোসেন (৪০) নামে এক ব্যক্তিকে মৃত্যুদন্ড দেন সিরাজগঞ্জ নারী শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১। দন্ডিত ব্যক্তি তাড়াশ পৌর এলাকার ওয়াপদা বাঁধ এলাকার এলাহী বক্সের ছেলে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) শেখ আব্দুল হামিদ লাবলু এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
সাবানার ভাই আবু সাইদ বলেন, তাদের বাড়ি মাগুড়াবিনোদ ইউনিয়নের মাগুড়া গ্রামে। তার বাবা মৃত সোহরাব আলী। অতি দরিদ্র পরিবার তাদের। সাবানাকে বিয়ের সময় ৩০ হাজার টাকা যৌতুক দাবি করা হয়। তখন বিয়ের আসরে চার হাজার ও বিভিন্ন সময়ে আরো ২২ হাজার টাকা যৌতুক পরিশোধ করা হয়। কিন্তু নূর হোসেনের যৌতুকের চাহিদা বাড়তেই থাকে। সে যৌতুকের টাকার জন্য মাঝে মধ্যেই সাবানাকে মারধর করতেন। এক পর্যায়ে তাকে ব্যাপক মারধর করে গোপনাঙ্গে প্লাাষ্টিকের পাইপ দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করেন। এতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়ে সাবানা মারা যান। ২০১৮ সালের জুলাই মাসের এ ঘটনা বড়ই নৃশংস ও মর্মান্তিক।
যৌতুকের দাবিতে তানিয়া খাতুন নামে এক গৃহবধূকে হত্যার অভিযোগ ওঠে তার স্বামী সবুজ হোসেন, শশুর ও শাশুড়ির বিরুদ্ধে। ২০১৭ সালের জুলাই মাসের তাড়াশ পৌর শহরের নিমতলী এলাকার এমন একটি ঘটনায় তানিয়ার শশুর শাহরিয়ার আলম ও শাশুড়ি বুলবুলি খাতুনকে নিজ বাড়ি থেকে আটক করেন তাড়াশ থানা পুলিশ। কিন্তু ঘটনার পরই সবুজ পালিয়ে যান। তাকে এখনও ধরতে পারেনি পুলিশ। তানিয়ার ভাই বাবলু মিয়া বলেন, পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় তানিয়ার। কিন্তু বিয়ের পরে তার যৌতুক লোভী স্বামী ও শশুর-শাশুড়ি ৫০ হাজার টাকা যৌতুকের জন্য তাকে প্রায় নির্যাতন করতেন। উপায়ন্তর না পেয়ে আবাদি জমি বন্ধক রেখে বোনের সুখের কথা চিন্তা করে যৌতুকের টাকা দেওয়া হয়। তারপর আবার তানিয়ার স্বামী সবুজ চাকরির কথা বলে যৌতুক হিসেবে আরো টাকা দাবি করেন। সামর্থ্য না থাকায় তাদের সেই দাবি পূরণ করা সম্ভব হয়নি। যে কারণে তার বোন তানিয়াকে নির্মমভাবে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। নিহত তানিয়া উপজেলার মাগুড়াবিনোদ ইউনিয়নের হামকুড়িয়া গ্রামের আবু সাইদের মেয়ে।সর্বোপরি যৌতুকের চাহিদা মেটানোর অক্ষমতায় প্রাণ দিতে হয় জাকিয়া, আয়েশা, সাথী, খুশি, শিরিনা, রোজিনা ও শারমিনদের মতো অনেক গৃহবধূকেই।সরেজমিনে সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের শ্রেণি পেশার বেশ কিছু মানুষের সাথে কথা বলে যৌতুক লেনদেন সম্পর্কে তাদের ধারণা জানার চেষ্টা করা হয়েছে। তারা মেয়ে ও ছেলের বিয়েতে যৌতুক দেওয়া-নেওয়ার পক্ষে। অনেকে যৌতুক হিসেবে নগদ টাকা নেওয়া-দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। কেউবা নগদ টাকার পরিবর্তে যৌতুক হিসেবে উপহার সামগ্রী যেমন মোটরসাইকেল, ফ্রিজ, টিভিসহ ঘরের প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র’র কথা বলেছেন।
এদিকে স্থানীয় পরিবর্তন নামে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সম্প্রতি সমাজে পৌরুষ চর্চা ও নারীর প্রতি সহিংসতা সংক্রান্ত ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে একটি সমীক্ষা চালায়। এ সংস্থাটির পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক রাজু জানিয়েছেন, সমীক্ষা চলাকালে উঠান বৈঠকের মাধ্যমে উপজেলার প্রতিটি গ্রাম ও পাড়া-মহল্লার মানুষের যৌতুক বিষয়ে ধারণা উঠে আসে। সমাজে হাতে গোণা দ’ু থেকে চারজন মানুষ ব্যতিত সবাই যৌতুক লেনদেন করেই মেয়ে ও ছেলেকে বিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু উঠান বৈঠক শেষ করে তারা অনেকেই যৌতুক লেনদেনের কুফল সম্পর্কে বুঝতে সক্ষম হোন। এ প্রসঙ্গে তাড়াশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মেজবাউল করিম বলেন, যৌতুক প্রথা ভাঙার জন্য সচেতনতাই মুখ্য। এ ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানকে একযোগে যৌতুকের কুফল সম্পর্কে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষে কাজ করতে হবে। তবে পর্যবেক্ষণে প্রতীয়মান হয়, সমাজে যৌতুকের বিরুদ্ধে যাদের অবস্থান নেয়া ও সক্রিয় কাজ করার কথা তাদের প্রচেষ্টা ও তৎপড়তা অনেকখানি দুর্বল এবং অনিয়মিত। তাছাড়া সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায়েই শর্ষের মধ্যে ভূত লুকিয়ে থাকার কারণেও যৌতুক সেভাবে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হতে পারেনি। বড়কথা এর বিচারিক ব্যবস্থাপনা ও শাস্তির পরিমাণ খুব নগন্য বা অগ্রাহ্যনীয়। ফলে এ নিয়ে আইন প্রয়োগের বিষয়টিতে মানুষ কখনই ভীত-কুণ্ঠিত নয়। আর যে দেশে সুশাসন ও সততার ভিত নড়বরে, সেখানে সচেতনতার দোহাই দিয়ে পাড় পাওয়া সহজ। তবে এতে মূল সমস্যার কোন নিরসন বা সমাধান আশা করা যায় না। তাই আমাদের দেশে “জগৎ যতকাল আছে যৌতুক ততকালই থাকবে বলে” মনে করার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। এতে করে আশাহত হওয়ার কিছু নেই। যদিও আন্তরিক ও পরিকল্পিত সম্মিলিত উদ্যোগে এর রাশ টেনে ধরা অসম্ভব নয়।

লেখক : বিশিষ্ট তরুণ সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও সভাপতি , তাড়াশ মে

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD