সুজন কুমার মাল
দেখতে দেখতে পুরো একটি বছর আমরা কাটিয়ে ফেললাম৷ বিদায় নেওয়ার পালা ২০১৯৷ অন্যদিকে দরজায় কড়া নাড়ছে ইংরেজী বছর ২০২০৷ বাঙ্গালী সহ বিশ্ববাসীদের কাছে ১ জানুয়ারী দিনটি একটি নতুন মাত্রা নিয়ে আসে৷ ইংরেজী নববর্ষকে নিয়ে বিশ্ববাসীর যে উন্মাদনা দেখা যায় তাতে আমরা বাঙালীরা যতটা ধুমধামের সঙ্গে ইংরেজী নববর্ষ উদযাপন করি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ দিনটিকে উদযাপন করতে পাড়ায় পাড়ায় সাউন্ড বক্স বাজিয়ে বনভোজনের আয়োজন রাত্রি ১২টার দিকে কেক কর্তন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বাঙালীরা আত্ম বিস্মৃত জাতি হিসেবে নিজেকে দেখতে ও দেখাতে খুশি হই আমরা৷তাইতো আমরা থার্টি ফার্স্ট নাইট পালন নিয়ে এতা মেতে উঠি যে পুলিশ ও প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা দিতে হয়।
কিছু দিন পুর্বে আমরা মহান বিজয় দিবসে সকল শহীদদের স্মরণে ও মুক্তিযোদ্ধাদের সং^ধর্না দেয়া সহ নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে বিজয় দিবস অনুষ্ঠান করলাম৷ বিশেষ বিশেষ উৎসব পার্বন ক্ষেত্রে আমরা নিজেদের বিখ্যাত প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে উঠি৷বিশ্বায়নের প্রভাবেই হোক বা নিজেদের জাতিগত ঐতিহ্যকে বহন করতে না পারার অক্ষমতা হোক বাঙালীর আজ চরম দুর্দশার দিন৷ এত সুন্দর বিজয় দিবস পালনের পরই আমরা রাজাকার আর মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেললাম।
যতদিন যাচ্ছে তত আমরা নিজেদের ভাষা সংস্কৃতি ভুলে অন্য ভাষা সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হয়ে উঠছি। আমরা ভুলে গেছি একদিন এই বাংলার বুকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গান ধরেছিলেন ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি৷’ অথবা উনিশ শতকের অন্যতম কবি জীবনানন্দ বলে ছিলেন ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি / পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে চাই না আর’ বাঙ্গালীর জীবন চর্যার অভিজ্ঞানে বিদেশী আদব কায়দা খুব সহজেই গ্রহণ করা হয়েছে৷
এদিকে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ইংরেজী মাসের আলোকেই স্কুল, কলেজ অফিশিয়াল কর্মসূচী গ্রহণ ও পালিত হয়ে থাকে৷ তাই হয়তো বাংলা সন, তারিখ জানাটা অত গুরুত্বপূর্ণ নয়৷এমনকি আমদের বড় বড় নেতাদের ছেলেমেয়েরা বিদেশে পড়ে। আর তারা এখানে শিক্ষানীতি ফলায়। কিন্তু সকল কিছুকেই যদি কাজের সুবিধার্থে সহজ করে নেওয়া হয় তাহলে তো নিজেরই ক্ষতি ৷
একবার ভেবে দেখুন তো ২৫ বৈশাখ বলতে বা শুনতে যে আত্মীয়তার সুর মনের সেতারে বেজে ওঠে সেটা কি কোন ইংরেজী তারিখের মধ্যে পাওয়া যায় ?
বর্তমান প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা বাংলার তারিখ টাতো দূরের কথা, বাংলার সালটিও হয়তো ঠিক করে বলতে পারবে না৷ আমরা যুগের প্রয়োজনে একটা বিষয়কে যতটা প্রাধান্য দেই কিন্ত অন্য বিষয়টিকে ততটাই অবহেলা করবো কেন ?
এবার আমাদের সংস্কৃতির দিকে চোখ ফেরানো যেতে পারে৷ এই যে বর্তমান সময়ে সকল চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হচ্ছে তার মধ্যে বাঙালীয়ানার দেখা নেই বললে চলে৷ বাংলা গানের মধ্যে হিন্দী গানের লাইন৷ বাঙালী পোশাক পরিচ্ছদ, খাদ্যাভাস সব কিছুই বর্জিত। আর ঠিক এই জায়গা থেকেই আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে৷ আমাদের স্বাজাত্যাভিমানকে বিসর্জন দিতে হবে। সুস্থ সংস্কৃতির চর্চার ধারক ও বাহক হিসেবে যে বাঙালীর একদিন সুখ্যাতি ছিল আজ তা ভুলে যেতে বসেছি আমরা৷ এই অবনমন কি চলতেই থাকবে ? বুদ্ধিজীবীরা নিশ্চয় এর উত্তর খুঁজবেন৷
আমাদের বলার কথা যেটা সেটা হল বাঙালী অবশ্যই বিদেশ পাড়ি দেবে, উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হবে, আরো অনেক কিছুই করবে কিন্তু যেটা করবে না সেটা হল নিজের জাতিগত অস্তিত্বকে বিসর্জন দেবে না৷ নিজস্ব জাতিসত্ত্বা ও দেশীয় সংস্কৃতিকে সবার উপরে স্থান দিতে হবে।
এবারের ইংরেজী নববর্ষে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার৷
লেখকঃ তরুণ সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক ।