চলনবিলে যান্ত্রিক চাষাবাদ : হারিয়ে যাচ্ছে কাঠের লাঙল

Spread the love

 মোঃ আবুল কালাম আজাদ

ঐতিহাসিক চলনবিলের প্রাণকেন্দ্র গুরুদাসপুর একটি অন্যতম কৃষি প্রধান উপজেলা হিসেবে সর্বাধিক স্বীকৃত। অত্র উপজেলায় সারাবছর জুড়েই সকল মওসুমেই প্রধান খাদ্য শষ্য ধান, গম সহ মসলা, ডাল, তেল , ভুট্রা, কলা, পেঁপে, সহ নানা জাতের শাক-সব্জির চাষ ব্যাপকভাবে করা হয় । আর এইসব ফসল- শাকসব্জির জমি ফসল বপন বা রোপণের জন্য তৈরী , সেচ এবং মাড়াই করতে আগেরদিনে কৃষকরা স্থানীয়ভাবে তৈরী বাবলা কাঠের তৈরী লাঙ্গল দিয়ে চাষ দিত , জাঁত, সেউতি দিয়ে সেচ দিত এবং গরু কিংবা মহিষ দিয়ে অথবা  ড্রামে পিটিয়ে  মাড়াই করতো ।

সনাতন পদ্ধতিতে দেশীয় কাঠের লাঙ্গল ঃ বাবলা কাঠ দিয়ে তৈরী লাঙলের ঈশের সাথে জোয়াল বেঁধে দুইটি গরু জুড়ে একজন মানুষ দিনভর রৌদ্রে পুড়ে আর বৃস্টিতে ভিজে সনাতন পদ্ধতিতে জমি চাষ দিত আর স্থানীয় সুরে রাখালীয়া , ভাটিয়ালী, বারোষিয়া, ধূয়া গান গাইতো । ছেলে, মেয়ে, বধূ, রাখাল লাঙ্গলের জমিতে পান্তা, বাসি ভাত, খিচুরি খাবার সাজিয়ে নিয়ে যেত । খাবার নিয়ে যেতে দেড়ি হলে অনেকে রঙ্গ করে রাখাল গান গাইত “ বাড়ির পাশে বেতের আওড়া , হাল জুড়েছে ছোট দেওড়া, এত বেলা হইছে ভাবিজান, পান্তা নাই মোর পেটে রে—“ । হালচাষ নিয়ে এ ধরনের রসিকতার অনেক গান কিচ্ছা – কাহিনি আছে । গ্রামের গৃহস্থ প্রায় প্রতিটা বাড়িতেই ২/৩ টা করে লাঙ্গলের জন্য হালের বলদ বা গাভী পালন করতো । জমিতে জো এলে বিভিন্ন পাড়া-গ্রাম থেকে পরিচিতদের লাঙল বেগারী নিয়ে এক সাথে ২০- ৫০ টি বা তারও বেশী লাঙ্গল দিয়ে উৎসব মূখর পরিবেশে জমি চাষ করতো । যার জমি চাষ করা হতো সেই জমির মালিক গরু – খাসি মেরে মহা ধূম- ধামে খাওয়ার জোগার করতো । গ্রামের মানুষ, আত্মীয়-স্বজন বেগারী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে ভূড়িভোজ করতো ।সেই ভূড়িভোজের সুনাম- দুর্নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তো । এতে পরিবার ও গ্রামিন আত্মীয়তার বন্ধন বৃদ্ধি পেত । কৃষকরা জমি বিক্রি-বন্ধক রেখে, সোনার গহনা বিক্রি করে বা মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে দাদন নিয়ে হলেও জমি চাষের জন্য লাঙ্গল ঠিক রাখতে হালের গরু কিনে আনতো।দেশীয় কাঠের তৈরী লাঙ্গলের সাথে দুটি গরু জুড়ে জমি চাষ দিয়ে ফসল বপন-রোপণের উপযোগী করে নিত । এখন আর সেই গ্রামের মানুষদের নিয়ে গরু-মহিষ দিয়ে দল বেঁধে বেগারী চাষের উৎসবমূখর আনন্দের দিন নেই । আধুনিক যান্ত্রিক পদ্ধতির চাষাবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ায় প্রাচিন সনাতন পদ্ধতির কাঠের লাঙ্গলের চাষ হারিয়ে গেছে । সেই সাথে গ্রামিন ঐতিহ্য আত্মীয়তার বন্ধনও ধীরে ধীরে ছিড়ে যাচ্ছে । গুরুদাসপুর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ১৯৭৬ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৭৬ -১৯৯০ সাল পর্যন্ত দেশী কাঠের লাঙ্গল ছিল ৬৩০০ টি , বিপরীতে যান্ত্রিক পাওয়ার ট্রিলার ছিল মাত্র ৯০টি । এমনিভাবে যান্ত্রিক লাঙ্গল পাওয়ার ট্রিলারের সংখ্যা  ক্রমেই বাড়তে থাকে এবং দেশী কাঠের লাঙ্গল হারিয়ে যেতে থাকে । এভাবে দেখা যায় ৯১-৯৫ সালে দেশী লাঙ্গল হ্রাস পেয়ে ২৫০০ অপরদিকে পাওয়ার ট্রিলার বেড়ে হয় ১৫০ টি । ১৯৯৬-২০০০ সাল পর্যন্ত দেশী লাঙ্গল কমে হয় ৯৫০ এবং পাওয়ার ট্রিরার বেড়ে হয় ৫৩০ টি । ২০০১ -২০০৯ পর্যন্ত দেশী লাঙ্গল আরো কমে হয় ৩২০টি আর পাওয়ার ট্রিলার বেড়ে হয় ৮৫০ টি এবং ২০১০ থেকে ২০১৭ অব্দি দেশী লাঙগল হ্রাস পেয়ে হয়েছে ২০৫ টি আর পাওয়ার ট্রিলার বেড়ে হয়েছে ১০৫০ টি ।যান্ত্রিক চাষের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে  বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশী লাঙ্গলের স্মৃতি ভষ্যিৎ প্রজন্মের কাছে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

যান্ত্রিক সেচ পদ্ধতি ঃ কৃষি কাজে যান্ত্রিক হালচাষের সাথে সাথে আধুনিক যান্ত্রিক সেচ পদ্ধতির ব্যবহারও ব্যাপক হারে বেড়েই চলছে । আশির দশক পর্যন্ত সেচ কজে ব্যবহার হত জাঁত, সেউতি যা দিয়ে সামান্য কিছু জমি আবাদ করা যেত । এ ছাড়া বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন ( বি এ ডি সি ) কর্তৃক সরবরাহ করা হতো পাওয়ার পাম্প তা দিয়ে নদি,নালা  ও জলার উন্মুক্ত পানি তুলে সেচ দেওয়া হত । এসব পাওয়ার পাম্প দিয়ে স্কিম ভিত্তিক ১০০/১৫০ বিঘা পরিমাণ জমি সেচ দিয়ে আবাদ করা সম্ভব ছিল । পরবর্তীতে শ্যালো মেশিনের আমদানির পর কৃষকের সহজলভ্য হওয়ায় সেচ ব্যবস্থায় আমূল পরির্ব্তন ঘটেছে । সনাতন পদ্ধতির সেচ ব্যবস্থা হারিয়ে যায় যান্ত্রিক সেচ ব্যবস্থার দুর্বার আগমন ও প্রচলনে। ।

স্থানীয়  উপজেলা কৃষি দপ্তরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৭৬-৯০ সালে এল এল পি ( লো লিপ পাম্প ) ০০, শ্যালো মেশিন ( অগভির নলকূপ ) ৩৩৫০ টি, গভির নলকূপ ছিল ৩০ টি । ৯১-৯৫ সালে এল এল পি ২টি, শ্যালো ৪৩৫০ টি, এবং গভীর নলকুপ ৬৫টি । ৯৬-২০০০ সালে এল এল পি ৬টি, অগভির নলকূপ ৪৪৯০ টি এবং গভির নলকূপ ১০৪ টি। ২০০১-২০০৯ সালে এল এল পি ৫টি, অগভির নলকূপ ৪৬০০টি এবং গভির নলকূপ ১০৯ টি এবং ২০১০- ১৭ সালে এল এল পি ৫টি, অগভির নলকূপ ৪৭৫০ টি এবং গভির নলকূপ ১৩৩টি । এইসব শ্যালো মেশিনে জমিতে সেচ কার্য ছাড়াও ফসল মাড়াই, ঝাড়াই, নৌকায় সংযোজন সহ বহুমুখি উৎপাদন ও উন্নয়নমুখি কাজে ব্যবহার করে আয় বাড়াচ্ছে ।

শষ্য মাড়াই যন্ত্র ঃ কৃষি কাজে সনাতন পদ্ধতি লাঙ্গল এবং সেচ ব্যাবস্থার মত মাড়াই ব্যাবস্থাও এখন সম্পুন্র্ আধুনিক যান্ত্রিকীকরন হয়েছে । ১৯৭৬ সাল অবধিও কোন শষ্য মাড়াইয়ের আধুনিক যন্ত্র ছিল না । শুধু গরু- মহিষ জুড়ে মলন দিয়ে অথবা ড্রামে পিটিয়ে ধান-বা অন্য ফসলাদি মাড়াই করতো । মলন দিয়ে গরু মহিষ জুড়ে মাড়াই করতে অনেক সময় লাগতো। কিন্তু যান্ত্রিক পদ্ধতিতে মাড়াই করতে লোক বল এবং সময়ও কম লাগে বিধায় কৃষকরা যান্ত্রিক পদ্ধতিতে শষ্য মাড়াইয়ে ঝুঁকে পড়েছে ।

এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি দপ্তরের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ১৯৭৬ – ৯০ সাল পর্য্ন্ত মাড়াই যন্ত্র ব্যবহার হতো না । ৯১-৯৫ সাল পর্যন্ত ১৭৫ টি প্যাডেল থ্রেসার বা পা দ্বারা মাড়াই যন্ত্রে মাড়াই করা হতো । এরপর থেকে প্যাডেল থ্রেসারের পাশাপাশি ওপেন ড্রাম এবং পাওয়ার থ্রেসার দ্বারা মাড়াই শুরু হয় । ক্রমেই প্যাডেল থ্রেসার এর ব্যবহার কমে ওপেনড্রাম ও পাওয়ার থ্রেসার এর ব্যবহার বাণিজ্যিকভাবে বাড়তে থাকে । পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ৯৬-২০০০ সালে প্যাডেল থ্রেসার কমে ১২০ টি, ওপেনড্রাম প্রেসার শুরুতেই ১৩০ টি এবং পাওয়ার থ্রেসার ৩০টি । ২০০১-০৯ সালে প্যাডেল থ্রেসার কমে হয় ১২০ টি, ওপেনড্রাম থ্রেসার বেড়ে হয় ৩০০ টি, পাওয়ার থ্রেসার হয় ৮০ টি এবং ২০১০ -১৭ সালে প্যাডেল থ্রেসার হ্রাস পেয়ে হয়েছে ৫০ টি, ওপেনড্রাম থ্রেসার বেড়ে ৮৯০ টি এবং পাওয়ার থ্রেসার ১৩২ টি হয়েছে । বিশেষ উল্লেখ্য, এই নিবন্ধে যদিও নির্দিষ্টভাবে গুরুদাসপুর উপজেলার তথ্য-উপাত্ত্ব তুলে ধরে আধুনিক ও মান্ধাতা আমলের কৃষি পদ্ধতির তুলনামূলক চিত্র বর্ণিত হয়েছে। তবে কৃষির যান্ত্রিক আধুনিকায়ন দেশের অন্যান্য স্থানের মত চলনবিলের সর্বত্রই প্রসার লাভ করছে, হারিয়ে যাচ্ছে প্রাচীন কৃষি চাষ ব্যবস্থা – তা বলাই বাহুল্য।

লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিষ্ট।

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD