প্রসঙ্গ কথা : মৌলবাদ

Spread the love

মুহাম্মদ আশিক

মৌল’ এবং ‘বাদ’ এই দু’য়ের সম্মিলনে ‘মৌলবাদ’। এখানে ‘মৌল’ হলো, আদিম বা মূল (আদি কারণ) সম্বন্ধীয়, আর ‘বাদ’ মানে মত বা মতবাদ (যুক্তি, প্রমাণ… ইত্যাদি দিয়ে গৃহীত দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক বা নীতিবিষয়ক ধারণা বা সিদ্ধান্ত) -কে নির্দেশ করছে। তাহলে, মৌলবাদের অর্থ দাঁড়াচ্ছে গিয়ে, মৌল (মূল এর অনুসারী বা মূল এর সার্বিক আধার যে বা যে সর্বদা মূল এর অনুযায়ী বা তদ্রুপে বর্ত্তমান থাকে) যে মতবাদ। অর্থাৎ যে মতবাদ পূর্বে আবিষ্কৃত বা উদ্ভাবিত কোন এক প্রকার জ্ঞান, ধারণা, বিশ্বাস, আচরণ বা কর্মের পুনরাবৃত্তিতে অনড় অটলভাবে বিশ্বাস করে সেটাই মৌলবাদ।
তাহলে, এখান থেকে আমরা নির্দ্বিধায় বলতেই পারছি, মৌলবাদ মূলের আবাদ করে। এখানে আদি শক্তির বিরাজমান অত্যাবশ্যকীয়, নূতন শক্তির অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অর্থাৎ, মৌলবাদকে ‘মৌলবাদ’ হতে হলে প্রথমত এবং প্রধানত যে শর্ত পূরণ করতে হবে, তা হলো এই, যে গঠনতন্ত্রের উপরে দন্ডায়মান হবে ওতে অটল-অনঢ় থাকা, ওকে ধারণ করে, লালন করে পুষ্ট হওয়া। কারণ, নতুনকে গ্রহণ করবার না এর মন-মানসিকতা আছে, আর বহন করাবার মত শক্তিও নেই। নতুন কিছু মৌলবাদে প্রবেশ করলে এর চলৎশক্তি শ্লথ হয়, ময়দানে মুখ থুবড়ে পড়ে দম আটকে মারা যায়।
প্রকৃতপক্ষে মৌলবাদ কোন এক আদর্শ ভিত্তিক একপাক্ষিক জীবন ব্যবস্থার বা আচারের নাম নয়; মৌলবাদ হলো একটি মানবিক বিকার, যেটা মানুষকে একই কাজ বা পদ্ধতি বা কর্ম্মনীতি পুনঃপুন অনুসরণ করে জীবনযাত্রা নির্বাহ করতে উদ্বুদ্ধ করে। অর্থাৎ, সফলকাম হতে গেলে যেন পূর্ব কর্ম-পন্থার পুনরাবৃত্তি ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই, সমস্ত কল্যাণ যেন পূর্ব আচার-ব্যবস্থার অনুসরণ অনুকরণের মাঝেই নিহিত। কিন্তু, সত্য কি কেবল অতীতেই ছিল, আগামীতে বা বত্ততমানে সত্যের কোন অস্তিত্বই নেই এমনটি কল্পনা করা বা স্বীকার করা কি কস্মিনকালেও যুক্তিযুক্ত? পাঁচশত বছর পূর্বের আমাদের পূর্বপুরুষের জীবনযাপন পদ্ধতি আর আজকের আমাদের আধুনিক জীবনযাপন পদ্ধতি যে অভিন্ন হবে না এটাই তো স্বতসিদ্ধ। কিন্তু মৌলবাদ পূর্ব-পন্থার মোহকে পরিত্যাগ করতে চায় না, করতে পারে না; গোঁড়া বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে জীবনের উন্নতি করতে চায়। কিন্তু জ্ঞান তো স্থবির নয়! কালে কালে জ্ঞান চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছে, চলবে। সুতরাং প্রকৃতির সাথে মৌলবাদের চিরন্তন বিরোধ। এ বিরোধ শুরু হয়েছে মানুষ সৃষ্টির সূচনালগ্নে, যেদিন শয়তানের প্রতিপক্ষ মানুষ সৃষ্টি হয়েছে সেদিন থেকে। সেই কাহিনী তো কমবেশি আমরা সবাই জানি, ঐ যে শয়তান মানুষের শ্রেষ্ঠত্বকে অস্বীকার করল…। মূলত এর মূলে ছিল মৌলবাদী স্বভাব, গোঁড়ামী ও দাম্ভিকতা। সম্ভবত, শয়তান তার মধ্যে এমন কিছু দেখেতে পেয়েছে, যার দরুন ওর মনে হয়েছে মহান হওয়ার একমাত্র যোগ্য উত্তরসূরী সে। এই জন্যে সেদিন সে অহংকার করেছে, মানে নিজেই নিজের গরিমার গান গেয়েছে। পরবর্তী যুগে এই মূলনীতিতে (যে, আমিই শ্রেষ্ঠ, আমি যা ভাবছি ঐটাই চূড়ান্ত, আমি যা খাচ্ছি তাই পুষ্টিকর, আমি যা দেখছি শুধুমাত্র তাই দৃশ্য…) অটল থেকে মৌলবাদ তার বহু শাখা বিস্তার করেছে, করে চলেছে। এখানে উদাহরণ হিসেবে আমরা বলতে পারি ধর্ম্মীয় মৌলবাদের কথা। পৃথিবীতে অনেক অনেক সঙ্ঘাত, অনেক অনেক অনেক বিভাজন তৈরি হয়েছে এই ধর্ম্মীয় মৌলবাদকে কেন্দ্র করে। এই তো গত শতাব্দীর কথা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ধর্ম্মীয় মৌলবাদের কারণে কী কান্ডটাই না ঘটে গেল! উঃ! একটুর জন্যে জ্ঞানের বিকাশের পথ হয়তো অনেক দিনের জন্য রূদ্ধ হয়ে যেত!! সেদিন মার্কিন প্রোটেস্ট্যান্টরা যেভাবে জ্ঞানের বিকাশের পথে বাদ সেধেছিল তা সত্যিই নিন্দনীয়। হায়! হায়! ধর্মের নাম করে জ্ঞানকে অবরুদ্ধ করতে যাচ্ছিল! কত বড় স্পর্ধা! বলে কিনা বাইবেল বিরুদ্ধ যে কোন কথা জ্ঞানপদবাচ্যে বরণীয় হবার যোগ্য নয়, যদি তা নির্মোহ সত্যও হয়। তাই কী কখনো হয়? পাহাড় বেয়ে গড়িয়ে পড়া জল কারুর হুকুম তামিল করে থির হয়ে থেকেছে কখনো? যদিবা কখনো জলের সম্মুখভাগে বাঁধ দিয়ে জলের গতি স্তব্ধ করার চেষ্টা করা হয়, তো সেই বাঁধ সদম্ভে অতিক্রম করে চলে যাবে ও। এখানেও ঘটলো তাই। ফুঁসে উঠলো জনতা, শুরু হলো সংগ্রাম- প্রোটেস্ট্যান্টদের আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান বিরোধী উক্তি আস্তকুঁড়ে নিক্ষেপ হতে লাগলো। মানুষ বিদ্রোহী হলো, বিদ্রোহী- মানুষের প্রবল বিদ্রোহের মুখে প্রোটেস্ট্যান্টদের শূন্যে উত্থিত মাথা অবনমিত হলো। আর তারা মৌলবাদের তিলক পরে সমাজ থেকে জুদা হলো।
এতো গেল মৌলবাদের উৎপত্তিকালীন কথা, মানে মৌলবাদের আনুষ্ঠানিক যাত্রার ইতিকথা। এর পরের কাহিনী আরও করুণ, আরও ভীষণ। সেদিন মার্কিন প্রোটেস্ট্যান্টদের আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান বিরোধী কর্মকান্ডের কারণে সচেতন মার্কিননিবাসী খড়গহস্তে প্রোটেস্ট্যান্টদেন বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছিল; অর্থাৎ প্রোটেস্ট্যান্টরা তো তাদের কর্ম্মনীতির কারণে মৌলবাদী বলে খ্যাত হলো। এমতাবস্থায়, এদের কর্তৃত্ব তো সমাজে চলতে দেয়া যায় না। যুগধর্ম্ম অনুযায়ী সমাজ এখন নতুনের (এখানে নতুন অর্থ, প্রচলিতের বৈপরীত্য…) ছোঁয়া চাচ্ছে; সুতরাং প্রোটেস্ট্যান্টরা সমাজ-জীবন থেকে বিচ্যুত হলো। এই যে মার্কিন জনজীবনে প্রথা বিরুদ্ধ সত্য-সুন্দরকে গ্রহণ করবার মানসিক স্পৃহা তৈরি হলো, এটা অবশ্যই প্রশংসনীয়। তারপর মার্কিনীদের দেখাদেখি সমগ্র বিশ্ব সুন্দরের পূজা করতে শুরু করলো। কিন্তু এখানেই বেঁধে গেল গোল! সেদিন মার্কিন-দুনিয়া নতুনকে যেমন পুষ্পমাল্যে বরণ করেছিল, সাথে সাথে পুরাতনের (অনেক দিন থেকে সমাজ তথা রাষ্ট্র অথবা ব্যক্তি জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে এমন বিশ্বাস, আচরণ বা কিছু) সাথে সম্পর্কের ব্যবচ্ছেদ ঘটাতে শুরু করেছিল। অথচ গতকাল যদি নাই থাকবে আজকের অস্তিত্ব কোথা থেকে হলো ? আর আগামীকালের কথা না হয় না-ই বললাম! কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় ঐদিন থেকে একদল মানুষ পুরাতন মানেই অস্পৃশ্য এই ধারণা পোষণ করতে শুরু করেছে- গোটা দুনিয়া এখন এই পথেই হাঁটছে। আর এক দলের কথা কী বলবো, ওরা তো পুরাতনকেই সর্বস্ব মনে করে! তো মূলতপক্ষে এই উভয় দলই কিন্তু নিখাদ মৌলবাদী। তফাত শুধু এতটুকুই যে, কেউ পুরাতনকে আঁকড়ে ধরে বাঁচে, কেউ নতুনের প্রেমে উন্মাদ। এ যেন রীতিমতো এক অগ্নিকুন্ড থেকে বেঁচে বেরিয়ে আবার এক ভিন্ন অগ্নি গহ্বরে প্রবেশ!
যদিওবা নিসন্দেহে উভয় পক্ষের মৌলবাদী হবার যথেষ্ট কারণ বর্ত্তমান। কিন্তু পৃথিবী আজ প্রথম পক্ষকে, মানে যারা পুরাতনের অনুরাগী এদেরকেই মৌলবাদী বলে চেনে। আর হাসির কথা এই যে, দ্বিতীয় পক্ষও প্রথম পক্ষকে মৌলবাদী বলে সম্বোধন করে। আর প্রথম পক্ষ বুঝে হোক বা না বুঝেই হোক দ্বিতীয় পক্ষের আহ্বানের প্রত্যুত্তর করতে গিয়ে সরবে একটি কথাই বলে যে, গোড়া ছাড়া গাছ হয়? কথাটা বোধ হয় গর্বভরেই বলে। কথাটা অবশ্য মিথ্যাও নয়, কিন্তু পুরোপুরি সত্যও নয়। হ্যাঁ, গোড়া ছাড়া গাছ হয় না, কিন্তু গোড়াটাই তো গাছ নয়, আবার শুধু শাখা-পল্লব নিয়েও তো গাছ হয় না; গোড়া, শাখা, পল্লব… এসব কিছু মিলে তবেই না একটি গাছ। কিন্তু সমাজ এই ব্যাপারটিই বোঝে না! ঐ যে কেউ কেউ পুরাতনকে আঁকড়ে ধরে জীবনের উন্নতি করতে চায়। আবার কেউবা নতুনকে ঘিরে। অথচ নতুন এবং পুরাতন এ বিষয় দু’টিই কিন্তু আপেক্ষিক! তাহলে কীভাবে একটিকে ছেড়ে আরেকটিকে অধিক গুরুত্ব দেয়া যায় ? বরং এটা অবশ্যই করা যায় যে, নতুন এবং পুরাতনের সমন্বয়ে একটা মধ্যমপন্থার সৃষ্টি। যায় না কী? অবশ্যই। কেননা দীর্ঘদিন কোন বিষয় বা বস্তু ব্যবহার করলে একসময় ওটার প্রয়োজন এবং উপযোগিতা যে শেষ হবে এটাই তো স্বাভাবিক, এটা সর্বজন গ্রাহ্য বিষয়। সুতরাং নতুনকে উপেক্ষা করে নয়, পুরাতনকে অবহেলা করেও নয়, পুরাতনের অবয়ব দেখে দেখে একটু ভেঙ্গে, একটু গড়ে নতুনকে, নতুনকে তার মতো করে প্রকাশ হবার সুযোগ দেয়া উচিৎ, এটাই কাম্য। এরূপ করা হলে পরে তবেই, হ্যাঁ তবেই রাষ্ট্র, সমাজ তথা জনজীবনে প্রশান্তির ফল্গুধারা বইবে।

আশিকঃ তরুণ সাংবাদিক, লেখক ও প্রাবন্ধিক। নাগেশ্বরী, কুড়িগ্রাম।

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD