লেখালেখি একটি আর্ট বা শিল্প

Spread the love

সুজন কুমার মাল

মানুষের মনের চাহিদা ও তার অনুভূতিকে লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। অতীতে মানুষ পাথরে খোদাই করে বা তালপাতায় লিখত। মানুষের জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে পড়া-লেখা দুটি বিষয়ের আছে সমান গুরুত্ব। কেননা একটি বাদ রেখে আরেকটি চিন্তা করা সম্ভবপর না। না পড়লে যেমন ভাল লেখা সম্ভব নয়, তেমনি পড়ে না লিখলে সেই পড়াও খুব তাড়াতাড়ি স্মৃতি থেকে হারিয়ে যায়। ফলে প্রয়োজনের সময় তা আর কোন কাজে আসে না।প্রতিটি মানুষই তার অনুভূতিকে লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করতেই বেশি পছন্দ করেন। কেউ চেষ্টা করেন, আবার কেউ অলসতা করে চেষ্টাই করেন না। যখন লেখার ক্ষেত্রে ছিল নানারূপ সীমাবদ্ধতা, তখনও মানুষের লেখার প্রতি তার বহিঃ প্রকাশ লক্ষ্য করা গেছে সুন্দর সুন্দর ছন্দ মিলিয়ে মিলিয়ে লেখা চিঠিপত্রে।

“শিশিরে কি ভেজে মাটি বিনা বৃষ্টিতে, চিঠিতে কি জুড়ায় মন বিনা দেখাতে” কথাগুলো ছিল একসময় স্বল্প শিক্ষিত বাঙালিদের লেখা চিঠির মূল বিষয়বস্তু । আবার সাহিত্য নির্ভর সু-শিক্ষিত অনেকের লেখা চিঠির গুরুত্ব ও মর্ম গভীর প্রেম নিবেদন প্রেমিকার মন কেড়ে নিতো কি না কে জানে ? তারপরও মানুষ লিখে চলেছে এবং ভবিষ্যতেও লিখবে।

একজন লেখক তার মনের অনুভূতি ও উপলব্ধিটা তুলে ধরেন এই লেখার মাধ্যমে। তিনি যেভাবে দেখবেন, সেভাবেই বিষয়টা তুলে ধরবেন তার লেখনিতে। আর এ জন্যই ব্যক্তি বিশেষে ঘটনার বর্ণনা  বা উপস্থাপনা ভিন্ন হয়ে থাকে। প্রত্যক ব্যক্তি তার নিজস্ব চিন্তা ভাবনা ও নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে সেই বিষয় দেখে থাকে এবং তার বহিঃ প্রকাশ করে লেখার মাধ্যমে। আর এ কারণেই একই বিষয়ের উপর বিভিন্ন জনের লেখা বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। এদিকে লেখক হওয়া অনেক কঠিন কাজ। এ জন্য চাই কঠোর সাধনা, নিয়মিত অধ্যাবসায়, প্রতিনিয়ত লেখার অনুশীলন বা চর্চা। নিজেদের যারা লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন তাদের  এধরণের গুণাবলী ছিল ।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে এসকল গুণাবলীর কোনোটাই আমার নাই বিধায় আমি নিজেকে কখনো লেখক মনে করার মত ধৃষ্টতাও দেখাতে চাই না। সুদীর্ঘ চলার পথে অনেক চড়াই উৎরাই পেড়িয়ে এবং অনেক ঘটন অঘটনের সাক্ষী হয়ে আজও তাড়াশের একমাত্র পত্রিকা সাপ্তাহিক চলনবিল বার্তায় বা ফেসবুকে লেখার মাধ্যমে সে সকল ঘটনার বা অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণ করার চেষ্টা করি, যা অনেকের সাথে ভাগাভাগি করে নেয়ার ক্ষুদ্র প্রয়াস মাত্র।

