হাদিউল হৃদয়
এই মাস- স্বাধীনতার মাস। বাংলাদেশের ইতিহাসে বাঙালির এক অবিস্মরণীয় তাৎপর্যপূর্ণ মাস। সুজলা, সুফলা, নদী বিধৌত বাংলা নামের ভূখ- হানাদার মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে বিজয় ছিনিয়ে আনে। এ বিজয় একদিনে অর্জিত হয়নি। এর পেছনে আছে আন্দোলন, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের এক সুদীর্ঘ ইতিহাস। তাই এ মাসে জনসাধারণ তো বটেই রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে ছাত্র, শিক্ষক, শিল্পী ও সাহিত্যিক সবার মনেই কাজ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শানিত অনুভূতি। এক্ষেত্রে শিল্পী-সাহিত্যিক নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন। তাদের শিল্পকর্মে প্রতিফলিত হয় সে কল্পনা-ইচ্ছার ছাপ। কবিতায়, চিত্রকলায়, গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে তা নানাভাবে বিধৃত হয়েছে। সবমিলিয়ে বাংলা সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ বিপুল অংশজুড়ে স্থান পেয়েছে। শুধু তাই নয়, বাঙ্গালীর জীবন ও অস্তিত্ব জুড়েই আছে স্বাধীনতার রক্তপ্রবাহ।
৪৮ বছর পর হানাদার মুক্ত দেশ ও দেশের যে শব্দটির মর্মার্থ অনুধাবন করতে পেরে মানব জীবন, পুত্র পরিজন, প্রেমময়ী স্ত্রী, ধন, ঐশ্বর্য সবই তুচ্ছ জ্ঞান করেছে, সে শব্দটি হচ্ছে ‘স্বাধীন’ বা ‘মুক্ত’। এই নামের মধ্যে কি মোহমায়া ও মাহাত্ব্য রয়েছে। এটা পেলে বা কি পাওয়া যায়, আর না পেলেই বা কি হারায়? একটা দেশ, জাতি অথবা জনসমষ্টি তখনই বিদ্রোহ করে যখন তারা পদে পদে লাঞ্চিত, অপমানিত এবং তাদের ন্যায্য দাবী থেকে বঞ্চিত হয়। ১৯৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে রায় দুর্লভ, উমিচাঁদ, জগৎ শেঠ প্রমূখ মীরজাফররা প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ে জঘন্য ভূমিকা রাখে। সেই স্বাধীনতা সূর্য অস্ত যাবার পর থেকে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলন পরিচালনায় নেতৃত্ব দিয়েছে বাঙ্গালি বীর সন্তানেরা। ফলশ্রুতিতে আজকের বাংলাদেশ, আজকের স্বাধীনতা, আজকের মুক্ত জীবন।
১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ পর্যন্ত যে সংগ্রামী চেতনা এবং দৃঢ় সংকল্প নিয়ে প্রতিটি সংগ্রাম-আন্দোলন অভূত্থান পরিচালিত হয়েছে, যে সংগ্রাম করতে গিয়ে আমাদের লক্ষ লক্ষ জীবন কোরবানী দিতে হয়েছে, রক্তে বয়ে গেছে নদী-রাজপথ; মা-বোনেরা দিয়েছে ইজ্জত, স্বামী, সন্তান সেই সংগ্রামী চেতনা আজ যেন স্তিমিত-অস্তমিত তথা ধুলি ধুসরিত। কেন আজ তবে আমাদের পলায়নপর মনোবৃত্তি? কেন আত্মপ্রবঞ্চনা ? আজ দেশের মানুষ বিশেষ করে বুদ্ধিজীবি-রাজনীতিবিদ-শিক্ষকগণ এত বেশি পরশ্রীকাতর আর হিংসায় উন্মত্ত যে, অবস্থা দৃষ্টে তাদের করুণা করা ছাড়া আর কিছু বলতে ইচ্ছে করে না। দেশ জাতিকে তারা করেছে তাদের ব্যবসায়ের মূলধন, স্বার্থ উদ্ধারের পূঁজি। অথচ দেশ জাতিকে যাদের দেবার কথা সর্বাধিক, যাদের কাছ থেকে পাবার আশায় জাতি অধীর প্রত্যাশায় উন্মুখ আজ দেশ প্রেমের তথাকথিত তকমা আর রামাবলী গায়ে চাপিয়ে নিজেদের উদর স্ফীত আখের গোছানো এবং পরস্পর-পরস্পরের প্রতি পেশিশক্তি লেলিয়ে দিয়ে কাদা ছোড়াছুড়িতে লিপ্ত। আজ আগুন, বোমা, বন্দুক, হকিস্টিক, কিরিচসহ নানা অস্ত্র পেশা শক্তির মূলধন। যত বেশি কাঁদা ছুড়তে আর গলাবাজিতে যে যত বেশি দক্ষ; প্রতিপক্ষকে যেভাবে হোক চোখ-মুখ-চেহারা বিবর্ণ, বিকৃত করে বা পরপারে যে ক্ষীপ্র গতিতে আগে পাঠাতে পারবে, তারই হবে কেল্লা ফতে। এই সব করে আমরা চারিত্রিক ও জাতিগতভাবে বিশ্বের কাছে কোথায় নেমে গেছি বা যাচ্ছি সেদিকে কোন তোয়াক্কাই করছি না। এতে কি আমরা শত্রু হননের নামে আত্মহননের পথ প্রশস্ত করছি না? ভাইয়ে-ভাইয়ে বিভেদ-বিভাজনের বিষাক্ত পরিবেশকে আরো ভয়াবহ তুলছি না যা দেখে স্বাধীনতার শত্রুরা উপহাস করে।
জাতীয় চরিত্রের অবক্ষয় ও অধপতন আজ চুড়ান্ত পর্যায়ে নেমে গেছে বললে মোটেই বেশি বলা হবে না। জাতি যে আজ চরম হতাশার সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে এটা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, আইন-শৃংখলা, বিচার ব্যবস্থা, নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও নির্বাচন ব্যবস্থা শিক্ষা ও পরীক্ষা ব্যবস্থাসহ সকল ক্ষেত্রেই এক ধ্বংসোন্মুখী ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বেকার সমস্যা প্রকট হয়ে উঠেছে। নতুন প্রজম্মের সামনে কোন আলোর দিশা নেই। খুন খারাবী, রাহাজানী, গুম, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, জালিয়াতি, চোরা-চালানীসহ সকল প্রকার ঘুষ ও দূর্নীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমন গভীর ও কঠিনভাবে শিকড় গেড়ে বসেছে যে, আপাতত: তার বিরুদ্ধে কিছু করাতো দুরের কথা, কিছু বলাও জীবন সংশয় তথা ঝুঁকিপূর্ণ। তাই যদি না হবে তবে দেশ জুড়ে কেন আজ আত্মবঞ্চনার করুণ মুর্ছনা কান পাতলেই শোনা যায় ? যে সফল রাজনৈতিক ও সসস্ত্র সংগ্রামে অর্জিত স্বাধীনতা। সে স্বাধীনতার সঠিক মূল্যায়ন ও বাস্তবায়ন করতে চাইলে আমাদের আত্মশুদ্ধি ও আত্মসেমালোচনার উন্মেষ ঘটাতে হবে। সে দিনের মতই আমাদের বিপ্লব করতে হবে নৈতিক অবক্ষয় আর চারিত্রিক অধ:পতনের বিরুদ্ধে। যে চেতনা ও দর্শন নিয়ে উপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জন হয়েছে স্বাধীনতা। সেই অমূল্য সম্পদের স্বকীয়তা ও পবিত্রতা সমুন্নত রাখতে হলে আমাদের আত্মপর্যালোচনা এবং আত্ম সংশোধনের সংগ্রামে সমুজ্জল হতে হবে। কারণ, একথা আমাদের অন্তরের অন্তস্থল থেকে অনুধাবন করতে হবে তাহলো, যে, রক্ত¯œাত সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে বিজয় অর্জন হয়েছে তার শরাবন তহুরা পরিতৃপ্তি সহকারে আস্বাদন করতে হলে আমাদের সার্বিক ক্ষেত্রে অবশ্যই সত্যকার ত্যাগ ও দেশপ্রেমের মাধ্যমে উন্নতি বিধান করতে হবে। এতবেশী ভোগের লিপ্সা থেকে আমাদের দূরে থাকতে হবে। যার প্রথম শর্ত চরিত্র গঠন ও আদর্শ শিক্ষা । আমরা যদি লৌহ কঠিন দৃঢ়তা এবং অসীম মনোবলের অধিকারী চারিত্রিক ও শিক্ষার ক্ষেত্রে না হতে পারি তবে উন্নয়ন সম্ভব নয়। দেশের স্বার্থে, জনগনের স্বার্থে, সমাজের স্বার্থে সর্বোপরি নিজের স্বার্থে আমাদের আত্মবিস্মৃতি আর লক্ষ্যচুতি পরিহার করতে পারলেই ঈপ্সিত শিক্ষা-শান্তি-প্রগতি-কৃষ্টি সাংস্কৃতিক তথা সার্বিক উন্নতি সাধিত হবে। তবেই বিশ্বের দরবারে নিজেদের সম্মানিত জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে বাংলাদেশ।
লেখক: কবি-সম্পাদক ,কথা: ০১৭১৫-৬৫৯৯৭০