সৈয়দ সাইদুর রহমান সাঈদ
১০ ডিসেম্বর ২০১৯ বিশ^ মানবাধিকার দিবস। বৎসর পরম্পরায় বিশে^র প্রায় সব দেশেই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। ১৯৪৮ সালের এই দিনেই যুগান্তকারী দলিল সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা গৃহীত হয় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকে। এটি অনুষ্ঠিত হয় ফ্রান্সের প্যারিসে চধষধরং ফব পযধরষষড়ঃ-এ। এই ঘোষণাটির খসড়া প্রণীত হয় ইলিয়নর রুজভেল্টের নেতৃত্বে। ইনি ছিলেন জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। এই খসড়ায় সার্বিকভাবে সহায়তা করেন প্রফেসর জন হামফ্রে। তিনি তদানিন্তন মানবাধিকার বিভাগের প্রথম পরিচালক। এই কমিটিতে অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন : রেনে কাসিন- ফ্রান্স, চার্লস মালিক-লেবানন, পেংচুন চ্যাং-চীন, হারনান সান্তাক্রজ-চিলি, আলেকজান্দ্রে বেগমোলভ আলেক্সিপাভলভা- সোভিয়েত ইউনিয়ন, লর্ড ডুকেসতন, জিওফ্রে উইলসন- যুক্তরাজ্য, উইলিয়াম হজসন-অস্ট্রেলিয়া, মিসেস হৌসা মেহতা- ভারত, কার্লোসপির মূলো- ফিলিপাইন এবং রিবুইকার- যুগোস্লোভিয়া। এ ঘোষণার পক্ষে ৪৮টি দেশ ভোট প্রদান করেন। কিন্ত ৮টি দেশ ভোট প্রদানে বিরত থাকে (তৎকালিন সোভিয়েত ব্লক, দক্ষিন আফ্রিকা ও সৌদি আরব)। এই ঐতিহাসিক দলিলটি ৩০ অনুচ্ছেদ সম্বলিত। এতে সকল মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ করা হয়েছে খুবই যত্ন সহকারে। রাখা হয়েছে সব শ্রেণী পেশার মানুষের মর্যাদা সমূন্নত। তারা প্রথম বারের মত রাজনৈতিক বা নাগরিক অধিকারের পাশাপাশি সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। দলিলটি উন্নত বিশে^ ধনী ও উন্নয়শীল বিশে^ দরিদ্র সকলের কাছেই সার্বজনীন করে তোলেন। মূলত: তিনটি কারণে সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণাটি আন্তর্জাতিক প্রথাগত আইন রূপে (কাষ্টমারী ইন্টারন্যাশনাল ল) পরিগৃহীত হয়। এর প্রথম ক্ষেত্র আন্তর্জাতিক আইন ও চুক্তি প্রণয়ন। এর ধারাগুলির আলোকে আজ পর্যন্ত বেশ কিছু আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। ঘোষণাটির দ্বিতীয় প্রভাবের কারণ হচ্ছে: আফ্রিকা, এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকা সহ বিভিন্ন দেশের জাতীয় সংবিধান, আইন, আদালত সমস্তই মানবাধিকার ঘোষণা দ্বারা প্রভাবান্বিত। আমাদের বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায় অর্থাৎ মৌলিক অধিকার অধ্যায়টি উক্ত ঘোষণার আলোকেই রচিত। এই ঘোষণার ব্যাপক প্রভাবের তৃতীয় কারণটি সম্ভবত: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এটি হচ্ছে জাতিসংঘ কর্তৃক সকল সিদ্ধান্তের ক্ষেত্র। বলাবাহুল্য ১৯৪৮ সালের ঘোষণাটি গৃহীত হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবী ব্যাপী যখন যেখানেই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে তখনই জাতিসংঘের বিভিন্ন সিদ্ধান্তে তা বারবার উচ্চারিত হয়েছে। সমর্থিত হয়েছে সকল রাষ্ট্রের প্রতিনিধি কর্তৃক।
জাতিসংঘ সনদের মূখবন্ধে বলা হয়েছে মৌলিক মানিবাধিকার মানুষের মর্যাদা ও মূল্যবোধ ক্ষুদ্র ও বৃহৎ জাতি নির্বিশেষে সমান অধিকারের প্রতি আস্থা স্থাপনে জাতিসংঘভূক্ত জনগণ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তাই জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পেছনে উদ্দেশ্য ৪টি- (১) মনবাধিকার সংরক্ষণ, (২) শান্তি, (৩) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং (৪) উন্নয়ন। এই ৪টি লক্ষ্য উদ্দেশ্যকে সমন্বিত করার জন্য জাতিসংঘের অনেক কৃতিত্ব ও অবদান রয়েছে। জাতিসংঘের কৃতিত্ব ও অবদানের পাশাপাশি অনেক ব্যর্থতার ইতিহাসও বিদ্যমান। সম্ভাব্য যুদ্ধ, সংঘাত, প্রতিরোধ, যুদ্ধোত্তর শান্তি প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, বর্ণ বৈষম্য দূর, সহিংসতার অবসান, গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ,সন্ত্রাস দমন, তৃতীয় বিশে^র দারিদ্র বিমোচন এবং উন্নয়ন। এসব ক্ষেত্রে জাতিসংঘের ব্যর্থতা সুস্পষ্ট। বিশ^ বিবেকের কাছে হুমকির সম্মূখিন জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য মানবাধিকার সংরক্ষণ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, শান্তি এবং উন্নয়ন। জাতিসংঘ এখন সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মত ব্যর্থ। এছাড়া অনেকে মনে করেন ,জাতিসংঘ বৃহৎ শক্তিধরদের হাতে বন্দি। যেহেতু নিরাপত্তা পরিষদের ৫টি স্থায়ী সদস্য দেশের (যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া এবং চীন) অবস্থান নিয়ে নানা প্রশ্ন। তারা ইচ্ছা করলেই জাতিসংঘের যে কোন প্রভাব প্রতিপত্তি খর্ব করতে সক্ষম। এই পঞ্চ ব্যুহ ভাঙারও দাবি উঠেছে ইতোমধ্যে।
এদিকে জাতিসংঘকে বৃহৎ শক্তিধরগণ হাতের পুতুল বানিয়ে রেখেছে। যদি জাতিসংঘ এই পুতুল রূপেই থাকে তাহলে বিশে^র শান্তি সুদুর পরাহত। যেখানে শান্তি নাই সেখানে মানবাধিকার শব্দটি প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়। বর্তমানে আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইরান,ইরাক, লিবিয়া, লেবানন, উত্তর কোরিয়া, ফিলিস্তিন সহ অনেক দেশই এই প্রহসনের হিটলিস্টে। এদিকে মিয়ানমারের স্মরণকালের বর্বর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা আন্তর্জাতিক আদালত অবধি গড়ালেও রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরৎ নেয়ার কোন ভূমিকাই সšোÍষজনক নয়। অপরদিকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে অবস্থানরত ৭ লক্ষ রোহিঙ্গা কতটা সুরক্ষিত তা ভাববার বিষয়। ইদানিং ভারতের মহারাষ্ট্রে এন.আর.সি নিয়ে বিক্ষোভে প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছে অনেকেই। তবুও সে দেশের সরকারের ভূমিকায় বাজছে উল্টো সুর যা ধর্ম নিরেপেক্ষ ভারতের আদর্শকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। তারা হিন্দুত্ববাদের উগ্রতায় মেতে উঠেছে।
পরিশেষে বিশ^ মানবাধিকার দিবসে জাতিসংঘের কাছে বিশ^বাসির আবেদন- বিশ^ শান্তি রক্ষায় তার কার্যকরী ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া বাঞ্চনীয়। সন্ত্রাসমুক্ত, নিপীড়নমুক্ত, , নির্যাতনমুক্ত, ন্যায় বিচার, মানবাধিকার ও শান্তি প্রতিষ্ঠা হোক সারা বিশে^। এই প্রত্যাশায় সফল হোক ২০১৯ সালের বিশ^ মানবাধিকার দিবস।
লেখক: কবি, সাহিত্যিক ও কলামিষ্ট। মোবাইল ঃ ০১৮৬৬২৩২০৯২