চলনবিলের অম্লান নক্ষত্র

Spread the love

বীরমুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ শুকুর মাহমুদ

সাত বিভাগ উনিশ জেলার বাংলাদেশের মধ্যে পাবনা একটি প্রসিদ্ধ জেলা। বৃটিশ শাসনের পূর্ব হতেই পাবনা জেলার মানুষ সুশিক্ষায় শিক্ষিত, আদর্শবান, ভদ্রতায় অতুলনীয়। জেলার সতেরটি থানার মধ্যে তাড়াশ বিলাঞ্চলে হওয়ায় সড়ক পথের যোগাযোগ ছিল না। থানাটি অবহেলিত, নিবিড় পল্লী এলাকা। এমন প্রতিকূল পরিবেশ উপেক্ষা করে যারা চলনবিল এলাকা থেকে জ্ঞানের মশাল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েছেন তারা চলনবিলের অম্লান নক্ষত্র। নাটোর মহকুমার গুরুদাসপুর থানার খুবজিপুরের প্রফেসর আব্দুল হামিদ। তিনি চলনবিলের ইতিহাস রচনা করে দেশের মধ্যে চলনবিলের আলো ছড়িয়েছেন। তিনি চলনবিলের একজন উজ্জল নক্ষত্র। চলনবিল এলাকার আর এক নক্ষত্র তাড়াশ মহিলা ডিগ্রি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ জাফর ইকবাল। তিনি চলনবিল এলাকায় প্রায় চৌদ্দটি কলেজ পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তন করে চলনবিল এলাকায় শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন। প্রয়াত কবি, লেখক ও সাহিত্যিক রহমত উল্লাহ ও লেখক-সাংবাদিক আবদুর রাজ্জাক রাজু তাড়াশ উপজেলা শহর থেকে একটি পত্রিকা প্রকাশ করে দেশের মধ্যে চলনবিলের আলো বিকশিত করেছেন। তাই মরহুম রহমত উল্লাহ ও আবদুর রাজ্জাক রাজু চলনবিলের অপর দুই নক্ষত্র। এদের মধ্যে দু’জন পরলোকগত হলেও রাজু আজো চলনবিল বার্তার মাধ্যমে জ্ঞানের প্রদীপ জ¦ালিয়ে রেখেছেন।

সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ দেশের উনিশটি জেলার মহকুমাগুলোকে জেলায় উন্নীত করেন। থানাগুলোকে উপজেলায় রূপান্তর করায় দেশের গ্রামগুলো শহরের আলোয় আলোকিত হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় তাড়াশ থানাও উপজেলায় রূপান্তর হয়ে উন্নয়নের জোয়ার বইছে। চলনবিলের উন্নয়নের রূপকার প্রফেসর আব্দুল হামিদ, অধ্যক্ষ জাফর ইকবাল, রহমত উল্লাহ ও আবদুর রাজ্জাক রাজু চলনবিলের অম্লান নক্ষত্র। চলনবিলের তারকা-নক্ষত্র খুঁজতে গিয়ে আমার মনে পড়ে গেল একটি ভ্রমণ কাহিনী। গাঁয়ের সেরা কলম, বিলের সেরা চলন, ধানে ধনী ধুনাইল, বলদে সেরা কৈজুরী, সুন্দরী পাত্রি দেখতে যাও গুধিবাড়ি। পূর্বকালের প্রবাদ বাক্য প্রবীণদের কাছে শুনতাম। এক সময় মনের মাঝে সখ জাগলো কলম গাঁ আর চলনবিল দেখতে যাবো। ১৯৬৮ সালে আমরা ক’বন্ধু মিলে নৌ ভ্রমণে বের হলাম। বর্ষা মৌসুম। পুবাল বাতাসে পাল উড়ানো নায়ে বিল বাওর পাথার পেরিয়ে আমরা ছুটে চলেছি। শাহজাদপুর থেকে পৌছে গেলাম কলম গাঁয়ে। দিন গড়িয়ে পরন্ত বিকেলে কাঙ্খিত কলম গাঁয়ে পৌছালাম। সন্ধ্যার পূর্ব মুহূর্তে কলম গাঁয়ের এক ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে দিলাম এক কলসি পানি আনতে। আমাদের নৌকার গড়ন ছিল পানসি ধরনের। নৌকার আরোহী আমরা সকলেই যুবক। আমরা যে ঘাটে নৌকা ভিড়িয়েছি বাড়িটি কলম গাঁয়ের প্রথম সারির বাড়ি। আমাদের নৌকা ঘাটে ভিড়তেই বিশাল এক তুলকালাম কান্ড ঘটে গেলো। ডাকাত ভেবে গ্রামের লোক লাঠি-সোটা নিয়ে আমাদের তারা করছে। দু’দিন পূর্বে এক পানসি নৌকায় ডাকাত দল এসে ওই গ্রাম থেকে ডাকাতি করে নিয়ে গেছে। আমাদের পানসি নৌকা আর যুবক চেহারা দেখে ডাকাত ভেবে আমাদেরও তাই আক্রমন করতে আসছে গ্রামবাসি। গ্রামবাসির আক্রমনের মুখে আমরা হতবাক হয়ে চেয়ে আছি। তাকিয়ে আছি জনতার তান্ডবের দিকে। আমরা আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছি। আমাদের কথা শুনে এক বৃদ্ধা বললেন, তোমরা থামো বাপু, আমি একটু দেখে নেই, ওরা ডাহাত না ভালো মানুষের ছাওয়াল।

বৃদ্ধা নৌকার কাছে এসে বললেন, অ গ্যাদারা তোগারে বাড়ি কোনে রে? কোন গাঁয় যাবি। এত বালো বালো চেহারার ছাওয়াল পাওয়াল তাই তোরা ডাহাতি কইরা খাস। কাম কইরা খাইবার পারস না? জনতার রোষানলে পরে ভয়ে ভয়ে আমাদের বারটা বেজে গেছে। বন্ধুদের মধ্যে আমি সবার ছোট তবুও সাহস করে সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বললাম, আমাদের বাড়ি শাহজাদপুর থানার বেলতৈল গ্রাম। আমরা এলাকা ঘুরতে এসেছি, ডাকাত নই। আমাদের কথা শুনে বৃদ্ধা বলল, ব্যালতোল গাঁর ছাওয়াল তোরা, এই ভর হন্দায় কোনে যাবি? খারাপ মতলব নাই তো, ব্যালতোল গাঁয় আমার মামুর বাড়ি আছিলো। মামুরা আর কেউ নাই। কতকাল অইল মামুর গাঁয় যাই না। তোরা এহন কোনে যাবি মামুর গাঁর হগলেই কিছু না কিছু অয়, তোরা-বান কার ছাওয়াল। বৃদ্ধার কথা শুনে বললাম আমরা কলম গাঁও আর চলনবিল ঘুরতে এসেছি, কোন খারাপ মতলব নেই। আমাদের কথা শুনে বৃদ্ধা গ্রামের মানুষদের বললেন, তোরা সব চলে যা ওরা ডাহাত না, ওরা আমার মামুর গাঁর ছাওয়াল, আমার কুটুম অয় বলে গ্রামের লোকদের সরিয়ে দিয়ে আমাদের বললেন এই অবেলায় কোন হানে যাওয়ার কাম নাই আমার ঘাটে থাক। রাইতে ও সকালে আমার এহেনে খায়া তারপর যেহানে খুশি যাইস।

আশু ভয় কেটে গেলো, বৃদ্ধার ঘরেই আতিথেয়তা গ্রহণ করলাম। রাতের খাবার খেয়ে আমরা বৃদ্ধার ঘাটেই নৌকায় ঘুমালাম। সেখানেই সকালের নাস্তা খেয়ে বেড়িয়ে পরলাম কলম গাঁ দেখতে। বিশাল দীর্ঘ গ্রামটি সারি সারি বাড়ি অন্যান্য গাছ-পালার তুলনায় বাঁশ বাগান বেশি। কলম গাঁ দেখার শেষে যাত্রা করলাম চলনবিলের দিকে। বিল অতিক্রম করতে দুপুর গড়িয়ে গেলো। দুপুরের খাবার সংগ্রহের জন্য তাড়াশের বাজারে নামলাম। বাজারের অব¯’া দেখে মনে হল, একটি ভুতুরে নগরী, লোকজন নেই, দু’চারটা দোকান পাট যা আছে তাও বন্ধ। খাবারের কোন দোকান বা হোটেল নেই। অনেক চেষ্টা করে হালকা কিছু খাবার সংগ্রহ করলাম। আর আমাদের কাছে যা শুকনো খাবার ছিল তা দিয়ে কোন রকমে উদর পূর্ণ করলাম। নৌকা থেকে নেমে তাড়াশের বাজার ঘুরে দেখলাম এলাকায় তেমন কোন রাস্তা-ঘাট নেই, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। মাটির দেয়ালে ছোন বাঁশের ছাউনি দিয়ে দুই একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় তারও আবার ছোন উড়ে গিয়ে পানি পরে। পুরো চলনবিল এলাকার মধ্যে দুই বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত তাড়াশ উ”চ বিদ্যালয়, ১৯৬৬ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যোগাযোগের অভাব অন্যদিকে মানুষ শিক্ষায় অনুরাগী না হওয়ায় একমাত্র উ”চ বিদ্যালয়টির অব¯’াও অত ভালো নয়। এলাকার যোগাযোগের মাধ্যম গরু-মহিষের গাড়িতে করে মালামাল বহন করা।বৃহত্তর পাবনা জেলার মধ্যে তাড়াশ থানা নিবিড় প্রত্যন্ত অঞ্চল। জেলার সরকারি কোন কর্মকর্তা/কর্মচারী অভিযুক্ত হলে তাকে শাস্তিমূলক বদলী করা হতো তাড়াশে। প্রশাসনিক কর্মকর্তা কর্মচারীদের কাছে এলাকাটি দূর্গম মনে হতো। তখন ঐ এলাকায় মানুষ কৃষিকাজ ও মৎস্য আহরণ করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করত।

¯্রষ্টার সৃষ্টি জগত কখনই থেমে থাকে না, এটা নিয়ত পরিবর্তনশীল। আদিকালের পৃথিবী আর বর্তমান জগতের কোন মিল নেই। তেমনই পূর্বকালের তাড়াশের রূপ বদলে গেছে। তবে প্রত্যেকটা পরিবর্তনের পিছনে কোন না কোন মাধ্যম থাকে। আদিম তাড়াশকে আধুনিক তাড়াশে রূপান্তরের রূপকার কে বা কারা, এলাকায় বসবাস না করে সঠিকভাবে তা নির্ণয় করা কঠিন। তবে শুনেছি মনীষি এম সেরাজুল হক এর নাম, ফজলুর রহমান খাঁ ও তোফায়েণ উদ্দিন সিদ্দিকী প্রমুখের কথা। তবে সমাজ রূপান্তরকারী সকলের পরিচয় জানা নেই। আমার দৃষ্টি যা আকর্ষণ করছে তা হ”েছ সাপ্তাহিক চলনবিল বার্তার প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি প্রয়াত রহমত উল্লাহ, প্রতিষ্ঠাতা প্রকাশক ও সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক রাজু। তারাই প্রত্যন্ত পল্লী জনপদ একটি উপজেলা শহর থেকে নিয়মিত সাপ্তাহিক খবরের কাগজ প্রকাশে দুঃসাহসিকতা দেখিয়েছেন। অন্যদিকে শিক্ষানুরাগী বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ শিক্ষার পৃষ্ঠপোষক অধ্যক্ষ জাফর ইকবাল তিনি শিক্ষা জীবন শেষ করেই বিল এলাকায় আলোর মশাল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েছেন। এছাড়াও গুরুদাসপুর উপজেলার খুবজিপুরের বাসিন্দা প্রফেসর আব্দুল হামিদ চলনবিলের ইতিকথা লিখে অমর হয়ে আছেন।
৫০ বছর পর দেখলাম বর্তমানে তাড়াশের চিত্র বদলে গিয়ে দৃষ্টি নন্দিত হয়েছে। বিভিন্ন দিক থেকে সড়ক যোগাযোগ হয়েছে, শতভাগ বিদ্যুতায়ন হয়েছে, মাটির দেয়ালের ঘর প্রায় বিলুপ্ত, গড়ে উঠেছে বহুতল ভবন। তাড়াশের সেই পুরাতন বাজার এখন তাড়াশ পৌরসভায় উন্নীত হয়েছে। বিশেষ লক্ষ্যনীয়ভাবে উন্নয়ন হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। যেখানে ১৯৬৮ সালে দেখেছি গুটি কয়েক প্রাথমিক বিদ্যালয় সহ একটি মাত্র উ”চ বিদ্যালয়। বর্তমানে তাড়াশ সহ চলনবিল এলাকায় অসংখ্য কলেজ পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই সাথে শিক্ষানুরাগী জাফর ইকবালের মাধ্যমে চলনবিল এলাকার মানুষ চলনবিল বিশ্বদ্যিালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছে। কলেজ পর্যায়ের এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষ্ঠা হওয়ার পিছনে সর্বো”চ অবদান রয়েছে যার তিনি তাড়াশ মহিলা ডিগ্রি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ জাফর ইকবাল। জনাব জাফর ইকবালের অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রায় এক ডজনের বেশি কলেজ পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চলনবিল এলাকার উন্নয়নে রূপকার প্রফেসর আব্দুল হামিদ, অধ্যক্ষ জাফর ইকবাল, রহমত উল্লাহ সরকার ও আবদুর রাজ্জাক রাজু চলনবিল এলাকার মানুষের হৃদয়ে অম্লান নক্ষত্র হয়ে থাকবে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক, শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ। আলাপচারিতা: ০১৭৮২-৪৫৭৭৮৩

 

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD