শারদীয় দুর্গোৎসব এবার দুর্গাপুজা

Spread the love

সুজন কুমার মাল

নানা ফুলের সমাহারে দেবীর চরণে দেশ ও দশের মঙ্গল কামনায় আবার একটি বছর পরে চারিদিকে উলুধ্বনি,শঙ্খধ্বনি। মন্দিরে মন্দিরে অনুষ্ঠিত হবে দেবীর পুজা অর্চনা। চলমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে করোনা মহামারির কারণে এবার বাংলাদেশ তথা সারাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবের আয়োজন শারদীয় দুর্গোৎসবকে দুর্গাপূজা হিসেবে অনেকে বলছেন৷ অর্থাৎ এবার কোন উৎসব হবে না, শুধু পূজা হবে৷  এমন কি অষ্টমী তিথিতে কুমারী পূজাও এবার ঢাকেশ্বরী মন্দিরে বাদ দেওয়া হয়েছে৷

এমনকি রাত নয়টার পর দেশের কোন পূজা মন্ডপ খোলা রাখা যাবে না৷ হবে না কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও৷ আবার দর্শনার্থীদের প্রবেশেও থাকবে যথেষ্ট কড়াকড়ি। অথচ বিগত বছরগুলোতে আমরা সকলে মিলে দল বেঁধে বিভিন্ন জায়গা থেকে দুর্গা প্রতিমা দেখতে যেতাম বা আসতেন। মন্দিরে মন্দিরে পরিণত হতো জাতি,ধর্ম,শ্রেণী নির্বিশেষে এক মিলন মেলায়। ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে একে অপরের সাথে কুশালাদি বিনিময়, নানা ধরণের খাবার দিয়ে আপ্যায়ন সেকি ভোলার কথা। নারিকেলের নাড়–, মুুড়ির মোয়া, মিষ্টি কতই না পদের খাবার । আবার আপ্যায়ন হিসেবে থাকতো প্রসাদ বিতরণ ।

আবার শোভাযাত্রা করে দুর্গা নিয়ে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় যেতাম, সেখানে সবাই মিলিত হয়ে একসঙ্গে বিসর্জন দেওয়া হতো৷কিন্তু এবার এই মহামারীর কারণে কেউ একসঙ্গে যাবেন না ৷ প্রতিটি পুজা মন্ডপ থেকে পৃথকভাবে দুর্গা প্রতিমা নিয়ে বিসর্জন দেওয়া হবে বলে বার্তা দেয়া হচ্ছে ৷

এবার দুর্গা পূজার অনুষ্ঠানমালা শুধু ধর্মীয় রীতিনীতি অনুসরণ করে পূজা-অর্চনার মাধ্যমে মন্দির প্রাঙ্গণেই সীমাবদ্ধ থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। অপরদিকে মহালয়া পুণ্য তিথি থেকে শুরু করে শারদীয় দুর্গোৎসবের সব ক্ষেত্রেই রয়েছে স্বাস্থ্যবিধির কড়াকড়ি। ইতিপুর্বে সারাদেশে পূজা উদযাপন পরিষদ দেশের প্রতিটি মন্দির ও পূজা কমিটির কাছে এই সংক্রান্ত ২৬ দফা নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে বলে জানান একাধিক মন্দির কমিটির দুর্গা পুজার সাথে সংশ্লিষ্টরা।

এবার মহালয়া অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ ইং, বাংলা ১৪২৭ সনের ১ আশ্বিনে। পঞ্জিকার হিসাবে আশ্বিণ মাসে দুটি অমাবশ্যা তিথি থাকার কারণে এবার আশ্বিন মাস “মল মাস” অর্থাৎ অশুভ মাস। সে কারণে এবার দুর্গাপুজা আশ্বিন মাসে না হয়ে দেবীর পূজা হবে কার্তিক মাসে। আবার শরৎকালে পুজা হয় দেখে যার নাম শারদীয় দুর্গোৎসব কিন্ত এবার হেমন্তকালে হচ্ছে দেখে দেবীর আরেক রুপ ‘‘ হৈমন্তী ’’ পরিচিতি হবে। আর হৈমন্তী গল্পের হৈমন্তী চরিত্রটি কারো মনে দাগ কাটেনি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেই হিসাবে এবার দেবী দুর্গা মর্ত্যে আসবেন মহালয়ার প্রায় ৩৫ দিন পরে।

পঞ্জিকা অনুযায়ী, ২১ অক্টোবর ২০২০ ইং বুধবার ৪ কার্তিকে শ্রী পঞ্চমী তিথিতে দেবীর বোধন ঘট স্থাপন  হবে। এভাবে ষষ্ঠী , সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী পূজার মাধ্যমে শুরু হবে দুর্গোৎসবের মূল আচার অনুষ্ঠান। ২৬ অক্টোবর বিজয়া দশমীতে বিসর্জনের মধ্য দিয়ে  শেষ হবে দুর্গোৎসবের সকল আনুষ্ঠানিকতা।

দুর্গা প্রতিমা তৈরি থেকে পূজা সমাপ্তি পর্যন্ত প্রতিটি মন্দিরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ভক্ত-পূজারি ও দর্শনার্থীদের জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা রাখা, সকলে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরা, দর্শনার্থীদের মধ্যে নুন্যতম তিন ফুট শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, প্রতিটি পূজা মন্ডপে নারী-পুরুষের যাতায়াতের পৃথক ব্যবস্থা করা, বেশি সংখ্যক নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবক রাখার কথা বলা হয়েছে এসব নির্দেশনায়। তেমনি সারাদেশে পূজা কমিটিগুলোকে বলা হয়েছে, সন্দেহভাজন কাউকে মনে হলে দেহ তল্লাশির ব্যবস্থা রাখতে হবে। সর্তকতা হিসেবে আতসবাজি ও পটকা ফুটানো থেকে বিরত থাকতে হবে। প্রতিটি পূজা মন্ডপে রাখতে হবে সিসি ক্যামেরার ব্যবস্থা নিরাপত্তা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে। দুর্গাপুজায় ভক্তিমূলক সংগীত ছাড়া অন্য কোনো গান যেন বাজানো না হয়, মাইক বা পিএ সেট যেন ব্যবহার করা না হয়, পূজা মন্ডপে প্রয়োজনের অতিরিক্ত দীর্ঘ সময় কোনো দর্শনার্থী যেন না থাকে এবং সন্ধ্যার বিরতির পর দর্শনার্থীদের প্রবেশে যেন নিরুৎসাহিত করা হয়- সেসব বিষয়ও আছে দিক নির্দেশনায়।

এছাড়া সব ধরনের আলোকসজ্জা, সাজসজ্জা, মেলা, ধূপতিতে নারিকেলের ছোঁপায় ধূপ জ্বালিয়ে আরতি প্রতিযোগীতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিহার করা, সম্ভব হলে বাসা-বাড়িতে থেকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভক্তদের অঞ্জলি দেওয়া, খোলা জায়গার অস্থায়ী প্যান্ডেলে স্বাস্থ্যবিধি পরিপূর্ণভাবে মেনে চলা, প্রশাসন, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় জন প্রতিনিধি ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে পুজা মন্ডপ কেন্দ্রিক শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটি গঠন, গুজবে বিভ্রান্ত না হয়ে তাৎক্ষণিক আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করা এবং প্রতিমা বিসর্জনে শোভাযাত্রা পরিহার করার নির্দেশনা রয়েছে সেই ২৬ দফার মধ্যে।

দুর্গা দেবী এবার গজে (হাতি) গমণ । পঞ্জিকা মতে ধরিত্রী শষ্যে স্বয়ং সম্পুর্ন্না।  আর প্রকৃতি সাথে প্রতিটি ধর্মই মিশে আছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। আর মন্দিরে গিয়ে কলাগাছ দেখে ভাবেন এটা কি? এই সংখ্যায় তারই একটি বিশেষ ব্যাখা তুলে ধরা হবে। কলা বৌ বা নব পত্রিকা দুর্গাপুজোর একটি বিশিষ্ট অঙ্গ এটিই মা দুর্গা। অর্থাৎ গণেশ জননী। গণেশের বৌ নয় । রম্ভা কচ্চী হরিদ্রাচ জয়ন্ত্রী বিল্ব দা মৌ। অশোক মানকশ্চৈব ধান্যঞ্চ নবপত্রিকা। নবপত্রিকার পূজা একাধারে কৃষি প্রধান এপার বাংলা এবং  ওপার বাংলায় বৃক্ষপূজা; অন্যদিকে রোগব্যাধি বিনাশকারী বনৌষধির পূজাও বটে। রম্ভাধিষ্ঠাত্রী ব্রক্ষাণী, কচ্বাধিষ্ঠাত্রী কালিকা, হরিদ্রাধিষ্ঠাত্রী উমা, জয়ন্ত্র্যাধিষ্ঠাত্রী কার্তিকী, বিল্বাধিষ্ঠাত্রী শিবা, ডালিম্বাধিষ্ঠাত্রী রক্তদন্তিকা, অশোকাধিষ্ঠাত্রী শোকরহিতা, মানাধিষ্ঠাত্রী চামুন্ডা ও ধান্যাধিষ্ঠাত্রী লক্ষী।

এই নয়টি বিভিন্ন গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর নাম যথাক্রমে :- ১. কদলী গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ব্রহ্মাণী ২. কচু গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী কালিকা ৩. হরিদ্রা গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী উমা ৪. জয়ন্ত্রী গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী কার্তিকী ৫. বিল্ব গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী শিবা ৬. ডালিম গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী রক্তদন্তিকা ৭. অশোক গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী শোকরহিতা ৮. মান গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী চামুন্ডা ৯. ধান গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী লক্ষী। একজোড়া বেল সহ শ্বেত অপরাজিতা লতা দিয়ে এই নয়টি গাছকে কলা গাছের সাথে একত্রে বন্ধন করা হয় । আবার এই নয় মিলে যে দেবী একত্রে তাকে বলা হয় “নবপত্রিকাবাসিনী নবদুর্গা।

এবার কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যে সারাদেশেই সীমিত পরিসরেই হচ্ছে দশভূজা দেবী দুর্গা। দেবী দুর্গার আগমনের মাধ্যমে ধরিত্রীতে কেটে যাক সকল দু:খ, কষ্ট, বিপদ- আপদ, ত্রিতাপ জ্বালা, যন্ত্রনা এটাই হোক সকলের প্রার্থনা ।

 

লেখক ঃ তরুণ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD