এবার ২৬ মার্চ মহান স¦াধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অর্থাৎ ৫০ বছর উদযাপিত হচ্ছে । একই সাথে মুজিব জন্মশত বার্ষিকীও পালিত হচ্ছে সাড়ম্বরে দেশে ও বিশ্বের অন্য কয়েকটি দেশে । সেদিক থেকে এবছরটা জাতির কাছে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। করোনার উর্দ্ধমুখী সংক্রমণ সত্বেও সরাসরি ও ভার্চুয়াল প্লাটফরমে এবারের ১০ দিন ব্যাপী “মুজিব চিরন্তন” শীর্ষক বর্ণাঢ্য সরকারী বিশেষ অনুষ্ঠানমালায় যোগ দিয়েছেন বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানগণ । ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঢাকায় আসছেন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে; যদিও তার সফরের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে বাম ও ধর্মীয় ঘরানার দু’একটি দল। দক্ষিন এশিয়ার অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে বাংলাদেশ হতে যাচ্ছে যোগাযোগের কেন্দ্র স্থল । উন্নয়নেরও রোল মডেল হিসেবে ইতোমধ্যে আখ্যায়িত হয়েছে।।
এরই মধ্যে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশ উপনীত হয়েছে । সে উপলক্ষেও দেশজুড়ে নানা কর্মসূচী গৃহীত হচ্ছে। আমরা অবকাঠামো উন্নয়নসহ শিক্ষা ,স্বাস্থ্য ,গড় আয়ু, মাতৃমৃত্যু হার কমানো, মাথাপ্রতি আয়, জিডিপি ও রিজার্ভের রেকর্ড প্রবৃদ্ধি প্রভূতি ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অগ্রগতি করে চলেছি করোন্রা বৈশ্বিক ধাক্কা সত্যেও। স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন বাস্তবে নাগালে চলে এসেছে । আগামী দু বছরের মধ্যেই তা চলাচলের জন্য খুলে যাচ্ছে । এটা অস্বীকারের উপায় নেই যে , বর্তমান সরকারের উন্নয়ন প্রচেষ্টা ও কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার জন্য সহায়ক হয়েছে । জাতির জনকের সুযোগ্য কণ্যা ও উওরসুরী জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশের এই অব্যাহত উন্নতি ও প্রগতির জন্য দেশবাসীর কাছে তার পিতার মতই চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন সন্দেহ নেই ।
এখন স্বাধীনতা ও মহান মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পর আমাদের যা মূল্যায়ন করতে হবে তা হল অর্জনের ঝুলিতে আমাদের অনেকখানি আশাব্যঞ্জক সাফল্য বিদ্যমান । কিন্তু তাই বলে আত্মতৃপ্তির বেশী অবকাশ নেই । কেননা উন্নত রাষ্ট্রর কাতারে শামিল হতে আমাদের যেতে হবে আরো অনেক দূর । সে পথ ও প্রক্রিয়া কখনো হবে না সহজ ও নিস্কন্টক তা অনুমান করা যায় । এর মধ্যে আর্থ-সামাজিক উন্নতির সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উৎকর্ষ প্রয়োজন । আমাদের বহুদলীয় রাজনীতির ডামাডোলে ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের ফলে ইদানিং আসল রাজনীতি হারাতে বসেছে । আবার বিরাজনীতিকরণের ধারাও যুগপৎ লক্ষ্যনীয়। স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য সমূহের অন্যতম গণতন্ত্র এখন বেশী সংকটে পতিত । একটি সভ্য ও সমৃদ্ধ দেশের পরিচিতি পেতে বা সে পর্যায়ে উপনীত হতে আমাদের কয়েকটি দিকে নজর দিতে হবে । কারণ মানবাধিকার সুসংহত, নারীর মর্যাদা,শিশুর প্রাধান্য, অসাম্য-বৈষম্য হ্রাস, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা, দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধ এবং সর্বোপরি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় স্বার্থে আমাদের রাজনৈতিক মতৈক্য ও সমঝোতা একান্ত প্রয়োজন । আমাদের রাজনীতিতে যে বিভেদ-বিভক্তি, হিংসা- হানাহানি, তিক্ততা ও বিভাজন দেশের তৃণমূল পর্যন্ত প্রসারিত হয়ে চলেছে তা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অশনিসংকেত স্বরুপ। এটা আমাদের বর্তমান দূষিত ও নোংরা রাজনীতির একটা নজির বটে।
আমাদের মূখ্য, গুরুত্ববহ,মৌলিক কতিপয় জাতীয় ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আজো সহমত দেখা যায় না । বরং বিদেশীদের কাছে একে অপরের বিরুদ্ধে নালিশ বা অভিযোগ জানাতে দেখা যায়। এতে জাতীয় ভাবমূর্তি নষ্ট হয়ে থাকে। এটা কোন জাতির জন্য শুভ লক্ষণ নয়।অপরদিকে সাম্প্রতিককালে নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। ভোটাধিকার হয়ে পড়েছে প্রশ্নবিদ্ধ । অবাধ মত প্রকাশ, বাক স্বাধীনতা, মুক্ত চিন্তা চর্চা ও গনমাধ্যমের লেখালেখির স্বাধীনতা ইত্যাদি বাধাগ্রস্থ হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দরুন। এটা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পরিবর্তে স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য বহন করে যা বর্তমান রাষ্ট্রের নেতৃত্বের ও সরকার প্রধানের কাছে দেশবাসীর কাম্য নয় । মনে রাখতে হবে , ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগের নেতৃত্বেই তৎকালীন পাকিস্তানী শাসকদের দমন-পীড়ন , শোষন ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন- সংগ্রাম শেষে সর্বাত্মক লড়াই সংঘটিত হয়েছিল । দেশ হয়েছিল স্বাধীন। এখন নিজ দেশ পরিচালনা করতে গিয়ে তারাই পুনরায় সে বদনাম নিতে পারে না , সেটা তাদের জন্য শোভনীয় নয় । তাই মানুষ বলছে, আমাদের উন্নয়ন এলেও গণতন্ত্র এখনো আসে নি। গণতন্ত্রের জন্যই মুক্তিযুদ্ধ হলেও স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পরেও সেই গণতন্ত্রের স্বপ্ন আজো অধরা রয়েছে। দেশ কেবল আর্থিক ও সামাজিক খাতে এগিয়ে গেলেই হবে না, গণতন্ত্রের সূচকেও কাংখিত উৎকর্ষ তথা পরিবর্তর্ন হতে হবে । জনতুষ্টিবাদ বা একনায়কতান্ত্রিক আমলা-পুলিশ নির্ভর রাষ্ট্র ব্যবস্থার কিংবা একদলীয় শাসন নিয়ন্ত্রণের দিকে না গিয়ে , হাইব্রিড গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে আমাদের সত্যকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হওয়ার প্রক্রিয়া অনুশীলন করা জরুরী । এ ছাড়া শুধু ধন-সম্পদে নয় গুনে-মানেও সভ্য জাতির ধরণ-বৈশিষ্ট্য অর্জনের দিকেও খেয়াল করা দরকার । সম্পদ সভ্যতা এনে দিতে পারে না, সভ্যতা সম্পদ এনে দিতে পারে এই প্রবাদে আমাদের বিশ^াসী হতে হবে । সীমাহীন দুনীর্তি, অবক্ষয় ও অন্যান্য সামাজিক অসঙ্গতি-অনৈতিকতা আমাদের দ্রুত উন্নয়ন তৎপড়তাকে ব্যাহত করে চলেছে এবং সমাজ মানস কলুষিত হচ্ছে। মানবিক গুনাবলী, সততা ও আদর্শ হারিয়ে যেতে বসেছে। । সেসব নিরসন ও সমাধানের জন্য আমাদের সক্রিয় সচেষ্ট হওয়ার লক্ষ্যে পরিচ্ছন্ন গণমূখী রাজনীতি, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন, ন্যায় বিচার ও সুশাসন, জাতীয় ঐক্যমত ও প্রকৃত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা ও অনুশীলনের বিকল্প নেই। টেকসই উন্নয়ন ( এসডিজি) অভিষ্ট্য লক্ষ্য অর্জনের জন্য কাউকে পেছনে ফেলে নয় – সে কথা আমরা যেন ¯্রফে মুখে না বলে বাস্তবেও প্রমাণ দেখাতে পারি। আর সেই টেকসই উন্নয়ন ও শান্তিপূর্ণ সভ্য সমাজ প্রতিষ্ঠার পূর্ব শর্ত হল গণতন্ত্র। গণতন্ত্র ছাড়া স্বাধীনতা অর্থহীন এবং মূল্যহীন তা ভুলে গেলে চলবে না।
একটি অন্তর্ভূক্তিমূলক, বহুত্ববাদী, ধর্ম নিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক, সমতাভিত্তিক, উদার গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করাই আমাদের চরম ও পরম অভিপ্রায় যা ছিল জাতির পিতার ও স্বাধীনতারও মূল স্বপ্ন। ইদানিংকার আকাশচুম্বী ব্যক্তিস্বার্থের অভিলাষ এবং আত্মভোগবিলাসিতার মানসিকতা পরিহার করে, দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি, কালো টাকা, পেশী শক্তি ও ক্ষমতার অপব্যবহার পরিত্যাগ করে আমরা যেন দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধকে বড় করে দেখি, সবার উপরে সামষ্টিক তথা জাতীয় স্বার্থকে স্থান দিই, যেমনটি দিয়ে থাকে উন্নত দেশের নাগরিক সমাজ। ।আমরা যেন উন্নয়নের নামে পরিবেশ-প্রকৃতি ধ্বংস না করি। পারিবারিক, দলীয় ও গোষ্ঠিভিত্তিক সংকীর্ণ ঠিকাদারি রাজনৈতিক মতলববাজি আমরা যেন এড়িয়ে চলি, কেননা দেশের মানুষ কখনই এসব পছন্দ করে না। রাজনীতি হতে হবে দেশ ও জাতীর কল্যাণের জন্য। আর স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃত না করে , প্রকৃত ইতিহাস বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে জানানো খুবই প্রয়োজন। জাতির ভবিষ্যত মঙ্গলের জন্য এ নিয়ে পারস্পারিক দ্বন্দ্ব-বিভ্রান্তির আশু অবসান কাম্য।