বীরমুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ শুকুর মাহমুদ
এলেম আরবি শব্দ, যার বাংলা অর্থ জ্ঞান। মানবের সকল কাজেই এলেম দরকার, সংসার করতে সাংসারিক এলেম, ব্যবসা করতে ব্যবসায়িক এলেম, কৃষিকাজ-চাকরি করতেও ওই বিষয়ের এলেম দরকার। এলেম ছাড়া সবই অচল। পরকালের আমল করতে এলেম ছাড়া হয় না। মানুষ যখন ভালো কাজে অভ্যস্ত হয় তখন এলেম তার সহায়ক হয়, যখন মন্দ কাজ বা খারাপ কাজের দিকে চলে যায় তখন কোন এলেম’ই কাজে লাগে না। সে মানুষ ভুলটাকেই সঠিক মনে করে।তার ভ্রান্ত বিচার-বুদ্ধির বাইরে সে কিছু মেনে নিতে চায় না। যেমন পতঙ্গ’রা শত বাধা অতিক্রম করে আগুনে ঝাপ দেয়, ওদের ধারণাই নেই যা করছি তা ঠিক নয়। পতঙ্গ’রা উড়ে গিয়ে আগুনে পুড়ে ভষ্ম হয়, কাউকে বলতে পারে না, ওর পরিণতি কথা।
হে মানুষ তোমরা পতঙ্গের মত আগুনে ঝাপ দিও না, আল্লাহ’র কালাম ও রাসূল (স) সুন্নাহের বিপরীতে কাজ করলে তোমাদের পরিণতিও পতঙ্গদের মতই হবে। হে পর্দাহীন মুসলিম, সুদখোর-ঘুষখোর, জালিম, হে হক্কদারের হক্ক নষ্টকারী, হে মাদকাসক্ত, হে শিরককারীগণ তোমরা ভেবো না আমরা যা করছি এটাই ঠিক। এখন তোমাদের কাছে ভুলটাই ঠিক মনে হচ্ছে। যখন পতঙ্গের মত আগুনে ডুবে যাবে তখন বুঝবে তোমার পরিণতি।
এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যেÑ এক আতোর ব্যবসায়ীর মেয়ে বিয়ে হয়েছে চামড়া ব্যবসায়ীর বাড়ি। চামড়ার পচা গন্ধ অসহ্য। মেয়েটি ঘর থেকে বের হয় না, কিছু দিন পর মেয়েটি ঘরের বাইরে আসতে শুরু করেছে। শাশুড়ি প্রশ্ন করেছে, বৌ-মা এখন ভালো লাগছে? মেয়েটি বলল মা, আমি যখন এ বাড়ি আসলাম তখন বাড়ির পরিবেশ খুব খারাপ ছিল, আমার আসার পর বাড়ির পরিবেশ বদলে গেছে, পচা গন্ধ আর নেই। শ্বাশুরি বলল, বাড়ির পরিবেশ বদলায়নি, তোমার নাকের অনুভুতি নষ্ট হয়েছে। যার ফলে খারাপটাকেই ভালো মনে করে নিয়েছ।
পশ্চিমা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাঙালি মুসলিমদের কাছে এখন ইসলামের কাজটা উল্টো বলে মনে হচ্ছে। পর্দানীশিন নারী দেখে বলে গেওভুত, সেকেলে-আনকালচার, আর পর্দাহীনরাই সামাজের উচ্চ আসনে। ইসলামে পরিস্কার ঘোষণা রয়েছে, পর্দা খেলাপ করা গুণাহে কবিরা। যা তওবা করলেও মাফ হওয়ার সম্ভবনা নেই। পর্দাহীন নারীই শুধু জাহান্নামী হবে না, তার অভিভাবক পিতা-স্বামীও জাহান্নামী হবে। আজকাল পর্দাহীনতা রীতিমত স্থায়ী জীবনাচারে রুপ নিয়ে তা বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।
বাঙালি সংস্কৃতিতে একটি বাক্য ব্যবহার হয়ে আসছে, মানুষ অভ্যাসের দাস। আসলে এ কথাটি ঠিক নয়। মানুষের জ্ঞান, বিবেক, আকল আছে। তারা অভ্যাসের দাস হবে কেন? অভ্যাস হচ্ছে একটি বিষয়, তাই জ্ঞান বা বিবেকের মানুষ অভ্যাসের দাস হতে পারে না। যাদের এলেম নেই, জ্ঞানহীন, তারা মাদকের নেশায় সুইপারের পা ধরতে পারে। মানুষ অভ্যাসের দাস হয় যে ভাবে? একটি বদ অভ্যাস গড়ে উঠলে ওই ব্যক্তি ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত সে অভ্যাস থেকে বেড়িয়ে আসতে পারে না।
অপর উদাহরণে বলা যায় যে, একজন কৃষি শ্রমিক শ্রম খেটে জীবন নির্বাহ করে। তার ঘরের স্ত্রী চরিত্রহীন, সুযোগ পেলেই নিষিদ্ধ কাজে জড়িয়ে পরে। লোকটি সমাজে দাঁড়াতে পারে না। লোকেরা তিরস্কার করে। লোকটি স্ত্রীকে বলল, তুমি খারাপ কাজ ছাড়তে পারবে না? আমি লোকালয়ে বের হতে পারি না। স্ত্রী বলল, ছাড়তে পারি এক শর্তে, শর্ত হচ্ছে আগামীকাল থেকে তুমি মাঠে কৃষি কাজ করতে পারবে না। এক সপ্তাহ ভিক্ষা করবে, তারপর আমি ওই খারাপ কাজ ছেড়ে দিব। স্ত্রীর শর্ত মেনে নিয়ে লোকটি পরদিন থেকে ভিক্ষা করতে শুরু করল। সাতদিন ভিক্ষা করার পর স্ত্রী বলল, তোমার ভিক্ষার আজ ক’দিন হল? স্বামী বলল, আজ সাতদিন হলো। তোমার আর ভিক্ষা করার দরকার নেই। প্রতিবেশির জমিতে কামলা ঠিক করেছি, কাজে যাও। লোকটি মাঠের কাজে গিয়ে ভালো লাগেনি, বাড়ি এসে নিরানি মাথাল রেখে পুনরায় ভিক্ষা করতে বেড়িয়েছে, ওদিকে স্ত্রী অপেক্ষা করছে দুপুরে স্বামী বাড়ি আসবে, খবর নেই। বিকেলে ভিক্ষার ঝুলি কাধে নিয়ে বাড়ি ফিরছে। স্ত্রী প্রশ্ন করল তুমি আজও ভিক্ষা করতে গেছো। তোমার তো মাঠের কাজে যাওয়ার কথা? লোকটি বলল মাঠের কাজে ভালো লাগল না, তাছাড়া সাতদিন ভিক্ষা করে অভ্যাসের দাস হয়েছি। তাই আজও ভিক্ষা করতে বেড়িয়েছি। স্ত্রী বলল তোমার মাত্র সাতদিনের অভ্যাস তাই ছাড়তে পারনি, আর আমার এটি ছোট বেলার অভ্যাস কেমনে ছাড়ি বল?
যারা বেপর্দায় চলে, পর্দাহীন তারা ওই বিষয়ে অভ্যাসের দাস হয়েছে। পর্দা তাদের কাছে ভালো লাগে না। পর্দাহীনতাই তাদের ভালো। পর্দা শুধু নারীর জন্য তা নয়, নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই পর্দার হুকুম রয়েছে। নারীরা পর্দা করবে আর পুরুষেরা পর্দা মেনে চলবে। একজন পুরুষের সামনে পর্দাহীন বেগানা নারী পরতেই পারে। তাতে ওই পুরুষ সাথে সাথে তওবা করতে হবে, নইলে ফাসিকির মধ্যে গণ্য হবে। বেপর্দার গুণাহ পুরুষেরও হয়। কিছু বেহায়া নারী বিশ্ব বেহায়া তসলিমা নাসরিনের সুরে সুর মিলিয়ে পর্দা করাকে নারী নির্যাতনের অভিযোগ করছে। ওরা বেপর্দাকেই ভালো মনে করছে।
যারা সুদ ও ঘুষের লেনদেন করছে, ওরা অন্ধ, বধির হয়েছে। ভালোটা দেখার দৃষ্টি ভালোর শ্রবন শক্তি হারিয়ে ফেলেছে, যারা মাদকের নেশায় ডুবেছে তাদের জ্ঞান হারিয়ে গেছে, তারা নিষিদ্ধটাকেই রঙিন করে দেখছে। ব্যবসা বাণিজ্যে যারা শিরক করছে ওরা অপরাধকেই ঠিক মনে করছে। মানুষের হক্ক নষ্ট করছে, ধোকাবাজি করছে, ওরা ভাবছে আমার কৌশলে সফলতা হয়েছে।
যারা ঘুষের মধ্যে জড়িয়ে পরেছে ওরা ফিরতে পারবে না, বরং অন্যদেরকে ওই অপরাধে জড়ানোর চেষ্টা করছে। ঘুষ দিয়ে চাকরি নেয়াটাকে সফল ভাবছে, তথাকথিত আলেম মোটা অংকের টাকা ঘুষ দিয়ে মসজিদের ইমাম হয়েছে। চাকরি নিতে ঘুষ দেয়া, চাকরি দিতে ঘুষ নেয়া কোন অপরাধই নয়। দুনিয়ার সফলতা ভাবছে।
যারা সুদের লেনদেন করে তাদের প্রশ্ন করা হলে বলে, সুদের লেনদেন না থাকলে আমরা মরেই যেতাম, সুদ আছে বলেই বেঁেচ আছি। কারো কাছে ধার-কর্জ চেয়ে পাই না। অল্প ক’টাকা সুদের বিনিময়ে মোটা অংকের টাকা পাওয়া যায়। সাপ্তাহিক বা মাসিক কিস্তি দিয়ে শোধ করা যায়, সুদই ভালো।
তাদেরকে কি শুনিয়ে দেয়া হয়নি আল্লাহর কালাম? ওরা কি শুনেনি রাসূল (স) এর সুন্নাহের বানী? আল্লাহ’র হাবিব (স.) বলেছেন পর্দা খেলাপকারীরা, সুদখোর-ঘুষখোররা, মাদকাসক্তরা, অন্যের হক্ক নষ্টকারীরা ও আল্লাহ’র অংশীদার সৃষ্টিকারীরা জাহান্নামী হবে। তিনি আরও বলেছেন সুদের সত্তরটি স্তর রয়েছে, যার প্রথম স্তর আল্লাহ ও রাসূল (স.) এর সাথে জিহাদ করা, সর্বনি¤œ স্তর হচ্ছে গর্ভধারিনীর সাথে বাইতুল্লাহের মধ্যে যিনা করার মত পাপ। আল্লাহ’র হাবিব (স.) বলেন, এক দেরহাম (১ টাকা) সুদের লেনদেন করলে সাত বার যিনা করার সমান পাপ হয়। সুদ নেয়া, সুদ দেয়া, সাক্ষি হওয়া বা সুদের দলিল লেখায় সমান অপরাধ।
পৃথিবীর অন্য দেশ বা জাতির হিসেব করার অবকাশ নেই, তবে খোদ বাংলাদেশ বা বাঙালি জাতি যা করছে তাতে মনে হয় হাজারে দুই-এক জন বাদে কোন না কোনভাবে সুদের মধ্যে জড়িয়ে আছে। কেউ চাকরি করে অবসর হয়েছে, হজ্বও করেছে, কেউ অল্প এলেম শিক্ষা করে অথবা তাবলিগে সময় লাগাচ্ছে, মোটা অংকের টাকা ব্যাংক বা পোষ্ট অফিসে জমা রেখে হিসেব মতে সুদের টাকা তুলে সংসার চালাচ্ছে। সুদের টাকায় ইমারত গড়ছে। কেউ সুদের টাকায়ই হজ্ব করছে। দরিদ্র বা শ্রমিক শ্রেণীর লোকেরা সুদের টাকা নিয়ে রিক্সা বা গাড়ি কিনছে। কেউ ঘর করছে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যোগ করেছে। সাপ্তাহিক বা মাসিক কিস্তি দিয়ে শোধ করছে। কোনো না কোনোভাবে সুদী কারবার করে না এমন লোকের সংখ্যা সমাজে আজ বিরল।
মানুষ খারাপের মধ্যে ডুবে গেলে খারাপকেই তখন ভালো মনে করে, ভালোকে উপেক্ষা করে। পর্দাহীনদের পর্দার কথা যারা বললে খারাপ ভাবে। যারা সুদ নিষেধ করছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় ওরা কারও ভালো চায় না। আসলে যারা সুদ নিষেধ করছে পর্দার কথা বলছে তারা মানুষের ভবিষ্যৎ কল্যাণের জন্যই করছে। মোট কথা এলেম না থাকলে কিছুই থাকে না।
লেখক, কথাসাহিত্যিক ও কলামিষ্ট,শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ।আলাপচারিতা: ০১৭৮২-৪৫৭৭৮৩