অনেকেই বলেন, এ লেখালেখি করে কী লাভ আছে ? তাদের কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু জীবনের সবকিছু লাভক্ষতির হিসেবে পরিমাপ করে পথচলা সম্ভব ? আমরা টেলিভিশনের সামনে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নানা ধরনের অনুষ্ঠান দেখি। আবার ইন্টারনেটের মাধ্যমে ফেসবুক, টুইটার, গুগোল প্লাস সংস্কৃতিতে আসক্ত হয়ে দীর্ঘ সময় পার করে দেই। এমনকি আমরা অনেকেই এ ধরণের অনেক কিছুই করে থাকি যার পিছনে লাভক্ষতির হিসাব বা কোনো অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে না বললেই চলে। আমার মতো ক্ষুদে লেখকের লেখা নিয়ে এমন মন্তব্যও হয়তো হয়ে থাকে যে, এসকল লেখা পড়ে কে? অনেকে না পড়লেও কেউ না কেউ যে পড়েন তা কিছুটা আঁচ করা যায়। তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমাদের সমাজে পাঠকের সংখ্যা খুবই কম। তাছাড়া দীর্ঘ লেখার পাঠক সংখ্যা কম এবং বলতে গেলে হাতেগোনা কিছু সংখ্যক। কালের পরিক্রমায় পত্রিকা জগতেও আমূল পরিবর্তন এসেছে। পত্রিকার জায়গায় এখন অসংখ্য অনলাইন পত্রিকা চালু হয়েছে। ফলে লেখালেখির সুযোগ যেমন সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি লেখকের সংখ্যাও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে বা পাচ্ছে। এখন যে কেউ ইচ্ছা করলেই লিখতে পারেন এবং তা প্রকাশিত হয় সেটি পাঠকেরা পাঠও করে থাকেন। অথচ একসময় এই সুযোগ সুবিধা খুবই সীমিত ছিল। আজও সেই ধারাবাহিকতা আছে কিছু কিছু লেখকের লেখাসময়ের দাবীতেই লিখতে হয় পাঠকদের জন্য। আবার কিছু লেখা গবেষণা কাজে সহায়ক হিসেবে পরিগণিত হয়। এ জন্য প্রমথ চৌধূরী সাহিত্য সৃষ্টি করা প্রসঙ্গে বলছেন যে ‘‘ যিনি শিব গড়তে পারেন, তিনি বাঁদরও গড়তে      পারেন’’। লেখালেখির মাধ্যমে আমরা দেশ তথা বিশ্বের খোঁজ খবর রাখতে পারি। লেখালেখি আমাদের সংকটকালীন সময়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার অনুপ্রেরণা যোগায়। আজও একটি কথা লেখার সময়ে ভাবিয়ে তুলে প্রত্যক লেখককে বোধহয় সেটা হল, লেখা কোন্ বিশেষ  শ্রেণীর পাঠকের জন্য লেখা হবে ? না প্রত্যক শ্রেণীর পেশার পাঠকের জন্য লেখা হবে ? যার ফলে লেখার বিষয়বস্ত সহজেই বোধগম্য হয়।আর আমার কাছে লেখালেখি করা মানেই জীবন দর্শন ।

দৈনিন্দন জীবনের প্রতিনিয়ত ভাঙ্গা গড়ার খেলা চলে। আমাদের জীবনে স্বপ্ন, দ্বন্দ্ব , সংঘাত , বিরহ , মিলন ,আশা, আকাঙ্খা, সাফল্য, ব্যর্থতা , অনুপ্রেরণা সব বিষয়ের কথা আর শব্দ দিয়ে লেখকেরা লেখালেখির মাধ্যমে আমাদের সামনে তুলে ধরেন তাদের সেই অভিজ্ঞতা। আমরা তাইতো অনেক বিখ্যাত লেখকের লেখা পড়ে অনুধাবনের পরে শত দুঃখ,কষ্টের মাঝেও আশার আলো দেখতে পাই আর স্বপ্নের জাল বুনে চলি আপন মনে। সবশেষে মনে রাখা ভাল, লেখালেখি একটা আর্ট বা শিল্প; সৃষ্টিশীলতা ও মননশীলতা যার এক ধরনের পূঁজি হিসেবে কাজ করে। তাছাড়া সত্য ও সুন্দরের অর্চণা ও মানবতার সুরধ্বনি এই শৈল্পিক তরঙ্গে অনুরণন তুলে ইতিবাচক সমাজ তৈরীতে বিশাল ভূমিকা রাখে। তাই প্রকৃতির ঐশ^রিক সৃষ্টি আর মানুষের নান্দনিক সৃষ্টি দুইয়ের মিলনে এ ধরাধাম হয় অতুলনীয় অপরুপ সুন্দর যেটাকে আমরা মানুষের মাঝেই স্বর্গীয় আমেজ বলে কখনো আখ্যায়িত করে থাকি।

 

সুজন : তরুণ লেখক ও সাংবাদিক।

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD