বাবুল হাসান বকুল
যে কোন জাতীর উন্নয়ন, অগ্রগতি, শান্তি ও সমৃদ্ধির মূলে শিক্ষা। তাই শিক্ষাকে জাতীর মেরুদন্ড বলা হয়ে থাকে। বিশে^র উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, তাদের উন্নতির মূল ভূমিকায় রয়েছে শিক্ষা। শিক্ষাই পারে একটি দেশের জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রুপ দিতে। তাই আমাদের দেশের সরকার দেশের জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করার জন্য দেশের সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারীকরণ, নিন্ম-মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ সুন্দর শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছেন। এর প্রেক্ষিতে ২০১০সাল থেকে প্রথম থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ করে আসছে সরকার। দেশের ৪৬টি পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়গুলোর পাশাপাশি দেশের সকল জেলা ও অনেক উপজেলায় জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের অধীনে ছাত্র-ছাত্রীদের স্নাতক/ সমমান পাশের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং দেশের ১০৪টি বে-সরকারি বিশ^বিদ্যালয় গড়ে উঠেছে শিক্ষার আলো ছড়ানোর লক্ষ্যে। মোট কথা জাতীকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার সকল পরিবেশ রয়েছে দেশে। আগের তুলনায় ১০ থেকে ১২ বছর ধরে দেশে সকল পরিবারের অভিভাবক সচেতন হয়েছেন। নিজেদের শত কষ্টের মাঝেও সন্তানদের শিক্ষা লাভের জন্য কতই না পরিশ্রম করছেন। তাদের আশা, শিক্ষা লাভ করে তার সন্তান একদিন দেশ ও দশের হয়ে কাজ করবে। গর্বে ভরে উঠবে পিতা-মাতা ও আত্নীয় স্বজনের মন। অনেক আদর যত্নে বড় করে উচ্চ শিক্ষার জন্য জাতীয়, পাবলিক কিংবা বে-সরকারি বিশ^বিদ্যালয়ে পাঠায় অভিভাবকরা। আশা, দুঃসময়ে নিজের ও দেশের পাশে থাকবে তার সন্তান। শত আশা নিয়ে বেঁচে থাকার পিতামাতা যখন আশা ভরা চোখ দিয়ে ছেলের রক্তমাখা কিংবা আঘাতে জর্জরিত নিথর মৃতদেহ দেখে এবং স্নেহমাখা দুহাত দিয়ে মৃত দেহ জড়িয়ে ধরে তখন পিতামাতা ও আত্নীয় স্বজনের মনের দিক থেকে কতটা আঘাত পায় তা অন্য কারো কল্পনার বাইরে। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মোড়কে মোড়ানো ছাত্র সংগঠন দ্বারা ছাত্র হত্যা আজ নতুন কোন কথা নয়। সবগুলো হত্যাকান্ডই আমাদের দেশ ও দেশের মানুষকে নাড়া দিয়ে যায়। গত ০৮ অক্টোবর জাতীয় দৈনিক পত্রিকার প্রধান সংবাদ বুয়েটের ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা। খবরটি শোনার পর আবারো শিক্ষাঙ্গণগুলো নিয়ে ভাবতে থাকে সারা দেশ। হত্যার শিকার হয় বুয়েট তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক্স বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদ। এই হত্যাকান্ডের পিছনে নাম উঠে আসে ছাত্রলীগের। আবরার ফাহাদ গত ০৫ অক্টোবর ফেসবুকে একটি ষ্ট্যাটাস দেয় প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর নিয়ে। আমরা বাংলাদেশের কোন নাগরিক রাষ্ট্রদ্রোহী কোন ফেসবুকের ষ্ট্যাটাসকে সমর্থন করি না এবং কোন হত্যাকান্ডকেও সমর্থন করি না। কেননা কোন ব্যক্তি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কথা বললে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। ব্যক্তিগত সম্মানহানী করলে সে ব্যক্তি ঐ ব্যক্তির বিরুদ্ধে সম্মানহানীর মামলা করবে এটাই স্বাভাবিক। ব্যক্তিগত কারণে কাউকে হত্যা করলে তার দায়ভার হত্যাকারকেই নিতে হবে এবং যার দ্বারা রাষ্ট্রের সম্মানহানী হচ্ছে তাকেও হত্যা করলে তার দায়ভার হত্যাকারকেই নিতে হবে। কেননা রাষ্ট্র কোন হত্যাকান্ডকে সমর্থন করে না।
গত ০৬অক্টোবর নির্যাতনে হত্যার শিকার আবরার হত্যার দায় বুয়েট ছাত্রলীগকেই নিতে হবে। ঐ হত্যাকান্ডের পরে ১৯জনকে আসামী করে থানায় মামলা করে আবরার ফাহাদের বাবা। পরে ০৯ জনকে আটক করে পুলিশ। ঐ হত্যাকান্ডের পর ঐ বিশ^বিদ্যালয় সহ সকল বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ হয়। প্রতিবাদ দেখে মনে হয় ছাত্রসমাজ আজও ঘুমিয়ে যায় নি। কিন্তু দূর দৃষ্টি থেকে যখন দেখি তখন চোখে ভেসে উঠে আজ যে সব ছাত্র সংগঠণ আবরার হত্যার প্রতিবাদ করছে তারাও অতীতে কোন না কোনভাবে ছাত্র হত্যার সাথে জড়িত। বর্তমানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় তাই ছাত্রলীগ দেশের সকল বিশ^বিদ্যালয় এবং সকল শিক্ষ্ াপ্রতিষ্ঠানের ক্ষমতার শীর্ষে। ছাত্রলীগের আগে ছাত্রদল, ছাত্রশিবির তারাও কম করেন নি এবং যে সব বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলোর কাঁেধ ভর করে ক্ষমতায় থাকেন তারাও দায় অস্বীকার করতে পারেন না। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় ছাত্রলীগের হাতে ছাত্রনেতা, ছাত্রনেতার হাতে ছাত্রলীগ, ছাত্রশিবিরের হাতে ছাত্রলীগ, ছাত্রলীগের হাতে ছাত্র শিবির, শিবিরের হাতে ছাত্রসমাজ নেতা, ছাত্রমৈত্রী, জাসদ নেতা, ছাত্রদল যুবলীগ সংঘর্ষে নিহত ছাত্র ইউনিয়নের নেতা এবং অনেক সময় সাধারন ছাত্রও নিহত হয়েছে। ভাষা আন্দোলন, গণ অভূত্থান এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া ছাত্র সমাজের গৌরব মাখা ইতিহাস রয়েছে। আজ ছাত্র সমাজ বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক পোশাকে সজ্জিত হয়ে বিভিন্ন সময়ে হত্যাকান্ড চালায় রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কিংবা নিজেদের ক্ষমতা জানান দিতে। শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে আলোর পথের সন্ধান করতে এসে রাজনৈতিক দলের খাতায় নাম লিখিয়ে অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে তারা। আপনি আমি আমরা সবাই মাদক, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজী বন্ধের জন্যে রাজপথে মিছিল ও মানববন্ধন করছি। পুলিশ প্রশাসন দিন রাত পরিশ্রম করছে। তবুও কি ঐসব বন্ধ করতে পেরেছি আমরা। কেননা রাজনৈতিক দলের ছায়ায় ছাত্রদের বিশ^বিদ্যালয়ে অবৈধ কাজের হাতেখড়ি হচ্ছে। শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য থেকে সরে গিয়ে ছাত্র সমাজ রাজনীতিকে তাদের জীবনের মূল লক্ষ্য মনে করছে। আবরার হত্যা নিয়ে যখন সারাদেশে যখন ব্যাপক আলোচনা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। তখন ১০ অক্টোবর সাড়ে ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ১০তলা বিশিষ্ট নোয়াখালী চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট ভবনের উদ্ধোধন শেষে দুপুরে সাংবাদিকদের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, আবরার হত্যা মামলা দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষ করা হবে। আইনমন্ত্রীর ঐ কথা শুনে আমরা দেশবাসী নতুনভাবে স্বপ্ন দেখি কোন বিশ^বিদ্যালয় ছাত্র সংগঠন দ্বারা ছাত্র হত্যার বিচার দ্রুত হবে শুনে যদি আবরার হত্যার বিচার দ্রুত হয় তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম কোন বিশ^বিদ্যালয় ছাত্র হত্যার বিচার হবে। কেননা স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশের বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে আবরার সহ খুন হয়েছে ১৫১ জন। এখনো শাস্তি পায়নি কেউই। আবরার বিচারের মাধ্যমে বিশ^বিদ্যালয় ছাত্র হত্যার বিচারের শুভ সুচনা ঘটবে। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ৭ খুনের ঘটনা ঘটে। স্বাধীনতার পরবর্তী সময় বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষার্থী খুনের ঘটনা এটাই প্রথম। এই ঘটনার ৪ বছর পর শফিউল আলম প্রধানসহ অন্যান্য অভিযুক্তদের আদালতে সাজা প্রাপ্ত হন। কিন্তু পরবর্তীতে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে তারা মুক্তি পান। সবচেয়ে বেশী হত্যাকান্ড হয়েছে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে। সেখানে খুন হয়েছেন ৭৪ জন। রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে ২৯ জন, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে ১৯ জন, বাংলাদেশ প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ে ১৯ জন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ে ৭ জন, ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ে ২ জন, বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ^বিদ্যালয়-বুয়েটে ২জন, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় এবং হযরত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ে ১জন করে শিক্ষার্থীকে হত্যা করা হয়। এসব খুনের ঘটনার কোন আসামী শাস্তি মুখোমুিখ হয়নি আজও। বাংলাদেশের অনেক বড় বড় কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরাই লেখাপড়া করে তা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। অনেকে বলে থাকেন বিশ^বিদ্যালয় মেধাবী শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ নিরাপদ পরিবেশ দিতে হবে। আমরাও চাই বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষার সুন্দর পরিবেশ বজায় থাকুক এবং বিশ^বিদ্যালয়গুলোর পাশাপাশি দেশের সকল শিক্ষাঙ্গণ নিরাপদ শিক্ষার পরিবেশ শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ছাত্র সংগঠনের নামে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় ছাত্র সংগঠনগুলো নিজেদের দলের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ছাত্র হত্যা ও নানা ধরনের অপরাধ করছে। এতে রাষ্ট্রের আইন শৃংঙ্খলার উপর যেমন আঘাত আসছে তেমনি ধর্মঘটের নামে সেশন জট সহ নানা মূখী সংকটে পরতে হচ্ছে কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসনকে। দেশ পরিচালনার জন্য যেমন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার প্রয়োজন তেমনি চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর প্রয়োজন আছে। তাই মেধাবী শিক্ষার্থী হোক আর নাই হোক শিক্ষার্থী হিসাবে সকলের নিরাপদ শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। অনেকেই ছাত্র রাজনীতিকে বন্ধের কথা বলছেন। আমি ছাত্র রাজনীতি বন্ধ নয় বরং শিক্ষাঙ্গনে দলীয় ছাত্র রাজনীতি বন্ধের কথা বলছি। আমরা ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার কথা বলে অন্যর অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করব না। কেননা বাংলাদেশসহ বিশে^র সকল দেশ জনসংখ্যার কারণে বেশিরভাগ দেশেই জনগণ প্রত্যক্ষভাবে দেশে পরিচালনা করতে পারেন না। পরিচালনা না করে প্রত্যক্ষভাবে ভোটের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করে থাকে। দেশ পরিচালনার জন্য এবং দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর শিক্ষিত নাগরিককে দলে ভেড়াতে দলের অংশ হিসেবে ছাত্র সংগঠন তৈরি করছে। এটা সকল রাজনৈতিক দলগুলোর নিজস্ব অধিকার। আজ রাজনৈতিক দলগুলো সেই অধিকারকে জাতীয় মেরুদন্ড ভেঙ্গে টিকিয়ে রাখতে চাইছে। শিক্ষাঙ্গণে দলীয় রাজনীতি বন্ধ হোক দেশের সচেতন মানুষ চাইলেও শিক্ষাঙ্গণে জাতীকে তৈরি করার মহান মানুষ শিক্ষকগণ তা চাইছেন না। কেননা তারা শিক্ষাঙ্গণে ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে নিজেদেরকে ছাত্র রাজনীতিতে ভালভাবে জড়াতে পারেন এই কারণে। গত ৪ নভেম্বর রাজশাহী পলিটেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট এর অনাকাঙ্খিত ঘটনার তাকালে দেখা যায়, জোহরের নামাজ শেষে কলেজের অধ্যক্ষকে একদল শিক্ষার্থী পুকুরে ফেলে দেয়। এটা শিক্ষক হিসেবে কতটা অপমানের তা তিনিই জানেন। যদি শিক্ষাঙ্গণে দলীয় রাজনীতি না থাকত তাহলে কখনো কোন ছাত্রের পক্ষে তা করা সম্ভব হতো না। অনেকে বলতে পারেন এটা ক্ষমতাশীন দলের ছাত্রলীগের কাজ। আমরা দেশের মানুষ ছাত্রলীগ বা কোন দল বুঝি না। এর জন্য শিক্ষক সমাজই দায়ী। যে শিক্ষকের সম্মান সমাজের সর্বোচ্চ স্তরে সেই শিক্ষক সমাজ আজ নিজেদের সম্মানকে রাজনৈতিক দলের পায়ের নিচে খুঁজছেন। অনেকে বলতে পারেন আমি শিক্ষকদের সম্মান দিতে জানি না। আজ লেখার মাধ্যমে আপনাদের যা তুলে ধরেছি তা মহান শিক্ষকদের কাছ থেকেই পাওয়া।
আপনারা সবাই চান ক্ষমতায় এসে বা থেকে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দিতে। দেশের মেরুদন্ড ভেঙ্গে কখনো রাষ্ট্রের প্রকৃত মঙ্গল হয় না। তাই বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন ও দেশের সকল রাজনৈতিক দল ও সরকার জাতীর কথা ভেবে শিক্ষাঙ্গণে দলীয় রাজনীতি বন্ধ করবে তাহলেই শিক্ষাঙ্গণে ছাত্র হত্যা, জুলুম, নির্যাতন বন্ধ হবে এবং জাতীর মেরুদন্ড তার স্বাভাবিক গতিতে আলো দিয়ে জাতীকে আলোকিত করে আগামীর উন্নত জাতী উপহার দিবে।
বাবুল হাসান বকুল, সাংবাদিক ও কলাম লেখক, সিংড়া। মোবাইল: ০১৭৫০-৭৫৬২৯১