বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈদয় শুকুর মাহমুদ
একটি জাতির ন্যায় বিচার ও সঠিক পথ প্রদর্শক হচ্ছে সংবাদপত্র। নিরপেক্ষ সংবাদপত্রের মাধ্যমেই সে জাতির সঠিক পথ চলা সম্ভব। অপরাধ সনাক্ত করার সার্চ লাইট ও ন্যায় বিচারের সহায়িকা হচ্ছে সংবাদ মাধ্যম। একটি সংবাদপত্রই পারে জাতির অন্যায়-অপরাধ তুলে ধরতে, অধিকার বঞ্চিতদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জোড়ালো দাবী উথাপন করতে। গণতান্ত্রিক আর রাজনৈতিক উপদেশ দিতে পারে সংবাদ মাধ্যম। গণতন্ত্রের বাহক সংবাদপত্রের মাধ্যমেই মানুষ পৃথিবীকে কাছে জানতে পারে। একটি জাতিকে সভ্যতার উচ্চ শিখরে নিয়ে যেতে পারে নিরপেক্ষ সংবাদপত্রই। অথচ বর্তমান বিশ্ব ক্রমাগতভাবে এগিয়ে যাচ্ছে ইন্টারনেটের দিকে। মানুষ এখন খবরের কাগজে চোখ মেলাতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। অনাদরে পরে থাকতে দেখা যায় পত্রিকার খবর। এ অবস্থায় সংবাদ পত্রগুলোও এখন অনলাইন ব্যবস্থা চালু করেছে। তবে আমাদের সংবাদপত্র যতই অনলাইন ব্যবস্থা চালু করুক না কেন, যতই অনলাইন ইন্টারনেটে আধুনিকায়ন হোক না কেন; বাস্তবতা প্রমাণ করতে তথা বস্তুনিষ্ঠ খবর পরিবেশনে মূদ্রিত খবরের কাগজের বিকল্প নেই। এ লক্ষ্যে আমাদের জাতীয় ও স্থানীয় সংবাদপত্রগুলো বাঁচিয়ে রাখতে বুকের মাঝে লালন করি সংবাদপত্রের ভালবাসা। পত্রিকা পড়ার অভ্যাস অব্যাহত রাখি।
অবহমান কাল হতেই সংবাদ পরিবেশিত হয়ে আসছে কোন না কোন মাধ্যমে। তবে তখন থেকেই রয়েছে সংবাদের প্রতিবন্ধকতা ও পরাধিনতা। বৃটিশ শাসন আমলে ভারত উপ-মহাদেশে সংবাদপত্র ছাপা হতো। তবে এত ব্যাপকতা ছিল না। বাংলায় খবর পরিবেশন করতে সংবাদ পত্র ছাপা হতো ঢাকা ও কলিকাতা থেকে। তখনকার দিনে দৈনিক পত্রিকাগুলো মফস্বলে পৌছাত অনেক দিন পর। তাই টাটকা খবর বাশি হলেও তা পড়েই মানুষ আনন্দে আত্মহারা হতো। মজা করে খবরের কাগজ পড়ত। সে সময়েও পত্র-পত্রিকা ছাপা হতো। সেগুলোও খবর পাঠকদের কাছে প্রিয় পত্রিকা হিসাবেই গণ্য হতো। তখন বড় শহর ব্যতীত কোন জেলা শহরেও খবরের কাগজ ছাপা হয়নি।
বৃটিশের শাসনামলে সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সংবাদপত্রের উপর ছিল নানা রকম বাধা নিষেধ। ছিল না লেখার স্বাধীনতা। অনেক পত্রিকার সম্পাদক জেল খেটেছেন। কারও পত্রিকা ম্যাগাজিন সাময়িকী সাহিত্যপত্র বাজেয়াপ্ত করেছে বৃটিশ শাসকগোষ্ঠি। পাকিস্তান শাসনামলেও সংবাদপত্রের প্রসার ঘটলেও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ছিল না। কত সাংবাদিক কত সম্পাদক নির্যাতিত লাঞ্ছিত হয়েছে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠির হাতে তার হিসেব রাখেনি কেউ। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, স্বাধীনতা পেয়েছে বাঙ্গালী জাতি। আমাদের সংবাদপত্রের প্রচার প্রসার ঘটেছে অনেক। এখন শুধু রাজধানী শাহর নয় জেলা উপজেলা থেকে প্রতিনিয়ত সংবাদপত্র ছাপা হচ্ছে জাতীয়, স্থানীয় পত্রিকা, দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক বহু পত্রিকা।
সংবাদপত্রের প্রচার-প্রসার ঘটেছে বহুগুণ। অথচ সংবাদ ও সাংবাদিকের পুর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা বা স্বাধীনতা নেই সাহসিকতা নিয়ে সত্য সংবাদ পরিবেশন করে। এই স্বাধীন দেশেও কত সাংবাদিক সন্ত্রাসী বা দুর্বৃত্তদের হাতে প্রাণ দিয়েছে অথবা কেউ রাজনৈতিক রোষানলে পরে শেষ হয়েছে, আজও শেষ হয়নি তার বিচার। কত পত্রিকার সম্পাদক হামলা-মামলার শিকার হয়েছে তারও হিসেব কেউ রাখে না। অর্থাৎ প্রতিনিয়ত নিপীড়ন-নির্যাতনের অক্টোপাশে বাধা পড়ে আছে আমাদের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা। বহু প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলো অবিরাম সংগ্রাম করে চলছে নানা সমস্যা সংকট অতিক্রম করে। একই ধারায় স্থানীয়ভাবে বিশিষ্ট সাংবাদিক ও গবেষক আব্দুর রশিদ চৌধুরীর অক্লান্ত পরিশম ও তারই সম্পাদনায় বৃহত্তর কুষ্টিয়ার প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র ‘দৈনিক বাংলাদেশ বার্তা’ শিরোনামে ৩৪ বছর যাবৎ প্রকাশিত হয়ে আসছে। সিরাজগঞ্জে প্রথম দৈনিক প্রিন্ট মিডিয়া, দৈনিক কলম সৈনিক পত্রিকা হাটি হাটি পা পা করে ৩২ বছর অতিক্রম করে আজ তেত্রিশ বছরে পদার্পণ করেছে। দীর্ঘ সময় অতিক্রম করার পরেও পত্রিকাটির গুনগত মান, সাহসিকতার কোন পরিবর্তন ঘটেনি। তবে এ পত্রিকাটিও বর্তমানে অন লাইন ব্যবস্থা চালু হতে যাচ্ছে ‘দৈনিক কলম সৈনিক’ পত্রিকার সুদক্ষ সম্পাদক ইতিহাস গবেষক সাহসী কলমযোদ্ধা জনাব মোহাম্মদ আব্দুল হামিদের সম্পাদনায় পত্রিকাটি আজও সিরাজগঞ্জ সহ উত্তর বঙ্গের বেশ কয়েকটি জেলা আলোকিত করে রেখেছে। চলনবিল এলাকার পাবনার চাটমোহর উপজেলা থেকে দৈনিক চলন বিল নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়ে দীর্ঘ ১৩ বছর অতিক্রম করতে চলেছে। সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলা থেকে বিশিষ্ট সাংবাদিক, কবি ও কথাসাহিত্যিক আব্দুর রাজ্জাক রাজু’র সম্পাদনায় সাপ্তাহিক চলনবিল বার্তা পত্রিকাটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে ৩ বছর অতিক্রম করে ৪র্থ বছরের সিংহভাগ পেরিয়ে এসেছে। এভাবে বর্তমান বাংলাদেশে সকল জেলা ও উপজেলা থেকে অসংখ্য সংবাদপত্র প্রকাশিত হচ্ছে। এতদসত্বেও সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত নয়। গণমাধ্যম সম্প্রচার আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামে প্রভৃতি কালাকানুন সাংবাদিকদের নিরপেক্ষ এবং নির্বিবাদে লেখালেখির প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে দিন দিন সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়ে তা ভীতিকর ও স্বনিয়ন্ত্রিত সেন্সরশীপে পরিণত হয়েছে। বাক স্বাধীনতা, মুক্ত চিন্তার র্চ্চা , গণতন্ত্র ও মানবাধিকার এগুলোই ছিল আমাদের স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য। কিন্তু আমরা মনে হয় সেই মহান লক্ষ্য থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছি।
লেখক : বিশিষ্ট কলামিস্ট ও কথা সাহিত্যিক, শাহজাদপুর,সিরাজগঞ্জ। প্রয়োজনে: ০১৭৮২-৪৫৭৭৮৩।