বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ শুকুর মাহমুদ
একটি জাতির মুক্তি বা স্বাধীনতার মূল কেন্দ্রই হলো মুক্ত গণতন্ত্র। মুক্ত গণতন্ত্রের মাধ্যমেই রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রজাতন্ত্র। অনেক ত্যাগ, বহু কষ্টার্জিত আমাদের স্বাধীনতা, সেই স্বাধীনতার সুফল হচ্ছে গণতন্ত্র। গণতন্ত্র না থাকলে স্বাধীনতা মূল্যহীন। ভারত উপমাহাদেশে একসময় শাসন করত মোঘল স¤্রাট। তাদের রাজত্বকালে গণতন্ত্র ছিল না, তখন ছিল রাজতন্ত্র। যোগ্যতার যাচাই ছাড়াই নির্বাচনবিহীন স¤্রাটের পুত্রই স¤্রাট হত। সে সময়ে শাসকগণ প্রজাদের খবর রাখেনি। প্রজাগণও জাহাপনাদের সামনে যাওয়ার সাহস পায়নি। তখন রাজা-প্রজাদের মধ্যে দূরত্ব ছিল অনেক। উজির-নাজির, মন্ত্রি, সিপাহসালার, পাইক-পিয়াদা ও চৌকিদারগণ স¤্রাটকে কুরনিশ করত দুরু দুরু বক্ষে। নবাবী আমলেও প্রজাগণ বঞ্চিত হত শাসকের সহায়তা থেকে। তখন নবাবেরাও নতর্কী নিয়ে মত্ত থাকত হেরেমে। শুরা-তাড়ি আর নারীই ছিল তাদের নেশা। দেহরক্ষী আর কর্মচারীদের হুকুম করত বান্দা বলে। নবাবী আমলের পতন হলো জাতীয় বেইমান-বিশ্বাসঘাতকদের ষড়যন্ত্রে।
১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয় হয়। তারপর তাকে হত্যা করে ভারত উপ-মহাদেশ দখল করে নেয় ইংরেজ বণিকেরা। পরাধীনতায় নিষ্পেষিত ভারতবাসির উপর শুরু হয় পরদেশীয় শাসন-প্রজা নির্যাতন। পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ ভারত উপ-মহাদেশে সকল জাতির মানুষ। মুসলমানদের প্রতি নির্যাতন আরও বাড়িয়ে দিল ইংরেজ শাসক। তারা মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিল। ইংরেজদের ভাষা ইংরেজী চাপিয়ে দিল জাতীর উপর। এ সময় মুসলমানেরা ইংরেজী ভাষাকে উপেক্ষা করেছিল। মুসলমানেরা বলেছিল, ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ইংরেজী ভাষা মুসলমানদের জন্য নিষিদ্ধ বা হারাম। অথচ একই সময়ে এদেশের হিন্দুরা লুফে নিল ইংরেজী ভাষা। ইংরেজদের ভাষা শিখে তাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শাসন ও ক্ষমতার অংশীদারিত্ব হয়ে গেল। সুচতুর ইংরেজ শাসক পুরা সা¤্রাজ্যকে খন্ড খন্ড রাজ্য করে রাজা বানিয়ে দিল হিন্দুদের। রাজ্যগুলো ছোট ছোট অঞ্চলে ভাগ করে জমিদারি দিয়ে দিল। ঐ সকল জমিদারদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল হিন্দু জমিদার। জমিদারগণ প্রজা নির্যাতন করে কর আদায় করত। আদায়কৃত কর রাজাদের মাধ্যমে পৌছে দিত ইংরেজ শাসকদের নিকট।
পরাধীনতা-নির্যাতন আর প্রতিকূল পরিবেশ ঠেকাতে ভারত উপ-মহাদেশের নির্যাতিত মানুষ একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে। দলটির নামকরণ করা হয় “জাতীয় কংগ্রেস পার্টি” । দলটির উদ্দেশ্যÑ পরাধীনমুক্ত জাতি গঠন, ইংরেজ হঠাও, স্বাধীনতা চাই। রাজনৈতিক এ দলের সংগ্রামে বিরোধীতা করেছিল তৎকালীন হিন্দু রাজা ও জমিদারগণ। যেমনটি করেছিল বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দেশীয় দালাল ও রাজাকারগণ। জমিদারগণ প্রজানির্যাতনের করের অর্থ হাতে পেয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধীতা করতে তারা সক্রীয় ছিল। তৎকালীন দালালদের বিরোধীতায় কোনঠাসা হয়ে পরে রাজনৈতিক দলটি। অন্যদিকে জাতীয় কংগ্রেস পার্টিতে হিন্দু নেতাদের প্রাধান্য থাকায় মুসলমান নেতাগণ মর্যাদায় পিছিয়ে অমর্যাদায় ভুগছিলেন। পরবর্তীতে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে ভারত উপ-মহাদেশের পূর্ব বাংলার ঢাকাকেন্দ্রিক আর একটি রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এ দলটি সংঘটিত হওয়ার ডাক দিয়েছিলেন ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। রাজনৈতিক এ দলটির নামকরণ করা হয় মুসলিম লীগ। দলটি সারা ভারতবর্ষে প্রভাব বিস্তার লাভ করে। এ দলটিরও মূলমন্ত্র ছিল ব্রিটিশ হটাও, জাতি বাঁচাও, স্বাধীনতা চাই।
সকল আন্দোলন সংগ্রাম ও রাজনৈতিক দলের লক্ষই ছিল ভারতবাসীর মুক্তি বা স্বাধীনতা। রাজনৈতিক দল দুটির সংগ্রামে ব্রিটিশের ভীত নড়বরে হয়ে পরে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত উপ-মহাদেশে দখলদারিত্ব ও শাসন ক্ষমতা ছেড়ে চলে যায় ব্রিটিশ সরকার। সুচতুর এ শাসকগোষ্ঠি ভেবেছিল ভারত উপ-মহাদেশটিকে অক্ষুন্ন রেখে স্বাধীনতা দিয়ে গেলে আমাদের নির্যাতনের প্রতিশোধ নিতে পারে। যে কারণে ভারত উপ-মহাদেশকে খন্ড খন্ড ভাগে বিভক্ত করে। যাতে ভারতবাসী আর কখানোই তাদের দিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পাড়ে। পুরা সা¤্রাজ্যকে কয়েক ভাগে ভাগ করে। পাকিস্থান, ভারত, আফগানিস্থান ও বার্মা। বিশেষ করে বাংলাকে তিন ভাগে বিভক্ত করেÑ পশ্চিমবঙ্গ-আসামসহ বাংলার বেশ কয়েকটি জেলা ভারতের অংশ বিশেষ। বাংলার পূর্ব অঞ্চলের একটি অংশ পাকিস্থানের সাথে সংযোগ করে পূর্ব পাকিস্তান। বাংলার আরেক অংশ নাফ নদীর ওপারে মিয়ানমার বার্মার সাথে ভাগ করে দেওয়া হয়।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ হটিয়ে যদিও অর্জিত হয় স্বাধীনতা, তবুও বাঙালির পরাধীনতা রয়েই যায়। পাকিস্তানি শাসকদের কাছে পরাধীন পূর্ববাংলার বাঙ্গালী। ভারত উপ-মহাদেশের বৃহৎ রাজনৈতিক সংগঠন মুসলিম লীগে নেতৃত্ব নিয়ে জুড়ে বসল পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠি। এমতাবস্থায় মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ঐ রাজনৈতিক দলকে পৃথক আর একটি সংগঠন হিসেবে প্রবর্তন করেন। দলটির নামকরণ করা হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ। মুসলিম লীগ থেকে দলটি বিভক্ত হলেও ততটা সফলতা অর্জন করতে পারেনি। পরবর্তীকালে পৃথিবীর সবচেয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর সাহসী নেতা শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক দলের নাম পরিবর্তন করে তিনি দলটির নামকরণ করেন আওয়ামীলীগ। আওয়ামীলীগ সংগঠনের আহবানে বাঙালি জাতি সংগঠিত হলে সংগ্রাম আরও বেগবান হয়। এমতাবস্থায় পাকিস্তান সরকার গণভোট দিতে বাধ্য হয়। মুক্ত গণতন্ত্র পেয়ে জনগণ স্বতঃস্ফুর্তভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে। এতে আওয়ামীলীগ বিজয়ী হয়ে সংখ্যাগোরিষ্ঠতা অর্জন করে। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠি এই ভুল রুখতে ধর-পাকড়, জ্বালাও পোড়াও, খুন ধর্ষণ, হত্যাযজ্ঞ চালিয়েও রক্ষা করতে পারেনি। বহু ত্যাগ, বহু রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। মুক্ত হয় বাঙালি জাতি।
এত ত্যাগ, এত রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা, সেই স্বাধীনতা ধরে রাখতে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে গণতন্ত্র। আর গণতন্ত্রের মাধ্যমেই ফিরে আসবে গণপ্রজাতন্ত্র। অথচ আমাদের হাজার বছরের কাঙ্খিত গণতন্ত্রও বার বার হুমকীর মুখে পতিত হয়। একদল স্বার্থান্বেষী মহল স্বাধীনতার স্থপতিকে সপরিবারে হত্যা করে ঘোষণা দিয়েছিল, আমরা বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছি। অথচ তারাই বাংলার মাটিতে প্রথম স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে রাজনীতির অঙ্গনে ফিরে আসে। রাজনৈতিক ঐ দলটি প্রচার করে তারা নাকি বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা। অথচ তারাই এদেশে জোটতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে। জোটতন্ত্রের সূত্রঃ বিভিন্ন নামীয় চার দল নিয়ে গণতন্ত্রের নামে প্রতিষ্ঠিত হয় জোটতন্ত্র। তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধীদের দল নিয়ে গণতন্ত্রকে কারারুদ্ধ করেছিল। জোটতন্ত্র কখনই গণতন্ত্র হতে পারে না। জোটতন্ত্র মানেই গণতন্ত্রকে কারারুদ্ধ করা। দেশে রাজনৈতিক প্রধান দুটি দল এক দলের গমন পথ ধরেই অপর দলও জোটতন্ত্রের কৌশলে এগিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো যদিও প্রচার করছে গণতন্ত্রের কথা। আসলে তা নয়, বাঙালির জাতির হাজার বছরের প্রচেষ্টার ফসল স্বাধীনতা, জাতির প্রত্যাশা মুক্ত গণতন্ত্র। দেশের রাজনৈতিক দলগুলো জোটবদ্ধ হওয়ায় জনগণ পারছে না তার মনোনীত দলকে বা পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে। জোটের সিদ্ধান্তেই ভোট দিতে হচ্ছে মতের বিরুদ্ধেই। জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে রাজনৈতিক দলীয় মনোনীত প্রার্থীকে। খর্ব করা হচ্ছে নাগরিকের গণতন্ত্র অধিকার।
রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে নিবেদন, রাজনীতিতে জোট না করে প্রত্যেক দলকে নিজের মত করে নির্বাচন করতে দিন। দেখবেন বাংলাদেশের এতগুলো রাজনৈতিক দল কেউ কেউ নিজের আসনটিও ধরে রাখতে পারছে না। আসুন রাজনীতিতে জোট না করে প্রত্যেক দল যে যার মত নির্বাচন করে পরে কোয়ালিশন সরকার গঠন করে মুক্ত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করি।
লেখক : বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক , শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ।