চলনবিলের অতীত ও বর্তমান

Spread the love

সৈয়দ সাঈদুর রহমান সাঈদ

চলনবিলের অতীত কথা ঃ “ বিল দেখতে চলন, গ্রাম দেখতে কলম, শিব দেখতে তালম” এই প্রবাদটি এখনও চলনবিল অঞ্চলের সকলের মুখে মুখে ফেরে। ভারত উপমহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিল হচ্ছে চলনবিল। অতীতে এই বিল ছিল সমুদ্রের গর্ভে। অনার্যদের ভারত বর্ষে বসবাস প্রায় ৫ হাজার খ্রিষ্ট্র পূর্বাব্দে এবং আর্যদের ভারত বর্ষে  আগমন প্রায় ৩ হাজার খ্রিষ্ট্র পূর্বাব্দে। বাংলা ব-দ্বীপে মানুষের বসবাস আনুমানিক ১০-১২ হাজার বছর পূর্ব থেকে। বাংলাদেশের উত্থান সাগরের বুক চিরে। সমুদ্র হতে সাগর, সাগর হতে সায়র, সায়র হতে হাওর, বাওর এবং বিল শব্দের উৎপত্তি। বাংলাদেশের সর্ববৃহত্তম বিল হচ্ছে এই চলনবিল। এর পেট চিরে ৫০টিরও অধিক নদ-নদী ছিল প্রবাহমান। পদ্মা ও যমুনার পানি উপচে নদ-নদী বয়ে প্রবাহিত হতো চলনবিলে। এই প্রবাহিত হওয়ার কারণেই সম্ভবত এই বিলের নাম করণ হয়েছে চলনবিল। চলনবিল শুধু একটিমাত্র বিল নয়। এর গর্ভে রয়েছে চালতির বিল, চাকল বিল, খৈলসাগাড়ী বিল, বিল কুড়ালী ইত্যাদি নামধারী ছোট -বড় প্রায় শতাধিক বিল।

চলনবিলের ভৌগলিক আয়তন ঃ চলনবিল একটি বৃহত এলাকা। অধ্যাপক এম.এ হামিদ লিখিত “চলনবিলের ইতিকথা” বইয়ের বর্ণনানুযায়ী তৎকালে এর আয়তন ছিল প্রায় সাড়ে নয়শত বর্গমাইল। এর মধ্যে রয়েছেÑ পাবনা জেলার ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর, ফরিদপুর, সাঁথিয়া, সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ, রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া, শাহজাদপুর, নাটোর জেলার গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম, সিংড়া, বগুড়া জেলার নন্দীগ্রাম, নওগাঁ জেলার সান্তাহার এবং আত্রাই এই চৌদ্দটি উপজেলা চলনবিলের আওতাভুক্ত। ১৯১৪ সালে সারা হতে সিরাজগঞ্জ রেলপথ চালু হলে চলনবিল দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পরে। এরপর ষাটের দশকে নাটোর-বগুড়া এবং বগুড়া-পাবনা পাকা রাস্তা চালু হওয়ার ফলে চলনবিল আরো একবার দ্বিখন্ডিত হয়। এদিকে তাড়াশ-বাঘাবাড়ী ওয়াপদাবাঁধ নির্মাণ ও হাটিকুমরুল-বনপাড়া মহাসড়ক চলনবিলের বুক চিরে যাওয়ায় যোগাযোগের উন্নয়ন হলেও চলনবিলের পানি নিষ্কাশন ব্যাহত হচ্ছে, বিল হয়েছে সংকুচিত। এসব কারণে সাঁথিয়া,ফরিদপুর, আত্রাই, সান্তাহার এবং শাহজাদপুরকে বর্তমানে অনেকেই চলনবিলের বাইরে মনে করেন। কিন্তু পূর্বে এগুলি চলনবিলের  আওতাভুক্ত ছিল।

মাছ ও পাখির দেশ চলনবিল ঃ মহাভারতে উল্লেখিত “মাছ পাখির দেশ” বলতে সম্ভবত চলনবিলকেই বোঝানো হয়েছে। মাছে-ভাতে বাঙ্গালী প্রবাদটির অর্থে চলনবিল ছিল মাছের মৎস্য ভান্ডার। ষাটের দশকে প্রায় ৫১ প্রজাতির প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। এসব মাছ পাওয়া যেত ফুলজোড়, আত্রাই, গুমানি, নাগোর, গুর, বরাল, গরদহ, নন্দকুজা, নারোদ, করতোয়া, তুলসী, চেচুয়া, ভাদাই, চিকনাই, বানগঙ্গা, নবীর হাজির জলা, হক সাহেবের খাল, নিয়ামত খাল, ছাত্তারের খাল, কিনু সরকারের ধর, বেশানীর খাল, গুমানী খাল, মাগুড়া খাল, দোবিলা খাল, বেহুলার খারি, বাকাই খারি, বের খারি খাল ইত্যাদি। এসব সদী খালের দু-চারটি ছাড়া অধিকাংশই এখন মরা নদী ও মরা খালে পণিত হয়েছে। এগুলি পূণঃ খনন করা অতিব প্রয়োজন একমাত্র চলনবিল উন্নয়নের স্বার্থে। মৎস্য বিভাগের জরিপ মতে এখন অনেক প্রজাতির দেশীয় মাছ বিলুপ্ত প্রায়। এই মাছ বিলুপ্তির কারণ হিসেবে জানা যায়, উচ্চ ফলনশীল ইরি-বোরো ধান চাষে ব্যবহার হচ্ছে কিটনাশক বিষ, সার, পানি দুষণ, পানি স্বল্পতা ইত্যাদি। বর্তমানে যেখানে মিঠা পানি পাওয়াই দূষ্কর সেখানে মিঠা পানির দেশজ মাছ পাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। এখন যত্রতত্র পুকুর খনন করে চলছে আর্টিফিশিয়াল মাছ চাষ। আর তাতে দেয়া হচ্ছে ব্যাপক দূষিত পদার্থ। ফলে পুকুরের দীর্ঘ আবদ্ধ পানি পর্যন্ত নষ্ট হয়ে গেছে। পূর্বে চলনবিল এলাকায় যাযাবর পাখিসহ নানা প্রজাতির পাখির ডাকে চলনবিল অঞ্চল থাকতো মূখরিত। বর্তম নে আর সেসব পাখির দেখাও তেমন মিলে না চলনবিল এলাকায়। পাখিদের খাদ্যাভাব ও আশ্রয়ের অভাব ও শব্দ দূষণসহ নানা কারণেই এসব পাখি আর দেখা যাচ্ছে না। আগের দিনে আমন ধানের আবাদ হতো চলনবিল অঞ্চলে। তাতে পাখিদের খাদ্য জমিতে প্রচুর পরিমাণে পড়ে থাকতো। এখন সেসব পাখিও বিলুপ্ত প্রায়। শুধু তাই নয় জলজ প্রাণি যেমন ঃ কেঁচো, কাঁকড়া, ঝিনুক, শামুক এসবও বিলুপ্তির পথে। দেশী প্রজাতির ফসলের সাথে সাথে বিলুপ্ত হচ্ছে দেশী প্রজাতির মাছ, পাখি, জলজ প্রাণি ও জলজ উদ্ভিদ।

বর্ষাকালে চলবিল এলাকার যাতায়াত ঃ পূর্বে আষাঢ় হতে কার্তিক মাস পর্যন্ত চলনবিল এলাকায় থাকতো অথৈয় পানি। লোকজন যাতায়াত করত নৌযানে। এসব নৌকা চলত দাঁড় বৈঠা টেনে এবং বাতাসের সাহায্যে লাল, নীল, সাদা-কালো নানা রঙ এর বাদাম উড়িয়ে মানুষ যাতায়াত করত। ব্যবহার হতো ডিঙ্গি নৌকা, ছিপ নৌকা, পানসি নৌকা, বজ্রা নৌকা এবং তালের ডোঙ্গা। বর্তমানে চলছে যন্ত্রচালিত নৌকা। শাপলা ,শালুক ,শিঙ্গুট , ঢ্যাঁপ এবং বিবিধ জলজ উদ্ভিদ জন্ম নিত চলনবিলের বুকে। মাছ ধরার জন্য আসত পানি কাউর, কাইম, ডুবারু, ইচাবক, কানাবক, গোবক, মাছরাঙ্গা, কুড়া, উকাশ, চিল ও গাংচিল ইত্যাদি পাখি। এখানে পানি ছিল সচ্ছ এবং নির্মল। এ অঞ্চলে ছিলো হাজার হাজার পুকুর ও জলাশয়। মাটির কূপ এবং ইঁদারা(পাকা রিং) কূপের পানি পানের জন্য ব্যবহার করত। পুকুরের পানিতে গোসল করাসহ রান্না-বান্না ও নিত্য কাজে ব্যবহার হত। আজকাল শুস্ক মওসুমে পানযোগ্য পানিতো দুরের কথা গোসলের উপযোগী পানিও সারা চলনবিল এলাকায় খুঁজে পাওয়া দূুস্কর। এছাড়া ইরিবোরো চাষের ফলে পানির স্তর নেমে গেছে অনেক নিচে এবং প্রতি বছরই এ অবস্থার অবনতি হচ্ছে। ইদানিং টিউবওয়েলের পানিরও সংকট দেখা দেয় চৈত্র এবং বৈশাখ মাসের দিকে। চলনবিল এলাকায় সুপেও পানির সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। তাছাড়া বর্তমানে বর্ষাকালে চলনবিল এলাকায় তেমন পানির প্রবাহ দেখা যায় না। কার্তিক মাসতো দুরের কথা ভাদ্র-আশির্^ন মাসেই পানি শুকিয়ে যায়। চলনবিলের পানির এ অবস্থার কারণ হিসেবে উল্লেখ্য ফারাক্কার বাঁধ, টিপাইমুখ বাঁধ, রাবার ড্যাম, স্লুইস গেট নির্মাণ, যত্রতত্র বাঁধ নির্মাণ , খাল-জলাশয় এবং নদী ভরাট ইত্যাকার পরিবেশ বিধ্বংসী কাজকর্ম।

চলনবিল অঞ্চলের ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান ঃ চলনবিল এলাকায় এমন কিছু দর্শনীয় স্থান আছে যেগুলি পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্শন করতে পারে। যদি সেগুলি পর্যটনশিল্পের আওতাভুক্ত করা যায়। এই স্থান সমূহের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা হচ্ছে “হযরত শাহ্ শরীফ জিন্দানী (রঃ) মাজার, হযরত আশরাফ জিন্দানীর মাজার, হযরত শাহ্ মুখলিছুর রহমান খরাসানী (বুড়াপীরের মাজা), ঘাসী দেওয়ানের মাজার, হাজী দেওয়ানের মাজার, ভোলা দেওয়ানের মাজার, মাসুমখাঁর মসজিদ আমানতুল্লাহ শাহী জামে মসজিদ, রবীন্দ্রনাথের কাচারীবাড়ী, শেঠ বাংলা, জগন্নাথ মন্দির, লাল মন্দির, কপিলেশ^র মন্দির, বেহুলার কুয়া, রানী ভবানীর জাঙ্গাল, ¯œাস মন্দির, কমলার ফোত খেলার জঙ্গল, ভাতার মারা পাঁথার, রাউতার পোতাজিয়া পাঁথার, কালিয়াকৈয়র পাঁথার, জয়সাগর, কপাট দিঘী, তালমের শিব, রানীর জাঙ্গাল, ভানসিং দিঘী, নাটোরের রাজবাড়ী, দিঘাপতিয়া রাজবাড়ী, চলনবিল জাদুঘর, কুঞ্জবন, পতিসর কুঠিবাড়ী ইত্যাদি। একসময় চলনবিল অঞ্চলের সিংড়ায় লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যায়ে পেট্রবাংলার অফিস নির্মাণ করেছিল। খনন করা হয়েছিল খনিজ সম্পদ আহরণের কূপ। কিন্তু হঠাৎ করেই তা সিলগালা করে বন্ধ করা হয়। পরবর্তীতে মন্তব্য করা হয় কোন খনিজ সম্পদ নেই বলে। চলনবিল এলাকায় খনিজ সম্পদের সম্ভাবনা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। পরিশেষে চলনবিল উন্নয়নের লক্ষ্যে এবং চলনবিলের সমৃদ্ধি কল্পে পরিকল্পিতভাবে নদী ভরাট বন্ধ করতে হবে, নদ-নদীর পূনঃ খননসহ পরিবেশ দূষণ মুক্ত করতে হবে। তাছাড়া চলনবিল এলাকার মানুষের প্রাণের দাবী এই বৃহত এলাকায় সতন্ত্র চলনবিল জেলা গঠন করা এলাকাবাসীর সময়ের আবেদন।এটাকে জেলা করা হলে এর সার্বিক উন্নয়ন ত্বনান্বিত হবে।

লেখক : কবি, সাংবাদিক ও কলামিষ্ট, মোবাইল নং- ০১৮৬৬-২৩২০৯২

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD