মোঃ আবুল কালাম আজাদ
নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলা পরিষদের রুটিন ওয়ার্ক হিসেবে মাসিক আইনশৃঙ্খলা মিটিং প্রতিমাসেই নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এতে সভাপতিত্ব করেন পদাধিকার বলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার। প্রধান অতিথি হিসেবে থাকেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ,তাঁর অনুপস্থিতিতে উপজেলা চেয়ারম্যান। এছাড়াও থাকেন পৌর মেয়র, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যানদ্বয়, অফিসার ইনচার্জ, ছয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, বিভিন্ন দপ্তরের সরকারী কর্মকর্তা, সাংবাদিক প্রতিনিধি, শিক্ষক প্রতিনিধি, কাজী সহ প্রায় ৩৪ সদস্য। সাংবাদিক প্রতিনিধি হিসেবে আমারও সক্রিয় উপস্থিতি জানান দেওয়ার চেষ্টা করি। মাসিক আইনশৃঙ্খলা সভা উপজেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অতিব গুরত্বপুর্ন বিষয় বলেই আমার মনে হয়। কারন উপজেলার জনসাধারনের শান্তিপুর্নভাবে চলাচল,বসবাস এবং জান-মালের ও সামাজিক নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন নাগরিক শৃঙ্খলা রক্ষায় সময়পযোগী সমস্যাগুলো তুলে ধরে আলোচনা পর্যালোচনা করে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়। এজন্য সংশ্লিষ্ট সকল সদস্যের সক্রিয় উপস্থিতির অনুরোধ জানিয়ে সভাপতি উপজেলা নির্বাহী অফিসার স্বাক্ষরিত নোটিশ পিয়ন দ্বারা সদস্যদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে পৌছানো হয় । না পাওয়া গেলে আবার মোবাইল ফোনে অবহিত করা হয়। মিটিং এর কথা কেউ না জানলে জবাবদিহি করতে হয় বেচারা পিয়নের।
এত গুরুত্বপুর্ন বিষয়ের সভায় উপস্থিতি এবং আলোচনায় অংশগ্রহনের অবস্থা দেখে সত্যিই হতাশ হতে হয়। যেন এ মিটিং এর কোন গুরুত্বই নাই। মিটিং ১০ টায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও প্রয়োজনীয় সংখ্যক সদস্যদের সময়মত উপস্থিত না হওয়ায় নির্ধারিত সময়ের আধা ঘন্টা/ এক ঘন্টা বিলম্বে মিটিং শুরু করতে হয়। আবার এর পরই আরো মিটিং থাকায় আইনশৃঙ্খলা মিটিং সংক্ষিপ্ত করে শেষ করা হয়। প্রতিটা মিটিংয়ের শুরুতে দেখা যায় ইউনিয়ন চেয়ারম্যান এবং সরকারী কর্মকর্তাদের প্রায় শতভাগ অনুপস্থিতি যা, দৃষ্টিকটু এবং দুঃখজনক। মনে হয় তাদের কাছে এ মিটিংয়ের তেমন কোন গুরুত্বই নাই। এছাড়া বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানগন না এসে তাদের প্রতিনিধিকে পাঠান। এমনকি গুরুদাসপুর পৌরসভা আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন স্থান হলেও পৌর মেয়র বা তার অনুপস্থিতিতে নীতিনির্ধারনী ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন প্রতিনিধির উপস্থিতি পাওয়া যায়না।এটা কখনই কাম্য নয়। সভায় সংশ্লিষ্ট সদস্যদের উপস্থিতির অবস্থা দেখে সভার আহবায়ক ইউ এন ও এবং উপজেলা চেয়ারম্যান মহোদয় বার বার চরম ক্ষোভ এবং হতাশা ব্যাক্ত করে যথাসময়ে উপস্থিত থাকার জন্য সদস্যদেরকে কঠোর রুলিং জারী করেও ব্যর্থ হচ্ছেন। কিন্তু মাননীয় সংসদ সদস্য সভায় উপস্থিত থাকলে সেদিন দেখা যায় মিলনায়তন পুর্ন হয়ে বসার চেয়ার সঙ্কট দেখা দেয়।
মাসিক আইনশৃঙখলা সভায় তিনটি আলোচ্য বিষয়ে যেমন , আইনশৃঙ্খলা, নারী ও শিশু নির্যাতন,বাল্যবিবাহ ও যৌতুক এবং মাদক, সন্ত্রাস ,জুয়া ও জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে মুলতঃ আলোচনা পর্যালোচনা এবং বাস্তবায়নের কর্মকৌশল গ্রহন করা হয়।
প্রতিটি সভায় বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের ওপর বেশী গুরুত্ব দিয়ে আলোচনার সুত্রপাত হয়।বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে প্রশাসনের কিছু কার্যকরী পদক্ষেপের কথা আসলেও স্থানীয় সরকার অর্থৎ ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বর,গ্রাম পুলিশদের কোন উল্লেখযোগ্য রিপোর্ট সভায় পাওয়া যায়না। তারা শুধু থানা এবং প্রশাসনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এনে দায়িত্ব শেষ করেন। কাজীরা বা চেয়ারম্যান মেম্বররা ভোট হারানোর আশঙ্কায় এলাকায় বাল্যবিবাহের ঘটনা জানলেও প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহন বা প্রশাসনকে জানাননা।এছাড়া মাসে কতটি বিবাহ হয়েছে তার পরিসংখ্যানগত তথ্যও তারা সভায় উপস্থাপন করেননা। অভিভাবকেরা প্রশাসনের ভয়ে নিজেদের মেয়েকে কৌশলে তথ্য গোপন করে অন্যত্র নিয়ে গিয়ে গোপনে বিয়ে দিচ্ছেন। কোন কোন সময়ে সাহসী মেয়ে অথবা সচেতন ব্যাক্তিদের হট লাইনের খবরে প্রশাসন গিয়ে বাল্যবিবাহ বন্ধ করছেন। উপজেলা চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেন প্রতি সভাতেই কাজীদের বিরুদ্ধে বাল্যবিবাহে সহযোগীতার অকাট্য প্রমান এনে তুলধুনা করে দায়িত্বশীলতা ও সাহসিকতার পরিচয় দেন। মাননীয় সংসদ সদস্য বীর মক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুসও এব্যাপারে জিরো টলারেন্স ভুমিকা রাখেন।তারপরও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ইউপি চেয়ারম্যান -মেম্বর বা কাজী সাহেবদের অনিহা কাটছেনা। ফলে গুরুদাসপুর উপজেলায় বাল্যবিবাহ ক্রমেই বেড়েই চলছে। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা কিছু সুন্দর প্রস্তাব রেখেছেন তা হচ্ছে বাল্যবিয়ের সাথে যে সকল পরিবার বা ব্যাক্তি জড়িত তাদেরকে সরকারী সুযোগ সবিধা বন্ধ করে দেওয়। কাজীরা নিজ কর্ম এলাকার সকল বিবাহের মাসিক রিপোর্ট সভায় উপস্থাপন করবেন। প্রশাসনের একার পক্ষে বাল্যবিবাহ বন্ধ করা সম্ভব নয়। এজন্য স্থানীয় সরকার প্রধান , কাজী, সাংবাদিক , ইমাম, শিক্ষকসহ সমাজের সকলকে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান জানানো হয় ।
উপজেলার আইন শৃঙ্খলা বিষয়ে মাসিক কার্যক্রম অগ্রগতি প্রতিবেদন গুরুদাসপুর থানার অফিসার ইন চার্য তথ্য দিয়ে সভায় উপস্থাপন করেন যা,দায়িত্বশীলতার দাবী রাখেন।উপজেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কার্যকরী পদক্ষেপে বেশ উন্নতি হয়েছে বলে মনে হয়, দুই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া।
এদিকে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. তমাল হোসেন যোগদানের পর থেকে সভায় আলোচিত সমস্যাসমুহ গুরুত¦ দিয়ে উপজেলা চয়ারম্যান এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগীতায় বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা উন্নয়নে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।আমি মনে করি উপজেলা চেয়ারম্যান এবং নির্বাহী অফিসারের চাপবিহীন সমন্বিত উন্নয়ন কার্যক্রম তারুন্যের অহংকার। উদাহারন স্বরূপ বলা যেতে পারে , সভায় আলোচিত মেয়েদের উত্যক্তকারী বখাটেদের বিরুদ্ধে এ্যকশন, বিদ্যালয়ে ছদ্ববেশে ঝটিকা অভিযান,নদী খেকোদের তালিকা তৈরী, বখাটেদের দ্রুতগতিতে বেপরোয়া মটর সাইকেল চালানো এবং হেলমেটবিহীন চালক এবং মাদকের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহন করায় অনেকটা শৃঙ্খলা ফ্্্্্্্্্্্িরে এসছে।
প্রতিটা সভাতেই আলোচনায় আসে সড়কে যাত্রী,পথচারী আর শিক্ষার্থদের নিরাপত্তায় বেপরোয়া যানবহনের গতি প্রতিরোধে রোকেয়া স্কুল এন্ড কলেজ মোড়ে এবং থানার মোড়ে সড়কে প্রয়োজনী সংখ্যক স্পীড ব্রেকার স্থাপনের। এছাড়া ইট ,মাটি এবং পন্য বহনকারী পাওয়ার ট্রিলার বিকট শব্দে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, উপজেলা পরিষদ , পৌরসভা এবং থানার সামনে দিয়ে বেপরোয়া গতিতে চলাচল করছে। এত শব্দদুষন হলেও প্রতিরোধের কোন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছেনা। শব্দদুষন এবং বেপরোয়া গতিতে প্রতিদিনই দুর্ঘটনা ঘটছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান, পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি পরিক্ষায় মনোযোেগে চরমভাবে বিঘœ ঘটছে।এছাড়া স্বভাবিক শ্রবনশ্িক্ত হারাচ্ছে। এব্যপারে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবী উঠেছে বারার। বিষয়টি শিশু ও জনগুরুত্বপুর্ন নিরাপত্তামুলক হওয়্া সত্বেও কার্যকরী দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছেনা কেন ? তা প্রশ্নবিদ্ধ । পিএসসি,জেএসসি-জেডিসি, এসএসসি এবং এইচএসসিসহ কোন পরিক্ষাকেই গুরুত্ব দেয়া হচ্ছেনা। শিক্ষার্থী এবং পরিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ বিবেচনায় নিয়ে পরিক্ষা ও শ্রেনি কক্ষে ক্লাশ চলাকলিন সময়ে শব্দ দুষনকারী পাওযার ট্রিলার চলাচল ও মাইক বন্ধ রাখার ব্যবস্থা করা যায় কিনা তা প্রশাসনের ভেবে দেখা দরকার বলে মনে করছি এবং দাবীও করছি।
সভায় আরো আলোচনায় আসে,গ্রামে গ্রামে ব্যাঙের ছাতার মত গড়ে ওঠা গ্রমিন রেজিষ্ট্রিবিহীন সমবায় সমিতি এবং ব্যাক্তিগত ভাবে চরাসুদে দাদনে স্বল্প আয়ের মানুষদেরকে ঋন দিয়ে ব্যবসা করছে। এতে চরাসুদে ঋনগ্রহিতারা সর্বশান্ত হচ্ছে।এছাড়া কোন নিয়মকানুন না মেনে একেকজন ৩/৪টি এনজিও থেকে ঋন নিয়ে সর্বনাশা ঋনের জালে আটকা পড়ে বেড় হতে পারছেনা। ঋনের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ কামনা করাহয় আইন শৃ্খংলা সভায়। উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আলাল উদ্দিন শেখ, বিযাঘাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হক, সাংবাদিক , বীর মুক্তিযোদ্ধারাসহ অনেকেই এ বিষয়ে অভিযোগ উত্থাপন করেন। প্রতিরোধের নানা সিদ্ধান্ত হয় , তদন্ত কমিটি হয় কিন্তু তা কাগজে কলমেই, বাস্তবায়নের মুখ আর দেখেনা। আমার বড় ছেলে যিনি বর্তমানে গনপূর্ত বিভাগের সাব- ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার কলেজে ছাত্র থাকাকালীন একটি ঘটনার তদন্ত কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে মন্তব্য করেছিলেন-তদন্ত কমিটিকে মনিটরিং করতে একর পর এক শুধু কমিটিই হবে কিন্তু তদন্ত রিপোর্ট কখনই আলোর মুখ দেখেনা। মন্তব্যটা বাস্তবিকই সত্য। আসলে উপজেলা আইনশৃংখল সভায় যা সিদ্ধান্ত হচ্ছে তা শুধুই রুটিন ওয়ার্কে না রেখে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলি বাস্তবায়নের জোড়ালো পদক্ষেপ গ্রহন করা হোক। তাতে এই আইন শৃঙ্খলা সভায় যে সময় ও অর্থ ব্যয় হয় তা সার্থক হবে।
# মোঃ আবুল কালাম আজাদ ,সভ্পাতি, চলনবিল প্রেসক্লাব, গুরুদাসপুর,নাটোর# ০১৭২৪ ০৮৪৯৭৩ তারিখ-৭/৩/২০২১