মোঃ আবুল কালাম আজাদ
আত্রাই-নন্দকুঁজা-গুমানি নদিই হচ্ছে উপমহাদেশের বিখ্যাত ঐতিহাসিক চলনবিলের প্রান ।এই চলনবিলকে বাঁচাতে হলে সবার আগে বাঁচাতে হবে চলনবিলের প্রান সঞ্চালনকারি বড়াল-নন্দকুঁজা-আত্রাই এবং গুমানি নদিকে।
নদীর কথা লিখতে গেলে আগে লিখতে হয় , এই নদীকে নিয়ে কবি-সাহিত্যিকরা তাঁদের ভাষায় কত গান ,কবিতা, গল্প সাহিত্য কিচ্ছা-কাহিনি, কৌতুক , গীত অনেককিছু লিখেছেন। তার মধ্যে নদীর বিশালত্বের বর্ননা দিয়েছেন‘ নদীর কুল নাই, কিনার নাই..’। চৈত্র মাসে যখন নদীর পানি কমে যায় তখন কবি লিখেছেন-‘আমাদের ছোট নদী, চলে আঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে’। আবার যখন সেই নদীই দখল-দুষনে , পলি জমে ,মাটি ফেলে ভরাট করে, অট্রালিকা তৈরী করে, মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মান করে , কল-কারখানা স্থাপনসহ নানা অবৈধ স্থাপনা নির্মানের মহাৎসবে নাব্যতা হারিয়ে প্রমত্মা নদীর চিহ্নটুকুও হারিয়ে শুধু ধারাবাহিকতা রয়েছে। তাইতো কবি আক্ষেপ করে লিখেছেন-‘এইখানে এক নদী ছিল, জানলোনা তো কেউ , নদীর কুল ছিলনা ,ছিল শুধু ঢেউ…’। নদী নিয়ে বহুজন বহু উপাধিতে বহু ভাষায় মনের মাধুরি মিশিয়ে কত কিছুইনা লিখেছেন। কেউ নদীকে নারীর সাথে তুলনা করেছেন । কেউ আবার নদীকে জীবনের সাথে একাকার করে লিখেছেন। আসলে নদী না বাঁচলে মানুষ বাঁচবেনা। তাই মানুষের জীবন রক্ষার্থেই নদীর জীবন বাঁচাতে কতইনা চেষ্টা চলছে। বলা হয় নদীর সাথে জীবনের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। পরিবেশবাদীরা বলছেন, নদী না বাঁচলে পরিবেশ বাঁচবেনা, আর পরিবেশ না বাঁচলে মানুষ, প্রাণি , জীববৈচিত্র বাঁচবেনা। তাইতো নদীতে বাঁচাতে চলছে আন্দোলন নানা প্রক্রিয়ায়।
মানব সভ্যতা , জলবায়ু , জীববৈচিত্র এবং পরিবেশই গড়ে উঠেছে নদীকে নিয়ে। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় , পৃথিবীতে যত সভ্যতা গড়ে উঠেছে নদীর তীরে।ব্যবসা-বানিজ্য, শহর, নগর সবই নদীর অবদান। মানুষের আর্থ-সামাজিক, জীব বৈচিত্র, পরিবেশ, জলবায়ূ , কৃষি-শিক্ষা সবকিছুর মুলে নদী। দিনে দিনে মানুষ নিজের স্বার্থে নদীর দুই কুলে জেগে ওঠা জমি বিভিন্ন সময়ের সরকার ,ভুমি খেকো প্রভাবশালী, রাজনৈতিক নেতারা বেপরোয়া ভাবে দখল-দুষন আর নির্যাতন করে নদীর টুটি টিপে মেরে ফেলছে । কোন বাধাই মানছেনা। আর এর সহযোগিতা করছে অসাধু ভুমি অফিসের কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালীরা। তাই বলা হচ্ছে নদী ও নারী নির্যাতন সমানভাবে চলছে। এই নির্যাতন থেকে নদীর জীবনী সত্বাকে রক্ষা করতে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন(বাপা), বেলা, নদীরক্ষা আন্দোলন, চলনবিল রক্ষা আন্দোলন, আত্রাই-গুমানি- নন্দকুঁজা ও বড়াল রক্ষা আন্দোলন ,নারোদ নদ রক্ষা আন্দোলন কমিটি জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনসহ বিভিন্ন সরকারি- বেসরকারি সংস্থা নানাভাবে আন্দোলন করে সরকারের প্রতি চাপ সৃষ্টি করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সরকার বিভিন্ন সময়ে আদালতের নির্দেশে কিছু কার্যকরি পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু প্রভাবশালীদের কাছে নদী দখল উচ্ছেদ আর দুষন রোধে সরকারের কর্মকর্তারা অসহায় হয়ে পড়েন।নদীর সঠিক মালিকানা নিয়েও চলছিল টানাহ্যাঁচড়া।নদীর মালিকানা নিয়ে পানি উন্নয় বোর্ড (পাউবো) হয়ে উঠেছিল দুর্নিতির রাঘব বোয়াল। কথিত আছে পানিউন্নয়ন বোর্ডের অপরিকল্পিত প্রকল্পের কারনেই নদ-নদীর অপমৃত্যু হচ্ছে। আমাদের নাটোর(গুরুদাসপুর-বড়াইগ্রাম) ৪ আসনের সংসদ সদস্য সাবেক প্রতিমন্ত্রী চলনবিলের কৃতিসন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস বড়াল রক্ষা আন্দোলন কমিটি এবং বিভাগীয় সরকারী কর্মকর্তাদের সভায় অত্যন্ত ক্ষোভের সাথে বলেছিলেন “ আমি যদি এক ঘন্টার জন্যেও প্রধানমন্ত্রী হতাম তাহলে সর্বপ্রথম পানি উন্নয়ন বোর্ড বিলুপ্তির ঘোষনা দিতাম।” উক্তিটি যথার্থই ছিল বলে নদী বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
এমতাবস্থায় মহমান্য হাইকোর্ট নদ-নদীর দখল, দুষন,ভরাট,সংরক্ষন ও ব্যাবস্থাপনার বিষয়ে একটি ঐতিহাসিক রায় ঘোষনা করেন। একই সাথে মহামান্য আদালত নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয়- জলাধারের অবৈধ দখল ও দুষনকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গন্য করার আদেশ জারী করেছেন।রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহন ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ এর ৮৬ ও ৮৭ ধারা এবং ১৪৯(৪)ধারা অনুসারে জাতীয় নদী কমিশনকে নদীর জীবনী স্বত্বা রক্ষার মালিকানা প্রদান করে ঐতিহাসিক রায় প্রদান করেন। বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাও নদী খেকোদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষনা করেছেন।
চলনবিল পরিচিতি :
চলনবিল বাংলাদেশ তথা এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সর্ববৃহৎ চলমান বিল হিসেবে পরিচিত। নাটোর , সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলার ৮ টি উপজেলার ভৌগলিক সিমানা নিয়ে বৃহত্তোর চলনবিল গঠিত।চিন দেশীয় পরিব্রাজক হিউয়েন সাংবা ভারতে অবস্থানকালে তাঁর লিখিত বিবরন থেকে জানাযায়,সপ্তম শতাব্দীতে চলনবিল পদ্মা ও যমুনার সঙ্গমস্থলে অবস্থান করতো। বিরাট নদী চলনবিলের উপর দিয়ে প্রবাহমান পদ্মা,যমুনা ও ব্রম্মপুত্র নদী যুগে যুগে পলি পরার ফলে পদ্মা, ব্রম্মপুত্র ও যমুনা পৃথক হয়ে পড়েছে।
চলনবিল অঞ্চলের খ্যাতনামা সাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশি লিখেছেন. চারশত বছর পুর্বে এই বিলটি রাজশাহী,পাবনা, বগুড়ার অধিকাংশ স্থান জুড়ে বিরাজ করতো। ব্রম্মপুত্র ও পদ্মার সঙ্গমস্থলের পশ্চিম উত্তোরাংশে চলনবিল বিরাজিত।অবস্থান, আকৃতি ও প্রকৃতিতে দেখাযায়,চলনবিলকে উত্তর বাংলার নদ-নদী ¯œায়ুজলের নাভি কেন্দ্র। কিন্তু ১৯১৬ সালে পাকশি- সিরাজগঞ্জ এবং পাকশি-শান্তাহার রেল লাইন করায় বড়াল , আত্রাই- নন্দকুঁজা-গুমানি সহ সংশ্লিষ্ট আরো নদ- নদীর প্রস্থ সংকুচিত হয়ে পড়ে। এখান থেকেই শুরু হয় চলনবিলের নদ- নদীর অপমৃত্যুর উদ্বোধন ।
ঐতিহাসিক চলনবিলের প্রান সঞ্চালনকারী( জীবনদায়িনী) অন্যতম আত্রাই-গুমানি এবং নন্দকুঁজা নদির কথা তুলে ধরছি-
আত্রাই নদী নাব্যতা হারিয়ে এখন জোলায় পরিনত :
আত্রাই তিস্তার শাখা নদী। দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার উত্তরে এ নদী করোতোয়া নদী নামে প্রবাহিত হচ্ছে। এ নদী ছোট যমুনায় মিশে দক্ষিন-পুর্বে প্রবাহিত হয়ে নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার চাঁচকৈড় ত্রি- মোহনায় নন্দকুঁজার সাথে মিলিত হয়ে গুমানি নাম ধারন করে পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার নুননগর এসে বড়ালের সাথে মিশে বড়াল নামে ভাঙ্গুড়া ও বনানিনগড় ফরিদপুর উপজেলা হয়ে বেড়া উপজেলার কাছে মুল যমুনায় মিশেছে। এইজন্য আত্রাই নদীকে বলা হয় যমুনার উপনদী।আত্রাই নদী ছোট যমুনা থেকে প্রবাহিত হয়ে, নওগঁ হয়ে বৃহত্তোর চলনবিলের বুকচিড়ে নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলা হয়ে গুরুদাসপুর উপজেলার পৌরসভার ত্রি-মোহনায় নন্দকুঁজা এবং গুমানি নদীর সাথে মিশেছে। আত্রাই নদীর নামকরনে নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলা নামে একটি উপজেলা এবং রেল ষ্টেশন স্থাপিত হয়েছে। আত্রাই নদীর পাড়ে ভাটরা পতিসরে বিশ্ব কবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের জমিদার বাড়ি অবস্থিত। এখানে বসেই কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ আমাদেও ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে’ কবিতাটি। আত্রাই নদীকে এক কথায় বলা হয় চলনবিলের মূল শিরা । কারন আত্রাই নদীর দীর্ঘ প্রবাহের মাধ্যমেই চলনবিলের উৎপত্তি হয়ে বিস্তীর্ন এলাকাজুড়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যা এশিয়া মহাদেশের মধ্যে বৃহত্তোর বিল বলে ইতিহাস খ্যাত।আত্রাই নদীর মুল প্রবাহেই চলনবিলের ¯্রােত চলমান আছে আজো। সেই আত্রাই নদীর দুই পাড়ে পলি জমে নব্যতা হারিয়ে এখন জোলায় পরিনত হয়েছে।
আত্রাই নদীর বহু উপনদী বা শাখা নদী রয়েছে। নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার ডান তীরে ফকিরনি নদী, নাটোরের সিংড়া উপজেলার বাম তীরে গুড়নই নদী এবং গুরুদাসপুর উপজেলার বাম তীরে হরদমা গ্রামে বেশানী নদী বর্তমানে ভাসানী নদী এবং যোগেন্দ্র নগর বাম তীরে মরা আত্রাই নামে শাখা প্রবাহিত। আত্রাই নদীর প্রত্যেক শাখা- উপ-শাখা দিয়ে পানির ¯্রােত গিয়ে পড়ছে চলনবিলের মধ্যে। এই শাখ-উপ-শাখার ¯্রােতধারার কারনেই চলনবিল চলমান। তাই নাম হয়েছে চলনবিল। আত্রাই নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ২৫০ কিলোমিটার।
আত্রাই নদীর নব্যতা উদ্ধারে ড্রেজিং কাজে দুর্নিতী ও অনিয়মের অভিযোগ :
পাবনা জেলার বেড়া উপজেলার যমুনা থেকে বড়াল,গুমানী এবং আত্রাই নদীর নব্যতা উদ্ধারের জন্য অভ্যন্তরিন নৌপরিবহন মন্ত্রনালয়ের (বিআইডব্লিউটিএ) উদ্যোগে ২০১৭ সালে ড্রেজিং এর কাজ চলছে। নৌপরিবহন মন্ত্রনালয়ের তথ্যমতে বেড়া থেকে শুটকিগাছা রাবারড্যাম পর্যন্ত ১৩৫ কিলোমিটার খনন সম্পন্ন হয়েছে। ড্রেজিং এর কাজে গুরুদাসপুরের নদীরক্ষা আন্দোলন কমিটি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), সাংবাদিক , এবং সচেতন নগরিক সমাজ ব্যাপক দুর্নিতী, অনিয়মের অভিযোগ জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষন করা হলে বিষয়টি দুদক,জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন এবং বিআইডব্লিউটিএর কর্তৃপক্ষ অভিযোগ আমলে নিয়ে ১১/৪/২০১৯ তারিখে গুরুদাসপুর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে তাঁদের ম্যপিং জরিপের ভুল স্বীকার করেন এবং প্রয়জনীয় পদক্ষেপের আশ^স দেন। জানা গেছে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের দুর্নিতী ও অনিয়মের অভিযোগে বিল অদ্যাবধি বন্ধ আছে।
বড়াল নদী ভুমি খেকোদের দখলে :
চলনবিলের জীবন সঞ্চালনের অন্যতম প্রধান ধমনি হচ্ছে বড়াল নদী। রাজশাহী জেলার চারঘাট উপজেলার চারঘাট পদ্মা(গঙ্গা) থেকে বড়াল নদীর উৎপত্তি।চারঘাট পদ্মা থেকে বড়াল নদী প্রবাহিত হয়ে পুর্ব দিকে রাজশাহী জেলার বাঘা থানা এবং নাটোর জেলার লালপুর, বাগাতি পাড়ার দয়ারামপুর ক্যান্টনমেন্টের গা ঘেষে উত্তর-পুর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে বড়াইগ্রাম উপজেলার আটঘড়িয়া এসে পুর্বদিকে বনপাড়া, জোয়ারী, মৌখাড়া, বড়াইগ্রাম, লক্ষ্মিকোল, জোনাইল, চাটমোহর উপজেলার ওপর দিয়ে ধানকুনা,নুননগর-বিন্যাবাড়ি গিয়ে গুমানী নদীর সাথে মিশে বড়াল নামেই ভাঙ্গুড়া উপজেলা,বনানি নগর ফরিদপুর উপজেলার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়ে বেড়া উপজেলায় যমুনার সাথে মিশেছে।
আশির দশক পর্যন্ত পদ্ম্ার উর্বরা পলিযুক্ত পানির ¯্রােতের তীব্রতায় ছিল প্রমত্মা। সেসময় এই ¯্রােতস্বনী নদী দিয়ে চলতো বানিজ্যিক বড় বড় নৌকা, বজরা, লঞ্চ, স্টীমারসহ নানা কাঠামোর জলযান। পাওয়া যেত সুস্বাদু নানা প্রজাতির মাছ। এই নদনীর তীরে গড়ে উঠেছে বনপাড়া, জোয়ারী, মেীখাড়া, লাক্ষীকোল , জোনাইল, হরিপুর এবং চাটমোহর হাটবাজার এবং বানিজ্যিক কেন্দ্র।
সেই প্রমত্মা বড়াল নদী আজ মৃত :
পদ্মার শাখা নদী রাজশাহী জেলার চারঘাট উপজেলা থেকে শুরু হয়ে পাবনার বেড়াপর্যন্ত চলনবিলের মধ্যদিয়ে প্রবাহিতহয়ে যমুনার সাথে সংযোগকারী বড়াল নদী। বড়াল নদীর দৈর্ঘ্য ২২০ কিলোমিটার।রাজশাহী, নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জসহ ৪ টি জেলার চারঘাট, বাগাতিপাড়া, লালপুর,বড়াইগ্রাম, চাটমোহর,ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর,শাহজাদপুর ও বেড়া উপজেলাসহ ৯ টি উপজেলার মধ্যে দিয়ে বড়াল প্রবাহিত।
আশির দশকের পর সেই ¯্রােতস্বিনী বড়াল নদী পানি উন্নয়ন বোর্ডের সীমাহীন দুর্নিতী আর স্বেচ্ছাচারিতার কারনে আজ সম্পুর্ন মৃত।পদ্মা থেকে বড়ালের উৎসমুখ রাজশাহী জেলার চারঘাটে ১৯৮২ সালে মুল বড়ালের প্রসস্ততা সংকুচিত করে ৩০০ ফুট থেকে হ্রাস করে ৩৫ ফুটপ্রস্থ স্লুইস গেট নির্মান করে এবং স্লুইসগেট থেকে উজানে পদ্মা পর্যন্ত সংকুচিত করে পানি প্রবাহের গতি কমানো হয়। ১৯৮৯ সালে চারঘাট থেকে ৪৬ কিলোমিটার ভাটিতে বাগাতিপাড়া উপজেলার দয়ারামপুরের আটঘড়িয়া এসে পুর্বদিকে প্রবাহিত বড়ালের মুখে দুইপাড় আরো সংকুচিত করে এবং শাখা নদী নন্দকুজা নদীর মুখে আরো দুইটি স্লুইসগেট এবং ৩টি ক্রসবাঁধ নির্মান করে।
পদ্মা থেকে প্রবাহিত বড়ালের পানির প্রবাহ উত্তর-দক্ষিন উভয় চলনবিলের প্রানের সঞ্চালন করতো। পদ্মা বিধৌত উর্বরা পলিতে চলনবিলের মাটিতে প্রচুর ফসল ফলতো।সেই সাথে পদ্মা থেকে বড়াল নদীতে প্রচুর সু স্বাদু ইলিশ, বাচা, ফাঁসা,পাঙ্গাস ইত্যাদি মাছ আসতো। বড়াল নদীর দুই পাশে গড়ে উঠেছে চারঘাট, আড়ানি, দয়ারামপুর,বনপাড়া, জোয়ারি, মৌখাড়া ,লক্ষিকোল, জোনাইল, হরিপুর, চাটমোহর সহ ব্যবসাবন্দর ও হাটবাজার। চারঘাট থেকে প্রবাহিত বড়ালের শাখা নদীগুলি হচ্ছে নারোদ,নন্দকুঁজা, মির্জামামুদ ,মুসা খাঁ এবং তুলসিগঙ্গা নদী।
নন্দকুজা নদী নাটোর সুগারমিল,যমুনা ডিস্টিলারিজ, পৌরসভা ও হাট-বাজরের বর্জ্যরে ভাগারে পরিনত :
বড়ালের প্রধান শাখা নদী নন্দকুঁজা বড়াইগ্রাম উপজেলার আটঘড়িয়া থেকে উৎপত্তি হয়ে উত্তর দিকে বড়াইগ্রাম উপজেলার আহমেদপুর,নাটোর সদর উপজেলার হালসা,সিংড়া উপজেলার বাহাদুরপুর, হেলাইগাড়ি,এবং গুরুদাসপুর উপজেলার চন্দ্রপুর,নাজিরপুর ,গুরুদাসপুর পৌরসভার উপড় দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চাঁচকৈড় ত্রি-মোহনায় এসে আত্রাই ও গুমানি নদীতে মিশেছে। আটঘড়িয়া থেকে চাঁচকৈড় ত্রি- মোহনা পর্যন্ত নন্দকুঁজা নদীর দৈর্ঘ্য ৬০ কিলোমিটার।
১৯৮৯ সালে আটঘড়িয়ায় বড়াল নদী থেকে উৎপত্তিস্থলে বড়াল- নন্দকুঁজা নদীর মুখে দুই পাড় সংকুচিত করে স্লুইসগেট নির্মান করায় পানির স্বাভাবিক প্রবাহ নিয়ন্ত্রন করায় মরা নদীতে পরিনত হয়েছে।নন্দকুঁজা নদী বড়ালের শাখা নদী বিধায় পদ্মার পানির প্রবাহ নন্দকুঁজা নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চাঁচকৈড় ত্রি- মোহনায় গুমানি নদীতে পড়ে। আটঘড়িয়ায় অ-প্রস্বস্থ স্লুইস গেটের কারনে বড়ালের মুল ¯্রােত নন্দকঁজা দিয়ে প্রবাহিত হয়। কিন্ত নন্দকুঁজার মুখেও স্লুইসগেট নির্মান করায় পানির স্বাভাবিক প্রবাহ কমে বর্ষা মওসুমে অর্ধেকেরও নীচে প্রবাহিত হচ্ছে। আটঘড়িয়া থেকে চাঁচকৈড় পর্যন্ত আহমেদপুর , হালসা, চন্দ্রপুর, হোলাইগাড়ি, নাজিরপুর , গুরুদাসপুর ও চাঁচকৈড় হাটবাজর ও ব্যবসায়িক বানিজ্য কেন্দ্র গড়ে উঠেছে।নাটোর সুগারমিল এবং যমুনা ডিষ্টিলারিজের বিষাক্ত বর্জ্য নারোদ নদ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নন্দকুঁজা নদীতে পড়ে পানি দুষিত হচ্ছে। ফলে নারোদসহ নন্দকুঁজা নদীর মাছ ও জলজ সম্পদ মরে- পচে নদী এলাকার পরিবেশ মারাতœকভাবে দুষিত করছে। এছাড়াও নন্দকুঁজা নদীতে বেশীরভাগ সময় পানি না থাকায় এবং পলি জমে দুই পাড় ভরাট হওয়ায় প্রভাবশালী ভুমি খেকোরা দখল করে প্রমত্মা নদীকে নির্মমভাবে হত্যায় মেতে উঠেছে। বড়ালসহ এই নন্দকুঁজা নদীকে সকলপ্রকার দখল-দুষন থেকে রক্ষা এবং চারঘাট ও আটঘড়িয়ার স্লুইসগেট অপসারনের দাবীতে গুরুদাসপুরের নদী রক্ষা আন্দোলন কমিটি মানব বন্ধন, নদীপথে ৪০ কিলোমিটার নৌ র্যালীসহ বহু কর্মসুচি পালন করে আসছে।
মির্জমামুদ নদী :
নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার কাছুটিয়া বড়াল নদী থেকে মির্জামামুদ নদীর উৎপত্তি। কাছুটিয়ার বড়াল নদী থেকে মির্জামামুদ নদীর প্রবাহ গুরুদাসপুর উপজেলার কান্দাইল, ধানুড়া, পুরুলিয়া, তুলাধুনা চন্দ্রপুর, চকআলাদত খাঁ, গোপিনাথপুর হয়ে চাকলের বিলের ভিতর দিয়ে সোনাবাজু ঝাঁকড়া হয়ে পুর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে বড়াল নদীর আর এক শাখা তুলসিগঙ্গা নদীতে মিশেছে।
কথিত আছে একসময়ে এই মির্জমামুদ নদী দিয়ে বড় বড় বানিজ্যিক নৌকা ,বজরা , লঞ্চ চলাচল করতো।বর্তমানে এই ¯্রােতস্বিনী নদী সম্পুর্ন মৃত। নদীখেকোরা নদীর উৎসমুখ থেকে ধানুড়া পর্যন্ত দখল করে নিয়েছে।পুরুলিয়া থেকে গোপিনাথপুর হয়ে চাকলের বিলে ভিতর দিয়ে সোনাবাজু পর্যন্ত এখনও নদীর ধারা থাকলেও দখলদাররা চন্দ্রপুর এলাকায় নদীর মধ্যে পুকুর খনন করে মাছ চাষ করছে।বর্ষা মওসুমে এই নদী দিয়ে ধানুড়া , হালসা, রানিনগর , চন্দ্রপুর , গোপিনাথপুর, বৃকাশো ও চাকলের বিলের পানি নিস্কাশিত হয়। মির্জামামুদ নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫ কিলোমিটার।
তুলসিগঙ্গা নদী মানচিত্র থেকে বিলুপ্ত :
নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম উপজেলার জোয়ারি বড়াল নদী থেকে উৎপত্তি। জোয়ারি বড়াল থেকে উত্ত-পুর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে নওদা জোয়ারি, গুরুদাসপুর উপজেলার চাপিলা, খামারপাথুরিয়া, নওপাড়া, ইদিলপুর , তেলটুপি, মকিমপুর ,রওশনপুর , ঝাঁকড়া, সোনাবাজু, পোয়লশুরা পাটপাড়া, শিধুলি,ধারাবারিষা, বড়াইগ্রম উপজেলার ভিটাকাজিপুর হয়ে দক্ষিন চলনবিলের চেঁচুয়ার বিলের মধ্যদিয়ে পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার কাটেঙ্গা কিনুর ধর গিয়ে গুমানি নদীতে মিশেছে। তুলসি নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। দখলদারদের দৌড়াত্বে একসময়ের প্রমত্মা তুলসি নদী জোয়ারি উৎসমুখ থেকে রওশনপুর পর্যন্ত পুকুর খনন করে মাছ চাষ , বসতবাড়ি,মসজিদসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মান কেেরছে। এমনকি এই নদী প্রভাশালীদের মদদে মানচিত্র থেকেই হারিয়ে গেছে।তুলসিগঙ্গা নদী দিয়ে মির্জামামুদ নদীর সংশ্লিষ্ট বিলের পানি ছাড়াও দক্ষিন চলনবিলের বিশাল অঞ্চলের সব কয়টি বিলের পানি নিস্কাশিত হয়।
বোয়ালিয়া নদী মানচিত্র থেকেই হারিয়ে গেছে :
নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার নাজিরপুরের মামুদপুর নন্দকুঁজা নদী শাখা বোয়ালিয়া নদী। । বোয়ালিয়া নদীর প্রবাহ উৎপত্তিস্থল নন্দকুঁজা থেকে মামুদপুর , জুমাই নগর, বিন্যাবাড়ি, দক্ষিন নারিবাড়ি, শিধুলি, উদবাড়িয়া, দাদুয়া, খাঁকড়াদহ, এবং বড়াইগ্রাম উপজেলার কচুগাড়ি হয়ে ভিটাকাজিপুর তুলসিগঙ্গা নদীর সাথে মিশেছে। দখলদারদের দৌড়াত্বে নদীটির অস্তিত্ব মানচিত্র থেকেই হারিয়ে গেছে। উপজেলার নদীর তালিকায় বোয়ালিয়া নদীর কোন নামগন্ধই নাই। এই নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫ কিলোমিটার।
সুপারিশ :
# আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক সি এস রেকর্ড অনুযায়ী জরিপ করে সীমানা নির্ধারন পুর্বক অবৈধ দখল উচ্ছেদ ও পুনঃখনন করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে।
# পৌরসভা, হাট-বাজার এবং কল- কারখানার সকল প্রকার বর্জ্য নদীতে ফেলা বন্ধ করতে হবে।
# নদীর উপড় স্থাপিত চারঘাট এবং আটঘড়িয়ার স্লুইসগেটসহ সকল প্রকার অবৈধ স্থাপনা অপসারন করতে হবে।
আবুল কালাম আজাদ,সভাপতি,চলনবিল প্রেসক্লাব, গুরুদাসপুর, নাটোর ০১৭২৪ ০৮৪৯৭৩