তাড়াশের দুই শীর্ষ নেতৃত্বের অন্তর্দ্বন্দ্ব দ্রুত মিটিয়ে ফেলা জরুরী

Spread the love

আবদুর রাজ্জাক রাজু

অতি সম্প্রতি হঠাৎ করেই চলনবিলের স্থানীয় রাজনীতির মাঠে আকস্মিক বিস্ফোরণ। তাড়াশের রাজনৈতিক দিগন্তের দুই নক্ষত্রের মধ্যে এই সাংঘর্ষিক বাক্য বাণ । এখানে অবশ্য শুধু একজনের একতরফা আক্রমনাত্মক মন্তব্য বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে। পাল্টা অন্যজনের বক্তব্য শোনা যায়নি। যিনি বক্তৃতার অগ্নিস্ফুলিঙ্গে আলোড়ন জাগিয়েছেন তিনি হলেন ডঃ হোসেন মনসুর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক, পেট্রো বাংলার প্রাক্তন চেয়ারম্যান এবং বর্তমানে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য । তিনি তাড়াশের এক জনসমাবেশে বর্তমান সংসদ সদস্য অধ্যাপক ডাঃ আব্দুল আজিজকে উদ্দেশ্য করে অভিযোগের সুরে কিছু নেতিবাচক কথা বলেছেন । সেগুলো তৎক্ষনাৎ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। এলাকায় এগুলো ইদানিং আলোচনা সমালেচনার ঝড় তুলেছে । এ সময়ে তাড়াশের টক অব দ্যা টাউন মামা-ভাগ্নের এই কোন্দল । প্রসঙ্গত যতদূর জানি নেতৃদ্বয় এক অপরকে ওইরুপ সম্বোধন করে থাকেন। সন্দেহ নেই, এতে তাদের উভয়ের ভাবমূর্তিতে আঘাত লাগবে ।সুনাম সুখ্যাতি বিনষ্ট হবে । এবং নেতৃত্বের পরশ্রীকাতরতা ও সংকীর্ণতার দরুন দলে ফাটল দেখা দেয়ার সম্ভাবনা থাকবে। স্থানীয় পর্যায়ে দলের মধ্যেও এর প্রভাবে অন্তর্কলহ,বিচ্ছিন্নতা ও ভাঙন দেখা দিতে পারে। এটা এক ধরনের মনোজাগতিক সংক্রমন । অর্থাৎ নেতত্বৃ পর্যায়ের বিরোধ ও সংঘাতের পরিণাম হতে পারে সুদুর প্রসারী ,অকল্যাণকর । শুধু তাই নয় ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরে বিদ্যমান অনÍর্কলহ বিরোধী শক্তির সহায়ক হিসেবে কাজে দেবে। তারা শুধু এ দেখে অন্তরালে নিন্দা, উপহাস বা কটাক্ষই করবে তা নয়, অধিকন্ত এই দুর্বলতার সুযোগ নিতে চেষ্টা করবে। অতএব কোন কিছরু যখন মাথায় পচন ধরে তখন তার ফলাফল হতে পারে ভয়াবহ, কখনো অমেরামতযোগ্য এবং ভীষনভাবে ক্ষতিকর ।
এখন আসি ডক্টর সাহেবের মন্তব্য প্রসঙ্গে। ডাঃ আজিজ আওয়ামীলীগ করেছেন না করেননি তা তার ভাল জানার কথা। স্বাধীনতা আন্দোলন সংগঠনের সময় হোসেন মনসুর তাড়াশে সক্রিয় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তাকে সামনের সারিতে আমরা আন্দোলন করতে দেখেছি। অপরদিকে তার সমর্থনেই তো প্রধানমন্ত্রী ডাঃ আজিজকে তাড়াশ-রায়গঞ্জের এমপি টিকিট দিয়েছেন ,সে কথা তিনি নিজেই তৎকালে তাড়াশের বিভিন্ন সভা-সমাবেশে স্বীকার করেছেন। দলের কর্মী বা সদস্য না হলে প্রধানমন্ত্রী ডা. আজিজকে পছন্দ করেন কীভাবে। ফলে আজিজের এমপি প্রার্থিতা তৈরীতে তো হোসেন সাহেবের ভূমিকা ও অবদান অস্বীকার করা যাবে না । ওই সময়ে আমি আমাদের সাপ্তাহিক চলনবিল বার্তার জন্য ড. হোসেন মনসুরের সাক্ষাৎকার নিতে জিজ্ঞাসা রেখেছিলাম ,তিনি নিজে এবার তাড়াশ-রায়গঞ্জ এলাকার সাংসদ প্রার্থী হচ্ছেন কি না । জবাবে তিনি জানিয়েছিলেন ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা থেকে অবসর নিতে আরো কিছু কাল দেরি হবে। তাই শিক্ষকতার চাকুরী ছেড়ে দিয়ে আপাতত তিনি এখুনি নির্বাচনে যাবেন না । তবে পরবর্তীতে দেখা যাবে ।তাহলে এতে প্রতীয়মান হয়, ডাক্তার সাহেবেকে সংসদ সদস্য হতে তার উৎসাহ দান এবং পৃষ্ঠপোষনা দুই-ই ছিল। দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে তিনি বিরোধিতা করলে ডাক্তারের মনোনয়ন পাওয়া সহজ ছিল না। তাছাড়া সেই নির্বাচনের আগে-পরে তাড়াশের দ’ু একটি সভায় মনসুর সাহেবকে আজিজ সাহেবের সাথে তাকে সমর্থন করতে একই মঞ্চে দেখা গেছে। তাহলে এতদিন পরে এসে এখন তিনি স্ববিরোধী প্রশ্ন তুললেন কেন । বরং এমপি মহোদয় কোন ভুল করে থাকলে, নীতি বিচ্যুত হলে, তার চারপাশে কোন খারাপ পরিবেশ দেখলে তিনি ব্যক্তি পর্যায়ে তাকে পরামর্শ দিয়ে সতর্ক করতে পারতেন । কিংবা দলীয় ফোরামেও আলোচনা হতে পারে । এর ফলে তিনি নিজেকে সংশোধনের সুযোগ পাবেন। কেননা তারা দু’জনই চলনবিলের নিকটবর্তী গ্রামের প্রতিবেশী, পরস্পরের আত্মীয়, একই দলের খেদমতগার এবং একই উপজেলার অধিবাসী। তাদের মতো কৃতি ও গুণী মানুষের সম্মান ও মর্যাদা দল ও এলাকার সাথে ওতপ্রতো জড়িত। তাই এটা সাধারণভাবেই দেখতে, শুনতে ও জানতে প্রীতিকর , রুচিশীল ও শোভনীয় মনে হবে না।
অপরদিকে আজিজকে মনোনয়ন বাণিজ্যসহ স্থানীয় নির্বাচন প্রভাবিত করার যে ইঈিত তিনি দিয়েছেন তা তো নতুন কিছু নয় । স্থানীয় পরিয়দ নির্বাচনে সাড়া দেশেই অনুরুপ ঘটনা ঘটেছে । সে ক্ষেত্রে সদ্য বিগত নির্বাচন কমিশন, সরকার কেউই তো সঠিক ও ন্যায্য ভূমিকা নিতে পারে নি তা আজো গণমাধ্যমে লেখালেখি হচ্ছে । ফলে শত শত ইউপি চেয়ারম্যান প্রার্থী বিনা ভোটে, বিনা প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত হয়েছেন । একই কারণে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন এবং এবারের স্থানীয় পরিষদের নির্বাচন জাতীয় আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, অর্থাৎ আদৌ গ্রহণযোগ্যতা পায় নি। সাধারণ ভোটার তথা জনগণ হতাশ হয়েছে। এতে করে নির্বাচনের প্রতি তাদের অনাস্থা তুঙ্গে উঠেছে। এখন নিজ দলের এমপিদের নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে অভিযোগ করে কি লাভ । কেননা নিরংকুশ ক্ষমতা নিরংকুশ দুর্নীতির জন্ম দেয়, এটা তো সত্য, প্রবাদের কথা।
সবশেষে বলব, এমনিতেই বৃটিশ বিরোধী কিংবদন্তী রাজনীতিক এম,সেরাজুল হকের বিদায়ের পর থেকে তাড়াশে বড় মাপের জনমানুষের প্রকৃত ত্যাগী উৎসর্গীত রাজনীতিবিদের চরম শুন্যতা চলছে। নাম উল্লেখ না করেও বলা যায় , কখনো কেউ তেমন ক্যারিয়ার নিয়ে আবির্ভূতে হতে চাইলেও পরিশেষে সততা, নিষ্ঠা ও আদর্শকে সেভাবে ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন । হক সাহেব ব্যতীত তাড়াশের ইতিহাসে কোন সর্বজন নন্দিত নির্ভেজাল নেতা নেই । এখানে যারাই ক্ষমতায় গেছেন স্থানীয়ভাবে স ম আ.জলিল আর আতাউর রহমান ছাড়া কেউই লোভের এবং ভোগের পেয়ালা ত্যাগ করতে পারেন নি। দুঃখের সংগে বলতে হয়, তাড়াশের চারপাশের উপজেলাগুলোর রাজনৈতিক-সামাজিক নেতৃত্বের গুণ-মানের সাথে তাড়াশের তেমন কেউ মোটেই তুলনায় যায় না। কোন পশ্চাৎপদ জনপদের মনে হয় এটাই প্রধান বৈশিষ্ট্য। তাই সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে তাড়াশের মানুষের জন্য নি:স্বার্থ, নিবেদিত, দেশপ্রেমিক, নীতিনিষ্ঠ, প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর অভাব রয়েছে । এমন কি সেজন্য ইতিমধ্যে কেউ বা জনতার উপেক্ষা এবং প্রত্যাখানে আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে । তাদের আর কোন দিন পুনরায় উদিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই । সেই হেতু তাড়াশের এই ভগ্নদশার রাজনৈতিকে অঙ্গনে আবার অশুভ ছায়াপাত হোক-তা কেউই চাইবে না । কাজেই উপরোক্ত শীর্ষ নেতৃদ্বয়ের মধ্যে কোন মনমালিন্য কিংবা ভুল বুঝাবুঝি হয়ে থাকলে যত দ্রুত তা মিটিয়ে ফেলা যায় , তাড়াশবাসীর জন্য ততই মঙ্গল । তা না হলে এটা তাড়াশের রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশে অশনি সংকেত স্বরুপ দেখা দিতে পারে। অধুনা আমাদের নষ্ট রাজনৈতিক কালচারে এমনিতেই উদার ও মুক্ত ধারার চিন্তা দর্শন উধাও। । এর কারণ দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি ও ভঙ্গুর গণতন্ত্র । আর তা অব্যাহতভাবে চলতে থাকলে রাজনীতি স্বচ্ছ, গণমুখী ও আদর্শ মন্ডিত হতে পারে না । এর প্রতিছাপ দেখা যায় , রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত আক্রোশ ও হিংসা প্রতিহিংসা চরিতার্থ অথবা প্রতিশোধের নিম্ম মানের আচরণ বহিপ্রকাশের মধ্য দিয়ে। সেটা একই দলের ভেতর পরস্পরে অথবা বিরোধী দলের সাথেও প্রায়শই ঘটে থাকে যা আমাদের রাজনীতির নিত্যদিনের চিত্র। যেখানে কেবলই দল, গোষ্ঠি বা ব্যক্তি স্বার্থকে বড় করে দেখা হয়, দেশ ও জাতীর স্বার্থকে নয়।

লেখক : সম্পাদক, সাপ্তাহিক চলনবিল বার্তা, তাড়াশ, সিরাজগঞ্জ।

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD