সৈয়দ আশরাফ ও মির্জা ফখরুলের মনোবেদনা

Spread the love

ঘটনাটি কাকতালীয় হলেও তাৎপর্যপূর্ণ।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম যেদিন ‘দপ্তর’ হারালেন, তার কয়েক দিন পরই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কারাগার থেকে মুক্ত হলেন উচ্চ আদালতের নির্দেশে। দীর্ঘ ছয় মাসের বেশি সময় তিনি কারাগারে ছিলেন বোমাবাজি-গাড়ি ভাঙচুর-নাশকতার একগুচ্ছ মামলায়। হাইকোর্ট দুই দফায় তাঁকে জামিন দিলেও মির্জা ফখরুলকে সরকার আটক রাখে সেই জামিনের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে রিট করে। অবশেষে আপিল বিভাগও ছয় সপ্তাহের জামিন দিয়েছেন। এর আগে তাঁর চিকিৎসার বিষয়েও আদালত সরকারকে মেডিকেল বোর্ড গঠন করে তার রিপোর্ট জমা দিতে বলেছিলেন। অর্থাৎ তাঁর মুক্তির ঘটনাটি প্রত্যাশিত হলেও সহজ ছিল না। যদিও আগের দিন ৪০টির বেশি মামলায় বিএনপির আরেক নেতা আমান উল্লাহ আমানের জামিন নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বেশ গুঞ্জন রয়েছে। মির্জা ফখরুলের মামলায় সরকার আপিল করলেও আমানের মামলায় আপিল করেনি। আইন সব সময় এক গতিতে চলে না।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন ২০০৯ সালে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সাহসী ও কৌশলী ভূমিকার কারণে এটি ছিল তাঁর পুরস্কার। কেননা, সে সময়ের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলসহ দলের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা স্বেচ্ছায় হোক কিংবা সেনাসমর্থিত সরকারের চাপে হোক দলীয় সভানেত্রীর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। সে জন্য তাঁদের কাফফারাও দিতে হয়েছে। হয়তো এখনো কেউ কেউ দিচ্ছেন। কিন্তু সাড়ে ছয় বছরের মাথায় এসে সৈয়দ আশরাফের দপ্তর হাতছাড়া হওয়ার কারণ কী? এটি শেষের শুরু না শুরুর শেষ সেটা জানতে আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে প্রথমেই যে কথাটি বলা প্রয়োজন তা হলো দলের সাধারণ সম্পাদক হলেই তাঁকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিতে হবে কেন? আশির দশকে সেনাশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এই রেওয়াজ চালু করলেও পরবর্তী প্রতিটি গণতান্ত্রিক সরকার তা অনুসরণ করে আসছিল। শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, জিল্লুর রহমান কিংবা আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার স্থানীয় সরকারমন্ত্রী থাকার অভিন্ন লক্ষ্য ছিল সরকারের উন্নয়নকাজের ষোলো আনা সুফল ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের পাইয়ে দেওয়া। তৃণমূল পর্যায়ে প্রশাসন দুর্নীতির রাহুগ্রাসে পড়ার এটাও অন্যতম কারণ। কেননা, সরকারি কর্মকর্তারা যখন দলীয় লোকজনকে অন্যায় সুবিধা দিতে বাধ্য হন, তখন তাঁরা নিজেদের ‘হিস্যাটাও’ বুঝে নেন। অনেকের মতে, সৈয়দ আশরাফ দলীয় নেতা-কর্মী তথা সাংসদের তদবির-মোসাহেবিকে তেমন পাত্তা দিতেন না বলে আওয়ামী লীগের ভেতরেই তাঁর বিরুদ্ধে নীরব ‘অভ্যুত্থানের’ চেষ্টা চলছিল দীর্ঘদিন থেকে। একনেক বৈঠকটি ছিল উপলক্ষ মাত্র। একনেকের যে সভায় ৩৫০ জন সাংসদের জন্য ৬ হাজার ৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়, সেই সভায় তাঁর গরহাজির থাকা নীতিগত বলেও কেউ কেউ মনে করেন। কেননা, এর আগে একই ধরনের প্রকল্পে সাংসদদের জন্য থোক বরাদ্দ হিসেবে নগদ টাকা দেওয়ার বিরোধিতা করেছিলেন তিনি।
কারণ যা-ই হোক, সৈয়দ আশরাফের দপ্তরবিহীন হওয়ার বিষয়টি খোদ আওয়ামী লীগের মধ্যে ব্যাপক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। যাঁরা এত দিন তাঁর কঠোর সমালোচনা করতেন, তাঁরাও এখন তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল। প্রধানমন্ত্রীর দুজন উপদেষ্টা ও মন্ত্রিসভার প্রবীণতম সদস্যসহ দলের অনেকেই দেখা করে সৈয়দ আশরাফকে সহমর্মিতা জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগের একজন প্রবীণ নেতার মতে, ২০০৯ সালের পর শেখ হাসিনা এত বড় চ্যালেঞ্জে পড়েননি। এখন কীভাবে তিনি এই চ্যালেঞ্জ সামাল দেন, সেটাই দেখার বিষয়। ঘটনার অব্যবহিত পর সৈয়দ আশরাফের মন্তব্যটিও প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, নিজের লাভের জন্য রাজনীতি করেন না। তাঁর এই মন্তব্যে দলীয় নেতা-কর্মী–সাংসদদের প্রতি একধরনের ইঙ্গিতও রয়েছে। তিনি লাভের জন্য রাজনীতি করেন না। অন্যরা করেন। যাঁরা লাভের জন্য রাজনীতি করেন, তঁারাই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকেন। মন্ত্রিসভার যেসব সদস্যের বিরুদ্ধে অযোগ্যতা ও অসততার বেশুমার অভিযোগ আছে, প্রধানমন্ত্রী তঁাদের কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। কেবল সৈয়দ আশরাফই টার্গেট হলেন। তাঁর মন্ত্রণালয়ের পারফরম্যান্সও খারাপ নয়। তবে এ কথা সত্য যে তিনি দল ও সরকারকে যা দিতে পারতেন, তার সিকি ভাগও দেননি। তারপরও তিনি দল ও সরকারের জন্য বড় সম্পদ বলে মনে করেন সাধারণ কর্মীরা। শাপলা চত্বরের ঘটনাসহ বেশ কয়েকবার দুর্যোগ মুহূর্তে তিনি শক্ত অবস্থান নিয়ে দল ও সরকারকে স্বস্তি দিয়েছেন।
তাঁর কাজের ধরন বা পদ্ধতি ভিন্ন। তিনি সোজাসাপ্টা কথা বলেন। সেটাই কি তাঁর জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল? প্রশ্ন উঠেছে, বর্তমান সরকারব্যবস্থায় সরকারপ্রধানের বাইরে কারও পক্ষে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব কি না। ১৯৯১ সালে আমরা সংসদীয় ব্যবস্থার নামে যা চালু করেছি, সেটি আসলে রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থারই প্রতিচ্ছবি। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতির জায়গায় ‘প্রধানমন্ত্রী’ শব্দটি বসিয়ে এরশাদীয় ব্যবস্থাই বহাল রয়েছে। পৃথিবীর কোনো সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নামে এভাবে ক্ষমতাকেন্দ্রীভূত করার নজির নেই। মন্ত্রীরা নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের কাজ স্বাধীনভাবে করেন। প্রধানমন্ত্রী হবেন অন্যদের মধ্যে প্রথম বা ফার্স্ট অ্যামং আদারস। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীরা হলেন সবার ওপরে, অন্যদের থেকে আলাদা। যে দেশে উপসচিব থেকে থানার ওসির বদলি, পদায়নেও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়, সে দেশে গণতন্ত্র বা সুশাসন আশা করা যায় না।
মঙ্গলবার রাতে টিভির খবরে দেখলাম, প্রধানমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফের ১৫ জুলাইয়ের লন্ডন যাত্রা স্থগিতের নির্দেশ দিয়েছেন। এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁকে আরও বড় পদ দিতে পারেন। কারও মতে, এসব নিছকই সান্ত্বনা।

২.
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের গ্রেপ্তার হওয়া এবং জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার মধ্যে দেশে অনেক কিছু ঘটে গেছে। তিন মাস ধরে বিএনপি জোটের লাগাতার অবরোধ–হরতালকে কেন্দ্র করে যেমন আগুনসন্ত্রাসে বহু নিরীহ মানুষ মারা গেছে, তেমনি বিরোধী দলের অনেক নেতা-কর্মীকে জেলজুলুম ও গুমের শিকার হতে হয়েছে। কিন্তু এত কিছুর পরও মির্জা ফখরুল ‘ভারমুক্ত’ হতে পারেননি। বিএনপির কোনো কোনো নেতা এই যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেন যে সম্মেলন না হওয়ার কারণে তাঁকে পুরোপুরি মহাসচিব করা যাচ্ছে না। কিন্তু বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, দলীয় চেয়ারপারসন সাংগঠনিক বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং পরবর্তী কাউন্সিলে সেটি অনুমোদন করিয়ে নিতে হবে। তিনি যদি একক সিদ্ধান্তে স্থায়ী কমিটিতে নতুন সদস্য নিতে পারেন, কিংবা ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণা করতে পারেন, তাহলে মির্জা ফখরুলকে ভারমুক্ত করতে পারবেন না কেন? কথা হচ্ছে দল সেটি করতে চায় কি না? তিনি যখন সাদেক হোসেন খোকাকে সরিয়ে মির্জা আব্বাসকে ঢাকা মহানগরের আহ্বায়ক করলেন, তখন তো কোনো সম্মেলন ডাকার প্রয়োজন পড়েনি। মির্জা ফখরুলের ক্ষেত্রে সেটি হলো না কেন? যে ব্যক্তি গত সাড়ে ছয় বছরে বারবার গ্রেপ্তার হয়েছেন বা জেল খেটেছেন, তাঁর বিষয়ে দলীয় হাইকমান্ডের এই ঔদাসীন্য নিষ্ঠুরতার পর্যায়ে পড়ে। বিএনপি মহলে গুঞ্জন রয়েছে যে দলের চেয়ারপারসন নয়, তাঁর চেয়েও ক্ষমতাধর কোনো ব্যক্তির অসন্তুষ্টির কারণেই মির্জা সাহেব ভারমুক্ত হতে পারছেন না।
গত ৬ জানুয়ারি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যখন জাতীয় প্রেসক্লাব অঙ্গন থেকে গ্রেপ্তার হন, তখন তিনি ছিলেন সুস্থ ও সবল মানুষ। কিন্তু গত মঙ্গলবার তিনি যখন বঙ্গবন্ধু মেডিকেল হাসপাতালের প্রিজন সেল খেকে বের হয়ে এলেন, তখন ভয়ানক অসুস্থ ও দুর্বল।  হুইলচেয়ারে করে তাঁকে গাড়িতে ওঠাতে হয়েছে। এমন দৃশ্য আমরা দেখেছি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক আমলে। যাঁকে গ্রেপ্তার করা হতো তিনিই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। মনে হচ্ছে কেবল ব্যক্তিবিশেষ নন, দেশের গণতন্ত্রও এখন হুইলচেয়ারে কাতরাচ্ছে।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতিতে চরম বৈরিতা ও বিশৃঙ্খলা সত্ত্বেও একটি বিষয়ে ন্যূনতম শৃঙ্খলা ছিল বা আছে যে, গত দেড় দশকে দুই দলে যাঁরা সাধারণ সম্পাদক বা মহাসচিব পদে আসীন হয়েছেন, তাঁরা অপেক্ষাকৃত কম বিতর্কিত। পেশিশক্তির দাপটে ন্যুব্জ ও ভঙ্গুর রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে তাঁরা কিছুটা হলেও ক্লিন ইমেজ বা পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে পেরেছেন। এর সঙ্গে তাঁদের হাতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সীমিত ক্ষমতা থাকলেও হয়তো রাজনীতির অঙ্গনটিও কিছুটা পরিচ্ছন্ন রাখা যেত।
কারামুক্তির পর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়া এবং ফিরে এসে দেশ ও জনগণের সেবায় আরও বেশি আত্মনিয়োগ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন; সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও দপ্তর হারানোর পর বাবার আদর্শের পতাকা সমুন্নত রাখার এবং তাঁর এলাকার ভোটারদের পাশে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।
দুজনের কণ্ঠেই হতাশা ও বেদনার সুর লক্ষ করা গেছে। এটি ব্যক্তিবিশেষের হতাশা বা বেদনা নয়। সমগ্র রাজনীতিরই।

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD