মো. আবুল কালাম আজাদনাটোরের গুরুদাসপুর থেকে প্রকাশিত একমাত্র সংবাদপত্র দৈনিক দিবারাত্রী ২৩ জানুয়ারী প্রকাশিত পত্রিকার প্রথম পাতার একটি সংবাদ পড়ে বিস্মিত ও হতভম্ব হয়েছি। সংবাদটির শিরোনাম ছিল “কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দাবী সুদে কারবারিদের বিরুদ্ধে, গুরুদাসপুরে সুদের খপ্পরে ৫০০ পরিবার এলাকা ছাড়া” । একই শিরোনামের সংবাদ বিভিন্ন জাতীয় ও আঞ্চলিক পত্র পত্রিকাতে এবং ইলেক্ট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়াতে গুরুত্বসহকারে প্রকাশ ও প্রচার হয়েছে। এর আগেও মহারাজপুরের ভুক্তভোগী অসহায় ভুমিহীন উম্মেহানি সুদের বেড়াজাল থেকে মুক্তি পেতে নিজের কিডনি বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ।এমনকি আত্মহত্যারও পথ খুঁজছিলেন।দৈনিক দিবারাত্রীসহ স্থানীয় সচেতন সংবাদকর্মীরা এগিয়ে এসে মানবিক আবেদন জানিয়ে এ ধরনের সংবাদ দিবারাত্রীসহ জাতীয় ও আঞ্চলিক পত্র পত্রিকায় অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে প্রকাশ ও প্রচার হয়েছিল। বিষয়টি জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের নজরে এলে উপজেলা নির্বাহি অফিসার মো. তমাল হোসেন তড়িৎ পদক্ষেপ নিয়ে সংশ্লিষ্ট সুদের কারবারি ও এনজিও কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় সুদসহ ঋণ মওকুফের ব্যব¯স্থ করেন। ইউএনও সাহেব মানবতা দেখিয়ে কিছু আর্থিক সাহায্যও করেন। নাটোরের জেলা প্রশাসক শাহরিয়াজও উম্মেহানিকে আর্থিক সাহায্য করে ঋণের দায় থেকে মুক্তির ব্যব¯স্থ করেন। এমনকি ঋণব্যবসায়ী এনজিও থেকেও ঋণের দাবি মওকুফের ব্যব¯া’ করেন।
এমনি সংবাদ একই পত্রিকায় গত ৫ ফেব্রুয়ারী সংখ্যার শেষের পাতায় ‘সুদ ব্যবসায় কোটিপতি টিপু সুলতান’ শিরোনামের সংবাদটি ব্ল্যাকসেডে আরো গুরুত্বসহকারে ছাপা হয়েছে।সংবাদটির সারমর্ম হচ্ছে, উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের গোপিনাথপুর গ্রামের মৃত মোতালেবের ছেলে সুদে ব্যবসায়ী টিপু সুলতান সুদের ব্যবসা করে শুন্য থেকে আজ কোটিপতি হয়েছেন। তার কাছ থেকে নাজিরপুর বটতলা গ্রামের জনৈক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মাহবুবুর রহমান নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করে এবং ব্লাঙ্ক চেক জমা রেখে মাসে ১০% সুদে ৪ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে মাসে ৪০ হাজার টাকা নিয়মিত সুদ দিচ্ছেন। এর মধ্যে ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার কারণে সুদের কিস্তি দিতে অনিয়ম হওয়ায় সুদকারবারি টিপুসুলতান জামানতের ব্লাঙ্ক চেকের বিপরিতে ২৪ লাখ টাকা দাবী করে মামলা করার হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন।মাহবুবের আরজি ,তার সমস্ত জমি বিক্রি করেও ঋণের টাকা শোধ হবে না।এদিকে সুদে কারবারি টিপুর হুমকিতে মাহাবুব বর্তমানে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
এ প্রতিবেদক সরেজমিনে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে তথ্য যাচাই করতে গিয়ে আরো ভয়াবহ চিত্র দেখেছেন যার কিছু এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হলো। মশিন্দা বাহাদুর পাড়ার মৃত আলী আসগরের পুত্র মফিজের স্ত্রী জো¯œা বেগম বিভিন্ন এনজিও এবং সুদে কারবারির কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে সুদসহ ঋণের টাকা ও কিস্তির টাকা না দিতে পেরে বিষপানে আত্মহত্যা করেন । পরে ঋণের চাপ ও স্ত্রী শোকে দরিদ্র ভ্যানচালক মফিজ মাসখানেক হলো মারা যান। কিন্ত ঋণের বোঝা বইতে হচ্ছে তার সন্তানদের।সন্তানরা নিজেরাও ঋণগ্রস্থ থাকায় বাড়ি থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
একই গ্রামের মৃত নজিরের ছেলে আব্দুল লতিফও সুদ কারবারির কাছ থেকে ঋণ নিয়ে সময়মত কিস্তি ও ঋনের টাকা না দিতে পারায় নিজের বসতভিটা সুদ ব্যবসায়ির নামে লিখে দিয়ে অন্যের ভিটায় বাস করছেন। খুবজিপুর ইউনিয়নের বালশা হাড়িপাড়া গ্রামের রহমান প্রামানিকের ছেলে রফিকুল ইসলাম ঋনের দায়ে আত্মহত্যা করেছেন ।বালসা ফকিরপাড়া গ্রামের কামাল হোসেন, বালসা বড়পাড়া গ্রামের জমির উদ্দিন সহ অনেকেই মহাজনের ঋণের চাপে বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়েছেন। চাপিলা ইউনিয়নের মহারাজপুরের উম্মেহানির কথাতো বারবার সামনে আসছে ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে ,গুরুদাসপুর উপজেলার পৌরএলাকাসহ প্রতিটা ইউনিয়নের প্রতিটা গ্রমে পাড়ায় কিছু ভুঁইফোর সুদব্যবসায়ি ব্যক্তিগতভাবে এবং নিবন্ধনবিহীন গ্রাম্য সমিতির মাধ্যমে বেশী মুনাফার লোভে ঋণের ব্যবসা করে রাতারাতি শুন্য থেকে কোটিপতি হচ্ছে। এসব সুদ ব্যবসায়ির কাছ থেকে মাসিক শতকরা ১০%-১৫% হারে কোন কোন ক্ষেত্রে ২০% সুদে জামানত ছাড়াই সহজেই ঋণ পাচ্ছে গ্রামের স্বল্প আয়ের মানুষ। তাই প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে মোটা অংকের ঋন নিয়ে সময়মত সুদের টাকাও পরিশোধ করতে না পারায় চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ বেড়ে যায়। ফলে ঋনের বেড়াজাল থেকে বেড় হতে পাড়েনা। ঋনের কিস্তি দিতে আবারো ঋন নিয়ে কিস্তির টাকা দিতে বাধ্য হ”েছন ঋন গ্রহীতারা। এতে ঋনের বেড়াজালে অক্টোপাসেরমত আটকে যা”েছ। সুদসহ অভিশপ্ত ঋন আর শোধ হয়না। পরবর্তীতে ভিটেমাটি বিক্রী করেও ঋনের দায় থেকে মুক্তি পায়না।
এমনি একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে ২ ডিসেম্বরের দৈনিক নাটোর কন্ঠ পত্রিকায়। খবরের শিরোনাম ছিল“ জমিন মল্লিকের সুদের ফাঁদে সর্বশান্ত হচ্ছে মানুষ”।খবরের সারবস্ত হচ্ছে-গুরুদাসপুরে প্রতিবন্ধী শিশুসন্তানের চিকিৎসার জন্য সুদে কারবারি জমিন মল্লিকের কাছ থেকে লাভের উপর ৩ হাজার টাকা ঋন নিয়েছিলেন শিশুটির বাবা রতন শাহ। ওই টাকার বিপরিতে গেল এক বছরে সুদ হিসেবে সপ্তাহে ২০০ টাকা করে প্রায় ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছেন তিনি। আসল ৩ হাজার টাকা চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে এখন ১০ হাজার টাকা হয়েছে। এই টাকা পরিশোধের জন্য রতন শাহকে কর্মস্থল থেকে ধরে এনে শারিরীক নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে সুদে কারবারি জমিন মল্লিক আর তার স্ত্রীবেবি বেগমের বিরুদ্ধে। এ ধরনের অভিযোগ প্রায়শই শোনা যাচ্ছে । থানায় মামলাও হচ্ছে। তারপরও বেড়েই চলেছে চরা সুদের মহাজনী ব্যবসা।
আরো জানা যায়, গ্রামে ধর্মীয় দোহাই দিয়ে ঋন হিসেবে নগদ টাকার লেনদেন না করে ননজুডিশিয়াল ষ্ট্যাম্পে নিজস্ব জমি না থাকলেও অদৃশ্য এক বিঘা জমি দেখিয়ে ঋনদাতা মহাজনের নামে কট বা বন্ধক হিসেবে লিখে দিয়ে বিঘায় একলাখ বা প্রয়োজনমত অধিক টাকা নিচ্ছে লোকেরা।সেই টাকা থেকে লাখে ১০ থেকে ২৫ হাজার টাকা বাৎসরিক লিজ মানি হিসেবে দিয়ে একলাখ টাকার বিপরিতে মাত্র ৭৫/৯০ হাজার টাকা পাচ্ছেন ভাসমান জমি কট দাতা। যতদিন আসল টাকা শোধ করতে না পারবে ,প্রতি বছর বিঘায় ১০-২৫ হাজার টাকা লিজ মানি দিতে হচ্ছে। সময়মত লিজের টাকা দিতে না পারলে আসলে যোগ হয়ে চক্রবৃদ্ধি হয়ে যায়।এভাবেই নতুন নতুন পদ্ধতিতে গ্রামের সাধারণ মানুষকে জিম্মিকরে সুদের কারবার চলছে। অদৃশ্য কটের জমির টাকা লাভসহ না দিলে নন জুডিশিয়াল ষ্ট্যাম্পের বলে আদালতে বেশী টাকার দাবি করে মামলা করার হুমকি দিেেচ্ছ অথবা জোরপুর্বক জমি নিজ নামে লিখে নিচ্ছে অথবা ধরে নিয়ে নির্যাতন চালাচ্ছে দাসত্বের কায়দায়।
সাধারন মানুষ একাধিক বা ততোধিক এনজিও এবং মহাজনের কাছ থেকে ঋন নিয়ে অন্যান্য ঋনের কিস্তি দিচ্ছে। কাজ না থাকলে অথবা আয় না থাকলে সুদ এবং ঋনের কিস্তি দিতে না পারলে এনজিওর এবং মহাজনের অত্যাচারে বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে অথবা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছে। এভাবে ঋণের বেড়াজালে সর্বসান্ত হচ্ছে গ্রামের মানুষ যা দেখার কেউ নেই। এ বিষয়টি উপজেলার মাসিক আইনশৃঙ্খলা সভায় এই প্রতিবেদক এবং সাংবাদিকসহ বিয়াঘাট, চাপিলা, খুবজিপুর, ধারাবরিষা ,মশিন্দা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ,উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যন অবৈধ সুদ কারবারিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য বারবার দাবি জানান । কিন্তু সম্পুর্ন অবৈধ অনিয়মতান্ত্রিকভাবে চলমান অধিক মুনাফাখোর মানুষের রক্তচোষা সুদে কারবারিদের বিরুদ্ধে উপজেলা প্রশাসন ্এমন কোন দৃশ্যমান আইনগত শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নিতে পারে নাই যা ভুঁইফোর সুদে ব্যবসায়ীদের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এর পলে সুদী ব্যবসায়ীরাই আরো উৎসাহিত হচ্ছে।
দেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে চলেছে।। ব্যাংকিং সেক্টরে যেখানে ঋনের সিলিং ওয়ান ডিজিটে নেওয়ার জন্য সরকার কঠোর অবস্থানে, সেখানে গ্রামের মানুষ কৃষির উন্নয়নের জন্য ১০% থেকে ২৫% মাসিক চক্রবৃদ্ধি হারে ঘরোয়া গ্রামীণ সুদে ঋন নিয়ে সুদমহাজনের কাছে জিম্মি হয়ে সহায় সম্বল হারিয়ে নিঃশ^ হচ্ছে। এতে দেখা যাচ্ছে গ্রাম পর্যায়ে সরকারের কাঙ্খিত উন্নয়নের চাকা উল্টাদিকে ঘুরছে।বর্তমান সরকারের কাঙ্খিত উন্নত রাষ্ট্রের ভিশন বাস্তবায়ন করতে হলে আর বিলম্ব নয়,এখনই সুদের মহাজনী কারবারিদের লাগাম টেনে ধরতে হবে । সেই সাথে আর্থিক ঋনদাতা এনজিওর ঋনপ্রদানের ক্ষেত্রেও ওভারল্যাপিং বন্ধ করতে হবে। বিষয়টি নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই গুরুত্বসহকারে দেখা উচিৎ বলে জনসাধারণ মনে করেন।
লেখক : সভাপতি, চলনবিল প্রেসক্লাব , গুরুদাসপুর, নাটোর # ০১৭২৪ ০৮৪৯৭৩ ।