দূর্গাপূজার একাল সেকাল : প্রেক্ষাপট নিমগাছি

Spread the love

আব্দুল কুদ্দুস তালুকদার : পাল রাজাদের  আমলের অমর কীর্তি জয়সাগর সহ অন্যান্য বহু বৃহৎ জলাশয় তথা দীঘির জন্য বিখ্যাত রায়গঞ্জ উপজেলার নিমগাছি জনপদ ঐতিহাসিকভাবেই প্রসিদ্ধ। তখন থেকেই বিভিন্ন উৎসবে এখানে বিশেষ করে পূজা – পার্বনে আনন্দের বান ডাকতো। তবে কথায় বলে চিরদিন কাহারও সমান যায় না। ঐরূপভাবে নিমগাছির সেইসব রাজন্য বর্গের প্রাসাদও ধ্বংস হয় কালের চক্রে, যার ভগ্নাবশেষ হেথা – হোথা দেখা যায় আজও আশে পাশের গ্রামসমূহে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার কিছুকাল আগের বছরগুলোতেও দেখা যেত নিমগাছি গ্রামটা পুরো জংগলে আকীর্ণ। হাট একটা লাগতো বটে ; তবে তা সোম বা বৃহস্পতিবার হাটবেলাতেই শেষ হতো ; সূয্যি  মামা ডুবে যাবার আগেই হাটুরে লোকজন সবাই বলা চলে যার যার বাড়ী চলে যেতেন। হাটখোলায় কোনো স্থায়ী দোকানপাট বা লোকবসতিও ছিল না বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি অবধি। আশে পাশে দেহাতি আদিবাসী  তথা মাহাতো – বসাক – তাঁতীদের দূচারটে পরিবার ছিল বটে তবে তা দীন মজুর লেবেলের বলতে গেলে। এই গাঁয়ে একমাত্র মুসলিম পরিবার ছিল ঝড়ু ফকিরের।  তার পরিবারের লোক সংখ্যা মাত্র তিন জন ;  তিনি ছিলেন নিমগাছির পীর ভোলা দেওয়ান এর মাজারের খাদেম তথা মোতোয়াল্লী। যে ভোলা দেওয়ান ছিলেন বৃটিশ বিরোধী ফকির – সন্যাসী বিদ্রোহের মহানায়ক ফকির মজনু শাহের শিষ্য এবং ঐ পীরের নামে ৩৪ বিঘা লা – খেরাজ জমি ছিল নিমগাছি ও পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহে ; যা এখন সবই বেহাত। গাঁয়ের বাঁকী সবাই ছিল হিন্দু এবং  তাও নামকাওয়াস্তে। কারণ, তফসিলি স¤প্রদায়ের  আদিবাসীদেরকে বিভিন্ন কাস্টের হিন্দুরা নিজেদের জাত ভাই বলে স্বীকার করতে চাইতো না খুব একটা। এছাড়া আদিবাসীগন ছিল কিছুটা প্রকৃতি পূজক শ্রেণির, গতানুগতিক হিন্দু তথা বামুন – কায়েতগনের সাথে তাদের ধর্মীয় বা সামাজিক আচরণ মিলতো না বেশীর ভাগ।

 

নিমগাছির নায়েব তথা ভূমি অফিসার ছিলেন চাটমোহর থানার হান্ডিয়াল গ্রামের ক্ষীতিষ চন্দ্র গুন। তিনি ছিলেন এজজন নামকরা হোমিও ডাঃ। নিমগাছিকে ভালবেসে ক্ষিতীশ বাবু জমি কিনে এখানে বাড়ী নির্মাণ করেন চাকুরী থেকে অবসর নেবার পর। তার আগে সিরাজগঞ্জের কালিয়া হরিপুর থেকে এসে বসতি হন রাখাল চন্দ্র পোদ্দার। এছাড়া এলাকার অনেক জমির মালিক উল্লাপাড়ার জমিদার ভাদূ বাবুও বাড়ী করেন নিমগাছিতে। ওদের দেখে স্বগোত্রের কয়েক ঘর পোদ্দার, রায় আসেন এবং বসতি গড়েন জমি কিনে । যেমন – চাটমোহরের জমিদার পরিবারের সন্তান শশধর রায় এখানে এসে পাশের গোতিথা গ্রামের এক আদিবাসী মহিলাকে ভালবেসে বিয়ে করে এখানেই  থেকে যান। আসেন সিরাজগঞ্জ সদরের বনবাড়িয়া থেকে রাধারমন পোদ্দার ওরফে খোকা পোদ্দার, হরেন্দ্র নাথ পোদ্দার, কুমুদ রঞ্জন পোদ্দার ওরফে টিপু পোদ্দারেরা তিন ভাই। একই এলাকা থেকে আসেন চুনীলাল পোদ্দার তার দুই ছেলে কালীচরন পোদ্দার ওরফে কালা পোদ্দার। যিনি পরে সোনাখাড়া ইউপির মেম্বর হন ও রাসবিহারী পোদ্দার ওরফে রাসু পোদ্দারকে নিয়ে সপরিবারে, সিরাজগঞ্জ শহরের শহরতলী রানীগ্রাম থেকে আসেন সুধীরচন্দ্র পোদ্দার। তিনি এসে উঠে পড়েন আগে থেকে বাসরত তার ভগ্নীপতি রাখাল চন্দ্রের বাসায়। কাস্টের হিন্দু বলতে এরাই নিমগাছির প্রথম বসতি। এদের আমলেই নিমগাছিতে প্রথম জয়দূর্গা মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয় বা দূর্গা পূজার প্রচলন হয় ১৩৬০ বঙ্গাব্দে।  প্রত্যেক ঘটনার পিছনে যেমন ঘটনা থাকে এখানেও তেমন ঘটেছিল, যা  ছোট একটা ইতিহাস। নিমগাছির প্রভাবশালী ব্যাবসায়ী  শশধর রায়ের বড় ছেলে সিরাজগঞ্জের জ্ঞানদায়ীনি হাইস্কুলের ছাত্র শুশীল রায় যিনি পরে নিমগাছি হাইস্কুলে হেডটিচার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ও হরেন্দ্র নাথ পোদ্দারের প্রথম সন্তান  হীরেন পোদ্দার যান দূর্গা পুজা দেখতে চান্দাইকোনা ইউপির  কুলীন হিন্দু বসতি পাইকড়া গাঁয়। পূজা কমিটির লোকেরা ওদের সাথে খারাপ আচরণ করে। একথা ওরা এসে নিমগাছিতে ওদের গার্ডিয়ানদের জানায়। উঠতি ব্যবসায়ী পোদ্দারগণ এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহের আদিবাসী নেতারা সিদ্ধান্ত নেন, পরের বাড়ী গিয়ে পূজা দেখা বা গঞ্জনার শিকার হওয়ার চেয়ে নিজেদের আঙ্গিনায় নিজেরা আয়োজন করবেন পূজোর। যা আছে তাই নিয়েই শুরু। এখন যেখানে পুকুর পাড়ে পাকা জয়দূর্গা মন্দির তার পশ্চিমে কলাগাছের বাগানের মাঝে টিনের ছাপড়া তুলে তাতে ছোট প্রতিমা স্থাপন করে যাত্রা শুরু দেবী বন্দনার। পূরোহিত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ক্ষীতিশ গুনের জামাতা বিধূ রঞ্জন ভদ্র, যাকে বাড়ীতে ঘরজামাই রেখেছিলেন ডাঃ গুন। আজ ৬৭ বছর হলো চলছে উৎসব। মাঝে ১৯৭১ সনে পাক হানাদার বাহিনীর জন্যে ও পরে বাবরী মসজিদ ভাঙ্গা নিয়ে মন্দিরে হামলার কারণে পূজো হয় নি। তবে বাবরী মসজিদ কান্ডে প্রতীকধর্মী ঘটপূজা হয় বটে ঐ বছর।

আজকে যেখানে সাইদ তালুকদারের ঔষধের দোকান ওর পিছনে ছিল ফাঁকা জায়গা। হাটের দিন কয়েকজন নাপিত বসতো ও দূধ বিক্রয় করতে আসতো গাঁয়ের লোকেরা মাত্র গুটি কতক । ঐ স্থানের উত্তর প্রান্তে ঘোষবাড়ী সংলগ্ন জায়গায় অস্থায়ী টিনের ছাপড়ায় দক্ষিণমূখী হয়ে স্থাপিত হতো দেবী দূর্গার প্রতিমা। একই ফ্রেমে থাকতো লক্ষী, দূর্গা, স্বরস্বতী, কার্তিক, গনেশ, মহিষাসুর ও সিংহসহ দেবতাদের বাহনসমূহ ; এখনকার মত এক একটা দেবতাকে পৃথকভাবে উপস্থাপন করা হতো না মন্দির বা বেদীর নানা পয়েন্টে শৈল্পিকভাবে। ছোট বেলায় দেখেছি স্কুলে যাবার পথে, মাস খানেক আগে থেকেই পাল মশায়গণ এসে বাঁশ – খড়ের ফ্রেম করতো প্রতিমা তৈরীর জন্য। তাতে মাটির প্রলেপ দিত এবং  রোদে শুকানোর জন্য খোকা পোদ্দারের আঙ্গিনায় রাখতো তা। আমরা নিয়মিত খোঁজ নিতাম কতটুকু এগিয়েছে কাজ। কারণ, মন্ডপের পাশে মেলা বসতো পূজা শুরু  হলে। দাদার সাথে গিয়ে বাঁশী কিনব, ঝুড়ি – মুড়কি খাব এ চিন্তায় কামনা করতাম তাড়াতাড়ি প্রতিমা শুকিয়ে যাক। পরে তাতে রং দিত, রাংতার শাড়ী পরানো হতো, দেবীর চোখে লাগাতো কাঁচের গুটি। এর ফলে হ্যাজাকের আলো পড়লে চোখ হতে দীপ্তি ছড়াতো। যেহেতু ঐ সময় বিজলী বাতির প্রচলন ছিল না তাই হ্যাজাক ছিল লাইটিং এর মূল উপাদান। নিমগাছির প্রবীণ ব্যবসায়ী ও স্বর্গীয় শশধর রায়ের ছোট ছেলে সুনীল রায় ওরফে লালু জানান, জয়দূর্গা মন্দির তথা প্রথম পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি ছিলেন  ডাঃ ক্ষীতিস চন্দ্র গুন, সাধারন সম্পাদক  শশধর রায় ও কোষাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন রাধারমন পোদ্দার যার ছোট মেয়ে চন্দনা রানীকে বিয়ে করেন লালু রায়। কমিটিতে আরও যারা ছিলেন তন্মধ্যে আদিবাসী নেতা মেঘুরিয়ার কালীচরন মাহাতো, ভাটার পাড়ার গোকূল চন্দ্র মাহাতো যার দান করা জমিতে বর্তমান পাকা মন্দির ; যদিও তিনি মারা যাওয়ার পর তার পূত্র দীনেশ চন্দ্র মাহাতো ও চুনীলাল মাহাতো রেজিস্ট্রীর মাধ্যমে স্বর্গীয়  বাবার ওয়াদা পূরন করেন।  নিমগাছির মেঘনা মাহাতো, কিনুরাম মাহাতো, সুধীর চন্দ্র পোদ্দার, রাখাল চন্দ্র পোদ্দার, চুনীলাল পোদ্দার, কালীচরন পোদ্দার, ভাদু বাবু, দত্তবাড়ীর মহেন্দ্রনাথ মাহাতো সহ আরও অনেকে ঐ কমিটির সদস্য ছিলেন। মূলকথা, প্রথম উদ্যোগ নেয়ায় এলাকার ছোট – বড় সবাই এগিয়ে আসেন পূজা উদযাপনে সহযোগিতায়। লালু রায় আরও জানান, স্বাধীনতা পূর্বকালে সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতি ছিল মনে রাখার মত। ঐ সময়ে প্রতি বছর পূজার সময় যাত্রা বা নাটক মঞ্চস্থ হতো মন্ডপের সামনে বা হাটখোলায়, এখন যেখানে মাছহাটার আটচালা বা কাঁচাবাজার। তখন ছিল ঐসব জায়গা ফাঁকা। শুধু বৃহস্পতিবারে কয়েকটা গরু ছাগল বিক্রয় হতো মাত্র ; আর সব দিন ফ্রি পড়ে থাকতো। নাটকে অংশ নিত জাত – ধর্ম নির্বিশেষে সত্যিকার নাট্যমোদীরা। উল্লেখযোগ্য হিসেবে ছিলেন, পুল্লার আবুল কাশেম সরকার যিনি পরে সোনাখাড়া ইউপির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তার ছেলে আমজাদ হোসেন ছানাও পর পর দূবারে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে দীর্ঘ ১৪ বছর একটানা দায়িত্ব পালন করেন যা আজও রেকর্ড ; এছাড়া ছানা নিজেও একজন এলাকার সেরা নাট্যজন বটে। আরও যারা নাটকে অংশ নিতেন- চকপাড়ার রামেন্দ্র নাথ রায় যিনি প্রায়ই নায়ক বা কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করতেন, বলরাম সরকার যিনি বেশীর ভাগ নায়িকা বা মূল নারী চরিত্র রূপায়ন করতেন; কারণ তার চেহারা ছিল খুব সুন্দর ও আকর্ষণীয় ; তা ছাড়া নারী চরিত্রে রোল প্লে করার মত লোকও পাওয়া যেত না তখন খুব একটা। গোপালপুরের জহির তালুকদার যিনি ছিলেন ডাকসাইটে জোতদার আছের আলী তালুকদারের একমাত্র পূত্র এবং যার নামে উটরা হাজীপুর ও সোনাখাড়ায় ২ টা ইট ভাটা করেছেন বর্তমানে তার সন্তানগণ, ভূয়টের ডাঃ জয়নাল আবেদীন, মছের খাঁ যিনি সোনাখাড়া ইউনিয়নের ১ম নির্বাচিত চেয়ারম্যান হন হোসেন শহীদ সোহরোওয়ার্দী যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী,  বাসাইলের খোন্দকার আব্দুস সাত্তার, নিমগাছির সুধীর চন্দ্র পোদ্দার, রূপাখাড়ার দীনেশ চন্দ্র সহ আরও অনেকে। মঞ্চের সিকিউরিটির বা ভলান্টিয়ারের কাজ করতেন পুল্লার আজগর আলী সরকার, আব্দুল ওয়াহেদ, আঁকড়ার ছাদেক আলী আকন্দ যিনি স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সোনাখাড়া ইউপির একমাত্র  ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন ; তার আগে বা পরে ঐ দায়িত্ব আর কেউ পান নি। সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতির আরো একটা নজীরের বর্ণনা দিলেন নিমগাছির প্রবীণ  ভ্যানচালক শ্রীরামপুর গ্রামের মাহাম আলী। তিনি জানান, স্বাধীনতা পূর্বকালে সোনাখাড়ার সম্পন্ন গৃহস্থ দীনেশ – পরেশ রায়দের বাড়ী পূজা হতো। রাতে কৃষ্ণ যাত্রা বা রাম যাত্রা হতো বাড়ীর বহিরাঙ্গনে। আগের দিন এসে বাড়ীর মালিক পরেশ রায় পাশের গ্রাম শ্রীরামপুরের সবাইকে পুজা দেখা ও নাড়ু – মোয়া খাবার নেমতন্ন দিয়ে যেতেন যদিও শ্রীরামপুরে একঘর বসতিও হিন্দু নেই। দাওয়াত খেতে গেলে নাড়ু – মোয়া – পায়েস – খিচুড়ী পাওয়া যেত ফ্রি আর প্রথম সারিতে বসে মঞ্চের পাশে থেকে পালা দেখার সুবিধা ছিল ফাও। এছাড়া সারা রাতে মাঝে মাঝে পাওয়া যেত চা বিস্কুট। বিনিময়ে পালা গানে কেউ যেন বিরক্ত করতে না পারে এবং অনুষ্ঠান নির্বিঘেœ সম্পন্ন হয় তা দেখতে হতো তাদের। কারণ, শ্রীরামপুরের মানুষকে সমীহ করতো পার্শ্ববর্তী গ্রামের লোকজন ; যেহেতু ওরা ছিল কিছুটা জঙ্গী টাইপের তথা মারামারিতে পটু ।

দেশ স্বাধীনের পরেও ঐ নাট্যধারা বজায় থাকে তবে পাত্র – পাত্রীগনের বদল ঘটে ; পুরাতনের বিদায় আর নতুনদের আগমন হয়। যেহেতু পূজা হতো পোদ্দারগনের আঙ্গিনায় তাই তাদের ছেলে মেয়েরাও নাটকে অংশ নিত আর দর্শকও থাকতো ওদের বৌ – ঝি, পাড়া প্রতিবেশী সহ সাধারণ মানুষ। যেমন – নিমাই সন্যাসী পালা হলে খোকা পোদ্দারের বড় মেয়ে সাধনা রানী সাজতো নিমাই পাগড়ী মাথায় দিয়ে এবং তার স্ত্রী সাজতো টিপু পোদ্দারের মেয়ে স্বরস্বতী, মাসী বা পিসির রোল করতো শশধর রায়ের ছোট মেয়ে মিনুু। কারণ তার বয়স কম হলেও গড়নে একটু বড় সাইজ ছিল ফিগার, সাথে থাকতো কালা পোদ্দারের মেয়ে গীতা। নিমাই এর মা হতেন নিমগাছি হাইস্কুলের দপ্তরী শ্যামল কুমার মাহাতো। নিমাই সন্যাসব্রত নিয়ে গৃহত্যাগ করে, মা – স্ত্রীর আহাজারি দেখে দর্শক সারিতে বসা বিধূ বাবু আবেগে জ্ঞান হারান আ – হা – হা চীৎকার করে। তার মাথায় জল ঢেলে জ্ঞান ফেরান হয়। আজও মনে হয় কিভাবে প্রাইমারীর ছাত্রী স্বরস্বতী – সাধনা ঐ অভিনয় করে তখন। এছাড়া টিপু পোদ্দারের ছেলে গৌর, নিতাই, পরিতোষ ; কালা পোদ্দারের ছেলে কামাখ্যা চরন,  সুধীর পোদ্দারের ছেলে শ্যামল কুমার, সুবলসহ অনেকেই নানা ছোট খাটো চরিত্রে অভিনয় করতো। বিগত কয়েক বছর নিমগাছিতে যাত্রা বা পালা না হলেও আদিবাসী নিয়ন্ত্রিত পূজা মন্ডপগুলোতে যেমন – মেঘুরিয়া, অর্জুনগড়, খৈচালা, দত্তবাড়ী, বাসাইল, আটঘরিয়ায় সারা রাত জেগে নাট্যামোদীগণ মঞ্চ মাতায় বিশেষ করে বিজয়া দশমীর দিন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিকভাবে আদিবাসীরা এগিয়ে যাওয়ায় এবং নিজেরা স্বাধীনভাবে পূজো করার মানসে আলাদাভাবে আয়োজন শুরু করে। প্রথমে মেঘুরিয়ার কালীচরন মেম্বরের বাড়ীতে দূর্গা পূজার পৃথক আয়োজন করে ওরা। কিছুটা যুক্তি দেখায় ওরা যে, বাজারের পোদ্দারগন আদিবাসীদের সাথে ভাল আচরন করেন না। তাই আলাদা আয়োজন তাদের, যদিও নিমগাছির জয়দূর্গা মন্দির কমিটির পক্ষ হতে এই যুক্তিকে বানোয়াট বলে দাবী করা হয়। এছাড়া সরকারীভাবে পূজা মন্ডপে বিশেষ সিকিউরিটির ব্যাবস্থা করা ও অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদানের ফলে আগ্রহী হন বিভিন্ন গ্রামের পূজারী তথা উৎসাহীগন। যার জন্য নিমগাছি জয় দূর্গা মন্দিরের সাবেক পূজারীগন এখন মানে এই বৎসরেও বিশ্বজোড়া করোনা আতংকের মাঝেও পৃথকভাবে প্রায় ১৫ টি মন্ডপে পূজোর আয়োজন করছেন। যেমন – মেঘুরিয়া কালী মেম্বরের বাড়ী, উটরা হাজীপুরের অর্জুন গড়, বাসাইলে সর্দার পাড়া, খৈচালার দূর্গা মন্দির, কলিয়া দক্ষিণ পাড়া পবনের বাড়ী, কলিয়া উত্তর পাড়া সুরেনের বাড়ী,  তালতলার দূর্গা মন্দির, পশ্চিম আটঘরিয়ার মানব ধর্ম প্রচার সংঘের মন্দির, ধলজান সরকার পাড়া বিমলের বাড়ী, ধলজান পশ্চিম পাড়া দীনা বন্ধুর বাড়ী, চকপাড়ার কালীবাড়ী মন্দির, গোতিথার কেন্দ্রীয় মন্দির, দত্তবাড়ীর দূর্গা মন্দির, চন্ডিভোগের জয় দূর্গা মন্দির, সোনাকান্দরের কেন্দ্রীয় মন্দির। তবে সরকারী বিধির কারণে এবং মহামারী করোনার প্রাদুর্ভাবের জন্য পূজোর উৎসাহ বা আনন্দের বহিঃ প্রকাশ প্রতিবারের মত মনে হচ্ছে না এবার।  নিমগাছির পূজারীগন ১৫ জায়গায় ভেনু করলেও জাঁকজমক আজো নিমগাছিতেই বেশী হয়, সেই সাথে ভক্তের সমাগমও। কারণ, এটা এখন শহরের রূপ ধারন করেছে। ৬৭ বছর আগে যারা উৎসবের শুরু করেন তারা নেই কেউ। কিন্তু রয়েছে তাদের বংশধরেরা। সেই সাথে এসেছেন নতুন বসতি ঐ সময়ের দ্বিগুন বা ত্রিগুন এরা। বেড়েছে তাদের সামর্থ, ক্ষমতা, শক্তি, চাহিদা। আজ পূজো হয় ডিজিটাল সিস্টেমে। কলকাতার কোন্ মন্ডপ কিভাবে ডেকোরেশন করা তা দেখা যায় মুহুর্তে। সাইজ সেভাবে করছে পুজা কমিটি অর্ডার দিয়ে সামর্থ মোতাবেক। ঐ সময়ে ইসলামী রিপাবলিক পাকিস্তান সরকার মন্ডপে নিরাপত্তার কোনো দায়িত্ব নেয় নি; ফলে পুজা কমিটিকে সব সামাল দিতে হতো ; আর আজকে সার্বক্ষনিক সরকারী আনসার, পুলিশ, র‌্যাব সহ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর পাহারা মন্ডপ সমুহে। তবুও কেন জানি মনে হয় তখনকার পূজো ছিল আন্তরিকতায় ভরা, অকৃত্রিম ; আর আজকে জৌলুস বাড়লেও তা যেন কৃত্রিমতায় পরিপূণর্,  মেকী, প্রাণহীন আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।

 

 

লেখক: বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট। মোবাইল ঃ ০১৭২৩-৪৬৭০২১

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD