মানব জীবনে সামাজিক শান্তি ও সম্প্রীতি

Spread the love

আবদুর রাজ্জাক রাজু

গত ১২ সেপ্টেম্বর সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হল “সামাজিক শান্তি ও সম্প্রীতি” শীর্ষক সমাবেশ। এতে যোগদান করেছিলেন স্থানীয় বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিনিধিসহ নানা শ্রেণী-পেশার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ। এ সমাবেশের সব বক্তাই শান্তির স্বপক্ষে নীতি-আদর্শের ও মানবিক গুনাবলীর গুরুত্বসহ তুলে ধরেছেন। তাই কম বেশী সবার আলোচনাই ভালো লেগেছে। তাদের বলাবলির মধ্যে বৈচিত্র্য ছিল এই যে, কেউ ধর্মীয় আলোকে, কেউ রাজনৈতিক পরিভাষায় আবার কেউ বা সামাজিক দৃষ্টিকোন থেকে শান্তি সম্প্রীতির গুরুত্ব ও তাৎপর্য বর্ণনার চেষ্টা করেছেন।বিশেষ করে সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক ড. ফারুক আহম্মদ এর প্রাসঙ্গিক জ্ঞানগর্ভ আলোচনা সবার দৃষ্টি কেড়েছে। মূলত: এই আলোচনা সভার গূঢ় মর্মার্থ ছিল আন্তধর্মীয় সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি উন্নয়ন ও তা জোরদার করা।
কেননা আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি একটা বড় সামাজিক-রাজনৈতিক ইস্যু। যার গভীর শেকড় প্রোথিত আছে মানুষের ধর্মীয় আবেগ ও অনুভূতির মধ্যে। বাংলাদেশটা স্বাধীন হয়েছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। আর্থ-সামাজিক অসাম্য আর ধর্মীয় মৌলবাদ বা অসহিষ্ণুতা চিরতরে বিদায় করাই ছিল দেশ স্বাধীনের অন্যতম মূল উদ্দেশ্য। সাংবিধানিকভাবে এখানে প্রথমে ধর্ম নিরপেক্ষতার অঙ্গীকার লিপিবদ্ধ ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে বিভিন্ন পট পরিবর্তনের কারণে রাষ্ট্র তার সেই অবস্থান থেকে সরে এসে জোড়াতালির মাধ্যমে সংবিধানে রাষ্ট্রীয় মূল নীতিতে ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং যুগপৎ রাষ্ট্র ধর্ম দুটোই রেখে দিয়েছে। যদিও স্বাধীনতার মূল চেতনার সাথে এটা সাংঘর্ষিক। তবুও এই লেখকের ব্যক্তিগত মত হল, এই সাংবিধানিক বৈপিরীত্য সত্বেও তথা স্ববিরোধী অবস্থান থাকলেও বা আপাতত তা মেনে নিলেও বড় কোন অসুবিধা কিংবা সমস্যা-সংকট হওয়ার কথা নয়।
কেননা ধর্ম নিরপেক্ষতা শব্দের সারবত্তা হল সবাই স্ব স্ব ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করতে পারবে। কেউ বাধা দিবে না। অপরদিকে ধর্মীয় ‘বিসমিল্লাহ’ শব্দালংকার সংযোজনেও মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় না। কারণ পৃথিবীতে কোন ধর্মই অশান্তি, কলহ, বিবাদ, হিংসা ও হানাহানি ইত্যাদি সমর্থন করে না। তাই মানুষ তথা জাতি হিসেবে সভ্য এবং প্রগতিশীল হলে কোনটাতেই আমাদের সমস্যা কিংবা সংকট হওয়ার কথা নয়। শুধু ধর্মকে রাজননৈতিক হাতিয়ার বা রাষ্ট্র ক্ষমতার অস্ত্র হিসেবে প্রয়োগ বা ব্যবহার না করা শ্রেয়। এতে সামাজিক শান্তি ও সম্প্রীতি বিনষ্ট হতে বাধ্য। এক্ষেত্রে ইউরোপে ফ্রান্স একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে ধর্ম থেকে রাষ্ট্রকে আলাদা করার মাধ্যমে।
এখন আসি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি কবিতার চারটি পংক্তির উদ্ধৃতি দিতে। তিনি লিখেছেন “আমার দ্বারা কারো ক্ষতি হয় না যেন দুনিয়ায়-আমি কারো ভয় না করি মোরেও কেউ ভয় না পায়”। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে শান্তি সম্প্রীতি ও কল্যাণ বিষয়ে কত আয়াত আছে চিন্তা করে দেখুন। তার আগে বলি, ইসলাম মানেই তো শান্তি, আর মুসলিম শব্দার্থ আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পিত। আবার কোরআনের সূরা মূলক এর একটি আয়াত যেখানে বলা হয়েছে “তিনিই সুষ্টি করেছেন মুত্যু ও জীবন যেন তিনি তোমাদের পরীক্ষা করেন, কে তোমাদের মধ্য কর্মে শ্রেষ্ঠ”। আরো দেখুন “তোমরা হলে শ্রেষ্ঠ উম্মত। মানুষের হিতের জন্য তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা ভালো কাজের আদেশ কর এবং মন্দ কাজে নিষেধ করো আর আল্লাহর আদেশ মেনে চল”-সূরা আলে ইমরান। কোরআনের অন্য সূরায় বর্ণিত হয়েছে “ফেতনা ফ্যাসাদ বা অশান্তি যুদ্ধ হতেও ভয়ংকর”। স্মরণযোগ্য, শান্তি বজায় না থাকলে স্থিতিশীলতা সম্ভব নয়। আর শান্তির কোন বিকল্প নাই।
আবার পবিত্র গ্রন্থের অন্য স্থানে আছে “মানুষের কারণে জলে স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে”। আর একটি আয়াত-“তোমরা না কাউকে অত্যাচার করবে-আর না কারো দ্বারা তোমরা অত্যাচারিত হবে”। এটা সুবিদিত যে, ইসলামের প্রবর্তক মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) এসেছিলেন বিশ্ববাসীর জন্য শান্তি ও রহমতের এক মূর্তমান আশীর্বাদ স্বরুপ। তাই আমাদের প্রিয় রাসুলের আগমন এবং কোরআন অবতীর্ণের অর্ন্তনিহিত উদ্দেশ্যই ছিল পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর করে সত্য ও ন্যায় ভিত্তিক আলোকিত সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা।
এ প্রসঙ্গে ভারত উপমহাদেশের অন্যতম মহান ধর্মপ্রচারক গৌতম বুদ্ধের চির নন্দিত বাণী “অহিংস পরম ধর্ম ,সকল প্রাণি সুখ ও শান্তি লাভ করুক এবং জীব হত্যা মহাপাপ ” ইত্যাদি কারো অজানা নয়। মহাত্মা গান্ধীর “অহিংস” আন্দোলনের বার্তা আজো বিশ্ববাসীকে আলোড়িত এবং অনুপ্রেরিত করে। পৃথিবীতে যত নবী, রাসুল,পীর, আউলিয়া ও অন্যান্য ধর্মের গুরু মনীষি এসেছেন তাদের সবারই ব্রতচারী কর্ম সাধনা ছিল সমাজের অশান্তি ও বিভ্রান্তি দূর করে মানবতা ও শান্তি শৃঙ্খলা স্থাপন করা। ইসলামসহ জগতের অন্যান্য ধর্মের মূল সুর একই। সেসবের মত, পথ, পন্থা, প্রক্রিয়া ভিন্ন হলেও পৃথিবীতে শান্তি ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠাই সব জ্ঞান ,বিজ্ঞান , দর্শন ও সংস্কৃতির চুড়ান্ত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য।
বিধায় সামাজিক শান্তি ও সম্প্রীতি পৃথিবীর আদিকাল হতেই মানব সমাজে প্রাধান্য পেয়ে আসছে। এটা বিশেষ কোন উৎসব বা পর্বের জন্য কেবল প্রযোজ্য নয়। শান্তির শাশ^ত বাণী প্রতিটা মানব জীবনের সদা সর্বদা তথা সার্বক্ষনিক মেনে চলার বিষয়। এটা ব্যক্তি জীবনের, সমাজ ও রাস্ট্রীয় জীবনের অপরিহার্য অনুসঙ্গ। এটা আমল আকীদার অংশ। যেখানে শান্তি নাই সেখানে মানব কল্যাণ, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি আশা করা যায় না। বড় কথা যেখানে শান্তি নাই সেথায় কোন ধর্ম নাই। এক কথায় শান্তি মানেই ধর্ম, অশান্তি মানেই অধর্ম। সেই হেতু শান্তি ও মানবতা সমার্থক বটে। একজন সমাজ বিজ্ঞানী বলেছেন,“আমি তোমার সাথে দ্বিমত পোষণের অধিকার রাখি, কিন্তু একই সাথে তোমার ভিন্ন মত প্রতিষ্ঠার জন্য আমি জীবন দিতেও প্রস্তুত”। এস্থলে অন্যের অধিকারকে স্বতস্ফুর্ত স্বীকার করে নেয়া ও প্রয়োগের সুযোগ দেয়াকে শান্তি প্রতিষ্ঠার পূর্ব শর্ত বলে বিবেচনা করা যায়। এ প্রসঙ্গে একটি গানের দু’লাইন স্মরণযোগ্য,“ কারো মনে তুমি দিওনা আঘাত, সে আঘাত লাগে কাবার ঘরে”।
হাদিসে আছে “ মুসলমান সেই ব্যক্তি যার হাত ও জবান থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে”। বিভিন্ন ধর্মের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ধর্মশালা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সুরক্ষা করা ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব। ধর্মীয় অনুভূতির পবিত্রতা রক্ষা করা ইসলামে স্বীকৃত। কোরআনে বলা হয়েছে “ দ্বীন বা ধর্মে কোন জোর জবরদস্তি নাই”(সুরা বাকারা)। অন্য কোন ধর্মীয় গোষ্ঠী বা ধর্মের বিরুদ্ধে অশোভন মন্তব্য করা তথা ধর্মীয় নেতাদের ঘৃনা ও গালমন্দ করা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অনুরুপ ইসলামে ধমীয় উগ্রবাদ, মৌলবাদ, জঙ্গীবাদ এবং চরমপন্থা সম্পূর্ণ হারাম যা কঠোরভাবে বর্জনীয়। কোরআনে বলা হয়েছে “যে কেউ একজন মানুষকে হত্যা করল সে যেন জগতের সকল মানুষকে হত্যা করল”। আরো বর্ণনা এসেছে “ আমি (আল্লাহ) তোমাদের বিভিন্ন ধর্মে ও বর্ণে বিভক্ত করে দিয়েছি যেন তোমরা একে অপরকে চিনতে পারো”।তাই জুলুম ও সন্ত্রাস-সহিংসতা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। মনে রাখা দরকার , শান্তি মনুষ্যত্বের পরিচায়ক। পক্ষান্তরে অশান্তি পশুত্বের প্রতীক। শুধু মানবকল্যাণের জন্যই নয়, এমনকি সুস্থ প্রাণ,প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্যেও সমাজে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকা অপরিহার্য।
এবারে তাড়াশের গুল্টা ক্যাথলিক মিশনের ফাদারের বক্তব্য প্রসঙ্গে আসি। তিনি তার বক্তব্যে উপমা দিলেন “একটি বাগানে যদি শুধু কলাগাছ থাকে তবে তা কেমন হবে। পক্ষান্তরে যদি তা নানা বিচিত্র বৃক্ষরাজির ফুলে ফলে সুশোভিত হয় তবে সেটা কেমন লাগবে”। সেই সূত্রে মনে পড়ে, একবার পত্রিকায় পড়েছিলাম কানাডার কোনো একটি নগরে প্রায় একশত প্রকারের জাত-পাত ও ধর্ম-বর্ণের মানুষ একত্রে বসবাস করে যাদের প্রায় সবাই অভিবাসী ,সেখানে চমৎকার শান্তি সংহতি বিরাজমান। এতে বুঝা যায়, বিভিন্ন ধর্ম জাতি গোষ্ঠী যে দেশে যতো বেশী সে দেশ ততো উন্নত, বৈচিত্র্যময় ও বহুত্বের বর্ণিল সভ্যতায় সমুন্নত।ইংরেজীতে একটি কথা আছে টহরঃু রহ ফরাবৎংরঃু, সেটা গণতন্ত্রেরও সৌন্দর্য বটে। সবশেষে ভেবে দেখা যেতে পারে, মহান আল্লাহ তাআলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তার প্রেম ও করুণা থেকে যার নির্জলা অর্থ শান্তির স্বর্গ রচনা; যা তিনি সর্ব প্রথম আদম-হাওয়া জুটির মাধ্যমে পৃথিবীতে নজির স্থাপন করেছেন তাঁর কুদরত ও নিদর্শন হিসেবে। কাজেই মানব সমাজে সকল কাজ-কর্মে একমাত্র ন্যায় ও শান্তি স্থাপনই মানবের মূল কর্তব্য হওয়া উচিৎ।

লেখক : সম্পাদক, সাপ্তাহিক চলনবিল বার্তা, তাড়াশ, সিরাজগঞ্জ। মোবাইলঃ ০১৭১৬১৮৭৩৯২

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d bloggers like this:

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD