চলনবিল সংকুচিত হয়ে এখন অর্ধ শতাধিক খন্ড বিলে পরিণত

Spread the love

আবুল কালাম আজাদ

#প্রাকৃতিক জলাভুমি, কৃষি ফসলী জমি এবং সুস্থপরিবেশ রক্ষায় মরণঘাতি অশুভ পুকুর খননের বিরূদ্ধে ঐক্য গড়ে তুলে শ্লোগান দেই ‘পুকুর খননকে না বলি।
#পুকুর খনন কার্যক্রম বন্ধ করা না গেলে অতি নিকটেই চলনবিলসহ  উল্লেখিত বিল ও ফসলী মুল্যবান জমি পুকুরের পেটে চলে যাবে বলে কৃষিবিদ এবং পরিবেশবাদীরা আশংকা করছেন।

প্রাচীন প্রবাদে আছে“ বিল দেখ তো চলন, গ্রাম দেখ তো কলম , শিব দেখ তো তালম ,আর পুল দেখ তো সাড়ার পুল”। এই চলনবিল পাকভারত উপমহাদেশের ঐতিহাসিক বিল বলে খ্যাত।চলনবিলের কথা লিখতে হলে অনেক গবেষণার প্রয়োজন আছে। ১৯৬০ সালে জন্ম থেকে আমি শিশুকাল, বাল্যকাল,যুবাকাল পার হয়ে বর্তমানে ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত  এই চলনবিলের    ঢেউয়ের তালে তালে, মাছ, শাপলা-শালুক,নানা জাতের পাখির কলতানের সাথে মিশে বেড়ে উঠেছি। চলনবিলের বিশালত্ব আমি প্রত্যক্ষভাবে দেখে আসছি। আমার এই ৬০ বছরের জীবদ্দশাতেই দেখছি যতই মানুষ বাড়ছে, যতই উন্নয়নের ছোঁয়া লাগছে ততই সংকুচিত হতে হতে বিশাল অখন্ড চলনবিল তার একক অখন্ড বিশালত্ব হারিয়ে আজ অর্ধ শতাধিক খন্ড খন্ড বিলে বিভক্ত হয়ে এই বিশাল জলাধারের জীবন-যৌবন বিলুপ্ত প্রায়। উন্নয়নের ধাক্কা, জলবায়ু পরিবর্তন, অপরাজনীতির প্রভাব, পরিক্ষা-নিরীক্ষা না করেই চলনবিলের প্রাণ সঞ্চালনকারী বড়াল নদীর উৎসমুখে অপরিকল্পিতভাবে ¯øুইসগেট নির্মাণ, তিস্তা ব্যারেজ নির্মাণ , যত্রতত্র বাঁধ, সড়ক, মহাসড়ক, রেললাইন, অসংখ্য ব্রীজ, কালভার্ট, ¯øুইসগেটসহ নানা অবকাঠামো নির্মাণ , দ্রæত নগরায়ন, শিল্পকারখানা  গড়ে উঠায় এবং প্রভাবশালীদের দখল-দুষণে স্রোতস্বীনি অখন্ড চলনবিলের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে।শুকনা মওসুমে বিলের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত ৭৭টি নদী, বিল, খাড়ি, জলাশয় ভরাট হয়ে আবাদি জমিতে রূপান্তরিত হয়েছে।বিলুপ্তির পথে ৬৫ প্রজাতির মাছ।

চলনবিলের অতীত ইতিহাসে দেখা যায়- এককালে অখন্ড চলনবিল ছিল তৎকালীন নাটোর মহকুমার তিন চতুর্থাংশ, নওগাঁ মহকুমার মান্দা, রানীনগর ও আত্রাই থানা এবং পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমা ও সদরের চাটমোহর, ফরিদপুর ও বেড়া থানায় বিস্তৃত।বগুড়া জেলার দক্ষিণ প্রান্তের  আদমদীঘি ও নন্দীগ্রাম থানা  চলনবিলের মধ্যে ছিল। শুধু বাংলাদেশে নয়,পাকভারত উপমহাদেশে চলনবিলের ন্যায় এত বিশাল আয়তন বিশিষ্ট আর কোন বিল আছে বলে ইতিহাসে জানা জানা যায় না।

চলনবিলের সিমা উত্তরে বগুড়া জেলার নন্দীগ্রাম এবং শেরপুর থানা, দক্ষিনে পাবনা জেলার আটঘড়িয়া ও ঈশ^রদী থানা , পুর্বে সারা-সিরাজগঞ্জ রেললাইন, পশ্চিমে নাটোর সদর থানাএবং নওগাাঁ জেলার আত্রাই ও রানীনগর থানা।

চলনবিলের উৎপত্তি কখন হয় এবং কেন এর  নামকরণ চলনবিল হয় এর সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। দুই হাজার বছর পুর্বে চলনবিল নামে কোন বিলের অস্তিত্ত¦ ছিলনা বলে ইতিহাস সাক্ষি দিচ্ছে।তখন বিল ছিল সমুদ্রের গর্ভে।কেননা তখন বগুড়ার মহাস্থান পর্যন্ত বঙ্গপোসাগর বিস্তৃত ছিল বলে বলা হয়।কিছুকাল পরে সমুদ্র চলনবিলকে প্রসব করে জন্ম দিয়ে দক্ষিণ দিকে সরে পরে।তখন পদ্মা ও যমুনা নদী শিশু চলনবিলকে অঙ্গে ধারন করে। গঙ্গা নদীর যেখান থেকে ভাগিরথি নদী প্রবাহিত , তার নি¤œাংশের পুর্বগামি শাখা পদ্মা এবং ব্রম্মপুত্রের দক্ষিণ-পশ্চিমগামী শাখা যমুনা চলনবিলের বুকচিড়ে প্রবাহমান ছিল। চলনবিলের জলরাশি বদ্ধবিলের ন্যায় স্থির না হয়ে  নদীর ¯্রােতের ন্যায় চলন্ত বা গতিশীল ছিল বলেই হয়তো এর নামকরণ করা হয় ‘চলনবিল’ অর্থাৎ চলন্ত বিল।মতান্তরে ‘চোল সমুদ্র’ হতে চলনবিলের উৎপত্তির কথা অনুমান করা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কোন গ্রন্থে ‘ চোলসমুদ্র’ নামে সমুদ্রের নাম বা পরিচয় পাওয়া যায় না।

ইম্পেরিয়াল গেজেট অব ইন্ডিয়া হতে জানা যায়- এককালে নাটোরের লালপুর থানা ব্যতীত প্রায় সমগ্র মহকুমা বিলময় ছিল।ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ারের রাজশাহী অংশে বলা হয়েছে-“ চলনবিল রাজশাহী জেলার একটি বিশাল জলাভূমি যার দৈর্ঘ্য ২১ মাইল, প্রস্থ ১০ মাইল।অতএব রাজশাহী বর্তমান নাটোর জেলা অংশের বিলের ক্ষেত্রফল ১২০ বর্গমাইল এবং পাবনা জেলা অংশের ৩৪০ বর্গমাইল। সব মিলে বিল অংশের মোট আয়তন দাঁড়াচ্ছে ৫৬০ বর্গমাইল। এর সাথে স্থলভাগের  গ্রাম সমুহের আয়তন প্রাং ২৫০ বর্গমাইল যেগ করলে চলনবিল অঞ্চলের মোট আয়তন প্রায় ৮০০ বর্গমাইল।

১৯১৪ সালে পাবনা জেলার ঈশ^র্দীর পদ্মা নদীর উপড় রেললাইনের সংযোগ পুল নির্মাণ করে সারা-ঈশ^রদী-সিরাজগঞ্জ এবং ঈশ^র্দী শান্তাহার রেললাইন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অখন্ড চলনবিল দ্বিধবিভক্ত হয়ে উভয় রেললাইনের মধ্যবতী শুধু নি¤œাঞ্চল চলনবিল নামে পরিচিত হয়। এছাড়া নাটোর-সিংড়া-বগুড়া এবং বনপাড়া-তাড়াশ- হাটিকুমরু মহাসড়কসহ চাটমোহরের নিমাইচরা-হান্ডিয়াল-তাড়াশ-বিনসারা-রানীরহাটবাঁধ,তাড়াশ-বারুহাস-বিয়াস,তাড়াশ-নওগাঁ সড়কসহঅগনিত সড়ক, বাঁধ, ¯øুইসগেট, ব্রীজ, কালভার্ট নির্মাণ করায় চলনবিল আরো খন্ড-বিখন্ড তথা টুকরো টুকরো হয়ে পড়েছে। বর্তমানে  নাটোর জেলার গুরুদাসপুর, সিংড়া ও বড়াইগ্রাম , সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ,রায়গঞ্জ ও উল্লাপাড়ার আংশিক এবং  পাবনা জেলার ভাঙ্গুড়া ও চাটমোহরসহ আট উপজেলাকে চলনবিল নামে অভিহিত করা হয়।বর্তমানে চলনবিল এলাকার আয়তন ৮০০ বর্গমাইল। পুর্ব-পশ্চিমে দৈর্ঘ্য ৩২ মাইল এবং উত্তর – দক্ষিণে প্রস্থ ২৪ মাইল।

বিস্তীর্ণ অখন্ড চলনবিল আজ মানুষের প্রয়োজনে উন্নয়নের নামে খন্ডবিখন্ড হতে হতে প্রায় অর্ধশতাধিক পৃথক পৃথক নাম ধারণ করে বিলের সৃষ্টি হয়েছে। বিলগুলি হচ্ছে- দক্ষিন চলনবিল, নলখোলা বিল, চঁড়ালের বিল, রয়নার বিল,চকপাড়া বিল, মানিকপুর বিল,হাাঁড়িভাঙ্গ বিল,বড়দোহা বিল ,চিনাডাঙ্গা বিল, বিল বাহাত্তর, খলিশাডাঙ্গা বিল,মেরিগাছার বিল, চেঁচুয়ার বিল, আইড়মারি বিল, গলিয়া বিল, কানচগাড়ি বিল, কৈখোলা বিল, পাতিয়া বিল,ছয়আনি বিল, বাঁড়ার বিল, সাধুগাড়ী বিল, সাঁতৈল বিল, বিলকুড়ালিয়া, বড়বিলা বিল, ঝাঁকড়ার বিল, কচুগাড়ির বিল, চাতরার বিল, নিহলগাড়ির বিল, টেঙরাগাড়ির বিল, খোলার বিল, কুমড়াগাড়ির বিল, খৈগাড়ির বিল, বৃগড়িলা বিল, দিগদারিয়ার বিল, খুলুগাড়ির বিল, কচিয়ার বিল, ধলার বিল,ধরইল বিল, বালোয়া বিল, আমদাকুড়ি বিল,বাঙ্গাজালিয়া বিল, হুলহুলিায়া বিল, কালামকুড়ি বিল, রঘুকদমা বিল, কুমিরা বিল, মরা বিল, বোয়ালিয়া বিল, পাঙ্গাসিয়ার বিল,হরি বিল, বুড়ি বিল, বহয়া বিল, সোনাডাঙ্গা বিল,তাড়াশের বড়বিল, বিদ্যাধর ঠাকরুনের বিল, নলুয়াকান্দি বিল, ঘরগ্রাম বিল, বেরল বিল, কাশিয়ার বিল, চাকলের বিল, কাতল বিল, বাঘমারা বিল, চিরল বিল, ডিকশির বিল, রুখলীডাঙ্গা বিল,রউল শেওলা বিল, রুইমারির বিল, ঝিনিগাড়ির বিল, চকিরভিটা বিল, হাসমারির বিল, চাকলের বিলও  লক্ষীচামারী বিল ইত্যাদি। এছাড়াও চলনবিলে রয়েছে সাড়ে চার হাজার হেক্টর আয়তনের ১৬টি নদী, প্রায় ২ শত কিলেমিটার আয়তনের অর্ধশত খাল, এবং অসংখ্য দীঘি, পুকুর ও জলাশয়।

বর্তমান বৃহত্তর চলনবিল সহ উল্লেখিত বিল সমুহে জমির অধিক ব্যবহার ও অর্থনৈতিক লাভের আশায় চলনবিলের মানুষ পুকুর খনন করে মাছ চাষে মেতে উঠেছে। প্রত্যেকটা বিলেই চলছে পুকুর খননের মহোৎসব। পুকুর গিলে খাচ্ছে জলাভুমি , বিলের ফসলী জমি আর সড়ক-রাস্তার ধার বা ঢালুসমূহ। সরকার আইন করেও  থামাতে পারছেনা পুকুর খননের আগ্রাসী অভিশপ্ত কার্যক্রম।পুকুর খননের উৎসবে হারিয়ে যাচ্ছে চলনবিল এবং বিলের প্লাবনভুমি,ঐতিহ্য ও জীববৈচিত্র। বেড়ে যাচ্ছে জলাবদ্ধতা। দুষিত হচ্ছে পরিবেশ। এর প্রভাবে মানুষ আক্রন্ত হচ্ছে নানারকম নতুন নতুন রোগব্যাধিতে। তাছাড়া জলাবদ্ধ জমিতেও আবাদ করতে না পেরে জমির মালিকেরা বাধ্য হচ্ছে পুকুর খনন করতে। স্থানীয় প্রশাসন বাধা দিলেও মানছে না প্রভাবশালীরা। প্রশাসনের ও পুলিশের কিছু অসাধু কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং রাজনৈতিক নেতারা পুকুর মালিকদের কাছ থেকে মোটা অংকের উৎকোচের বিনিময়ে নিরব ভুমিকা পালন করে পুকুর খননে সহযোগীতা করছেন।চলনবিলের কৃষক, মৎসজীবি, সাধারণ মানুষ, ছাত্র-শিক্ষক, পরিবেশবাদী, রাজনৈতিক কর্মী, সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বিল এবং ফসলী জমি ধ্বংস করে বেপরোয়া পুকুর খননের প্রতিবাদে মানববন্ধন, মাটিকাটার মেশিন জালিয়ে দেওয়া সহ নানা কর্মসুচিও  পালন করে আসছেন। তারপরও বন্ধ করা যাচ্ছেনা পুকুর খননের নেশাগ্রস্থ কার্যক্রম। পুকুর খনন তৎপরতা বন্ধ করা না গেলে অদূর ভবিষ্যতেই চলনবিল এবং উল্লেখিত বিল ও ফসলী মুল্যবান জমি পুকুরের পেটে চলে যাবে বলে কৃষিবিদ এবং পরিবেশ বাদীরা আশংকা করছেন। আসুন, আমরা সবাই ঐতিহাসিক চলনবিলসহ উল্লেখিত বিল , প্রাকৃতিক জলাভুমি, কৃষি ফসলী জমি এবং সুস্থ পরিবেশ রক্ষায় মরণঘাতি অশুভ পুকুর খননের বিরূদ্ধে ঐক্য গড়ে তুলে শ্লোগান দেই‘ পুকুর খননকে না বলি।’

# আবুল কালাম আজাদ ,বার্তা সম্পাদক, দৈনিক দিবারাত্রী এবং সভাপতি, চলনবিল প্রেসক্লাব, গুরুদাসপুর,নাটোর।# ০১৭২৪ ০৮৪৯৭৩#

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD