দ্বীপের নাম হেনরি

Spread the love

সারা সপ্তাহ নানা কাজের চাপ কাটাতে দিন দুয়েক ঘুরে আসুন হেনরি আইল্যান্ড। দেখে নিন সবুজ ক্যানভাস আর জলরাশির কোলাজ। লিখছেন শ্রেয়সী লাহিড়ী

গাড়ির পর গাড়ি লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে। অপেক্ষা শুধু ভেসেলের জন্য। ভেসেলের আবার বেশ বাহারি নাম, মেঘমল্লার। নামখানায় হাতানিয়া-দোয়ানিয়া নদীতে এক আজব পারাপার- বার্জিং চলছে। এ পার থেকে যানবাহন তুলে নিয়ে ও পারে নামিয়ে দিচ্ছে, আবার ও পারের যানবাহন এ পারে পৌঁছে দিচ্ছে। ১৩ নম্বরে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের ভূতলের বাস। বড্ড দেরি হচ্ছে। এক এক বার মনে হচ্ছে বাস থেকে নেমে নৌকায় নদী পার হই। অপর মন আবার তাতে সায় দিল না। প্রথম বার বার্জিং-এর স্বাদ— ছাড়া যায় নাকি! না হয় একটু দেরিই হল।

অবশেষে দ্বিতীয় মনকে প্রশ্রয় দিয়ে বাস থেকে নেমে ঘোরাফেরা শুরু হল। বড় বড় ট্রলার, জেলেদের কর্মব্যস্ততাকে ফ্রেমে বন্দী করতে করতে সময় কেটে যাচ্ছিল। হর্ণ শুনেই এক লাফে বাসে। প্রতীক্ষার অবসান। ভেসেলের অন্দরমহলে ঢুকে পড়ল এই যাত্রী বোঝাই বিশাল বাসটা। বাসে বসেই পার হলাম নদী।

ও পারে পৌঁছে ভেসেল বাসটাকে নামিয়ে দিয়ে অপেক্ষমান যানবাহন তুলে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বাসটা ডাঙায় নামার সঙ্গে সঙ্গে মুহূর্তের মধ্যেই স্থানীয় মানুষের ঠাসাঠাসি ভিড়ে তিলধারণের জায়গা রইল না। আর তো ২৫ কিলোমিটার পথ বাকি।

মৎস্য দফতরের মাছের ভেড়ি।

‘জেটি ঘাট! জেটি ঘাট!’, চিৎকার শুনেই সিট ছেড়ে ঠেলেঠুলে এগোতে গিয়ে পায়ের পাতা দুটো কত জোড়া চটি-জুতোর চাপ যে সহ্য করল, তার হিসাব না কষাই ভাল। জনগণের কনুই-এর গুঁতোই জেটিঘাট স্টপেজে নামতে সাহায্য করল। বাসটা বায়ুদূষণের মাত্রা বাড়িয়ে চলে গেল আরও ২ কিলোমিটার দূরে বকখালির দিকে। রাস্তার ধারেই দাঁড়িয়ে থাকা ভ্যানরিকশায় চেপে বসলাম। গন্তব্য  হেনরি আইল্যান্ড। বেলা ১২টার চড়া রোদে শরীর তখন রোস্ট হচ্ছে। যদিও সকাল থেকে আকাশটা মেঘলা ছিল। টুপটাপ বৃষ্টিও ঝরেছে কিছু। কিন্তু সে তো অনেক আগে, সাতসকালে।

রাস্তাটা মন্দ নয়, খানাখন্দ কম। পাশাপাশি দু’টি গ্রামের বর্ডার এই রাস্তা। একপাশে গ্রাম অমরাবতী, আর একপাশে পূর্ব বিজয়হাটি। দেড় কিলোমিটার ভ্যানরিকশায় চলা পথ শেষ হল ম্যানগ্রোভ ট্যুরিস্ট কমপ্লেক্সের দোরগোড়ায়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীনে মৎস্য প্রকল্পের এই এলাকায় বিশালাকার পুকুর, গ্রাম্য পথঘাট আর হালকা হাওয়ায় গাছের পাতার মাথা দোলানো— যেন হঠাৎ করে পাওয়া ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়। দুপুরে মাছে-ভাতে বাঙালি ভুরিভোজনের পর ক্লান্তিতে আর শান্তিতে চোখের পাতা দুটো কখন যেন লেগে গিয়েছিল। মৎস্য প্রকল্পের টাটকা মাছের স্বাদই বোধহয় এ জন্য দায়ী, কখন যে ঘুম পাড়িয়ে দিল! প্রচন্ড এক বাজের আওয়াজে ধড়মড় করে উঠে বারান্দায় এসে দেখি ঘন কালো মেঘে বিদ্যুতের ঝলকানি আর তার সঙ্গে অবিরাম বর্ষণ। দুপুরের ঝলসানো তাপ উধাও। এ যেন দীপক রাগের শেষে মেঘমল্লারের সুর বেজেছে।

ঘন্টাখানেক পর মেঘ কেটে বৃষ্টি বিদায় নিল, ছড়িয়ে দিয়ে গেল শীতল পরশ। ঝকঝকে আকাশ মাথায় নিয়ে ভ্যানরিকশায় চেপে এগিয়ে চললাম তিন কিলোমিটার দূরে সুন্দরী কমপ্লেক্সের দিকে। দু’পাশে বড় বড় দিঘি আর ঝোপ জঙ্গল। কখনও পাশ কাটিয়ে চলে যায় জেলে দম্পতি, সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পর তারা ঘরে ফেরার পথে। দিঘির পাশে কেউ মাছ ধরার জাল শুকোতে দিয়েছে। হালকা নোনা হাওয়া বয়ে আনছে  আঁশটে গন্ধ। মাছরাঙা পাখি ওঁত পেতে বসে আছে শিকারের অপেক্ষায়।

হাতানিয়া দোয়ানিয়া নদী পারাপার।

ভ্যানরিকশার ঝাঁকুনি খেতে খেতে চলেছি। ভ্যানচালক সুবল একনাগাড়ে বলে চলেছে, এ অঞ্চল আগে সুন্দরবনের মধ্যেই ছিল। তার বাপ-ঠাকুর্দার আমলে বাঘও চলে আসত গ্রামের দিকে। বুনো শুয়োর, হরিণ তো প্রায়ই দেখা যায়।’

ঝাঁকুনি থামল সুন্দরী কমপ্লেক্সে। মৎস্য চাষের এই প্রকল্পে বড় বড় ভেড়ি, আর এই ভেড়ির আশপাশে সাদা বকের নিঃশব্দ চলাফেরা। এখানকার কটেজগুলো কিন্তু বেশ। গায়ে আবার নেমপ্লেট লাগানো আছে— হেঁতাল, গরান, বাণী।

ওয়াচ টাওয়ারে উঠে যত দূর চোখ যায়, শুধুই বিস্তৃত সবুজ আর জলরাশির কোলাজ। নোনা হাওয়ার ছোঁয়ায় সবুজের ছটফটানি দেখতে দেখতে সময় কেটে যায়। সূর্য বিদায় জানাতে প্রস্তুত। ভ্যানের প্যাঁক প্যাঁক হর্ণের আওয়াজে ওয়াচ টাওয়ার থেকে নীচের দিকে মুখ বাড়াতেই সুবল বলে উঠল – ‘সমুদ্রের দিকে যেতে হলে তাড়াতাড়ি চলুন, এরপর আর ওদিকে যেতে পারবেন না।’ তাই তো! এখনও তো সমুদ্রটাই দেখা হয়নি।

তড়িঘড়ি নেমে এসে হাঁটা লাগালাম। বাঁ হাতে এক বিশাল সাইনবোর্ডে সাবধানবাণী – সমুদ্রের জলে নামা বা স্নান করা নিষেধ। বাঁদিকে ভেড়ির সীমানা শেষ আর ম্যানগ্রোভ বন শুরু। দুপাশের হেঁতাল বন থেকে ভেসে আসা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনতে শুনতে কাদামাখা পথ ধরে এগিয়ে চলা। মাটি ভেদ করে খোঁচা খোঁচা শ্বাসমূলগুলো মাথা বের করে আছে। নোনাজলে অক্সিজেনের অভাব বোধ করায় মাটি ফুঁড়ে মাথা তুলে এরা শ্বাসপ্রশ্বাস নেয়।

বিচ জুড়ে সর্বত্র লাল কাঁকড়ার ঘোরাফেরা।

ছোট এক বাঁশের সাঁকো পেরোতেই দুপাশে অনেকখানি উন্মুক্ত প্রান্তর। গৃহপালিত পশুদের চরে বেড়ানোর আদর্শ জায়গা।কাদা প্যাচপ্যাচে পথটা শেষ করে যখন বালিতে পা দিলাম, দূর থেকে দেখা যায় একটার পর একটা সমুদ্রের ঢেউ বালুকাতটে আছড়ে পড়ছে। চারিদিক ফাঁকা, শূন্যতায় ভরে আছে। কেউ কোথাও নেই। কেবলমাত্র লাল কাঁকড়ার দল ভেজা বালির বুকে নকশা এঁকে যাচ্ছে। তাদের কাছাকাছি যাওয়ার কোনও উপায় নেই। সামান্য শব্দেই তারা আতঙ্কিত। মুহূর্তে লুকিয়ে পড়বে তাদের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে। অর্থাৎ, বালির বুকে তৈরি করা গর্তে!

আকাশে থাকা লাল আগুনের গোলাটা ঝাউবনের আড়ালে লুকোতেই আমরাও ফিরে চললাম। ফেরার সময় সাঁকোর কাছে এসে দুপাশের জঙ্গলের দিকে তাকাতেই গা’টা কেমন যেন ছমছম করে উঠল। আর কিছু না হোক, সাপের ভয় তো আছেই।

জোয়ার আসতে শুরু করেছে, শ্বাসমূলগুলো জলে ডুবে গেছে। ভ্যানরিকশায় পিছনদিকে বসে পা দোলাতে দোলাতে ফিরে এলাম ম্যানগ্রোভ কমপ্লেক্সে। রাতের রোম্যান্টিক পরিবেশে চাঁদের দিকে তাকালেই কেমন যেন ঘোর লেগে যায়। সঙ্গে একটানা ঝিঁঝিঁপোকার ডাক তো আছেই। রাতের অন্ধকারে এই কোলাহলমুক্ত নির্জনতায় ইন্দ্রিয় বিশেষ ভাবে সজাগ ছিল। বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে কখন যে ঘুমিয়েছিলাম, কে জানে! ঘুম ভাঙল দরজা ধাক্কানোর শব্দে। মনে পড়ে গেল, সুবলকে তো বলা ছিল, ভোরে সমুদ্রের পারে যাব।

সাঁকো পেরিয়ে সমুদ্রের পথে।

তখন সবেমাত্র আকাশ ফর্সা হয়েছে। এ পথ আজ আর অচেনা নয়। মন মাতাল করা সকালে পাখিদের স্পষ্ট কিচির মিচির বাড়তি আনন্দ ছড়িয়ে দিচ্ছে। গাছের ডালে বসে থাকা এক একটা পাখির রং দেখে মনে হয়, এ কোনও শিল্পীর জাদু তুলির কেরামতি। সুন্দরী কমপ্লেক্সে পৌঁছে সেই বাঁশের সাঁকোর কাছে এসে বুঝলাম এখন জোয়ারের সময়। ম্যানগ্রোভ অরণ্যের অর্ধেক শরীর তখন জলের তলায়। রাতে আর বৃষ্টি হয়নি, কাদামাখা পথটা শুকিয়ে গেছে। সাগরপারে এসে দেখি জেলেরা তাদের রোজকার জীবনসংগ্রামে ব্যস্ত। বেঁচে থাকার মৌলিক রসদটুকু ক্রয় করার জন্য প্রতিদিনকার এ লড়াই। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে জাল টানতে টানতে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে দিয়েছে সাগরের জলে। মনে মনে ভাবলাম, মীনদেবতা যেন এদের প্রতি নির্দয় না হন।

মেঘের আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে কখন যে সূর্য নিজেকে প্রকাশ করেছে বোঝা গেল না। তাপ বাড়ছে, সাগরজলে পা ভিজিয়ে তাই এ বার ফেরার পথে পা বাড়ালাম। ঢেউয়ের পর ঢেউ তখন একনাগাড়ে বেলাভূমিকে ভিজিয়ে চলেছে।

যাত্রাপথ: কলকাতা থেকে দূরত্ব ১৩০ কিলোমিটার। কলকাতার এসপ্ল্যানেড থেকে ভূতল পরিবহণ নিগমের বাস বকখালি যায়। জেটিঘাট স্টপেজে নেমে ভ্যান অথবা টোটোয় যেতে হবে হেনরি আইল্যান্ড। এ ছাড়া, শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে নামখানা স্টেশনে এসে ভ্যানে পৌঁছতে হবে নদীঘাট। নদী পার হয়ে ট্রেকার অথবা মারুতি নিয়ে পৌঁছে যেতে পারেন সরাসরি। নামখানা থেকেও জেটিঘাট যাওয়ার বাস পাওয়া যাবে। কলকাতা থেকে বাসে নামখানা পৌঁছে একই ভাবে নদী পার হয়ে যাওয়া যায় হেনরি আইল্যান্ড।

 

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD