গাজী সৈদয়দ শুকুর মাহমুদ,
ক্ষণস্থায়ী জীবন, সৃষ্টি জীবনের নিশ্চয়তা নেই। কোন জীবের হায়াতের পূঁজি কখন শেষ হবে তা কেউ’ই জানে না। পিতা রেখে মৃত্যু হচ্ছে পুত্রের, দাদা কাঁধে বহন করছে নাতীর লাশ। যে কোন সময়ে আমারও মৃত্যু হবে তাও জানি কিন্তু জগতের ভালোবাসার টানে অন্তর দিয়ে তাও মানি না। মনে হয় অনন্তকাল সঞ্চিত সকল সম্পদ আমার’ই হবে। মানুষের সংসার, সম্পদ আর সন্তানের ভালোবাসা দেখে মনে হয় অনন্তকাল বেঁচে থাকার আশা। আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআন শরিফে ওয়াজ করেছেন “কুল্লুু নাফসিন জায়িকাতুল মাউত” অর্থাৎ প্রতিটি প্রাণীই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। এ বাক্যটি আমরা সকলেই জানি-বুঝি। আমরা দেখতে পাই প্রতিনিয়ত আমাদের সামনে দিয়ে মৃত্যুবরণ করছে অসংখ্য প্রাণী। আল্লাহ পাক যা সৃষ্টি করেছেন তারই মৃত্যু আছে অনিবার্য। যে কোন বয়সের প্রাণী যে কোন সময়ে মৃত্যুবরণ করছে, এটাই ঠিক। অথচ মানুষ সব দেখেও ভুলে যায়।
একজন বৃদ্ধের জীবনী শক্তি শেষ হয়েছে তবুও সে মরতে চায় না, সে মুত্যুকে ভয় পেলেও তার ধারণা সে আরও দীর্ঘদিন বাঁচবে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় কোন বৃদ্ধের আপনজন সকলেরই মৃত্যু হয়েছে-কেউ’ই বেঁচে নেই, তবুও মরতে চায় না। অনেক বৃদ্ধ বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় মৃত্যের সাথে পাঞ্জা লড়লেও অভিযোগ করে আমায় চিকিৎসা না করে মেরে ফেলছে। আমাকে বাঁচাও, বাঁচতে চাই ইত্যাদি। সকল প্রাণীই মৃত্যের আশংকায় ভীতু, মরণ থেকে দুরে থাকতে চায়। মানুষ মরতে চায় না কেন? মরণে এত ভয়! বাঁচবে অনন্তকাল। আমারও একদিন খেয়াল হলো, আমি মরতে চাই না। মরণ আমার না হোক। বাঁচতে চাই অনন্তকাল। নির্জনে বসে ধ্যান করছি, বেঁচে থাকতে চাই বহুদিন-অনন্তকাল। হঠাৎ কে যেন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “তোর ধ্যান সফল হয়েছে, তুই বাঁচবি বহুদিন-অনন্তকাল”। বল কতদিন বেঁচে থাকলে তোর মনের আশা পূরণ হবে?” আমি তার দিকে চেয়ে বললাম, বাঁচতে চাই তিনশত বছর, তাহলে আমার মনের আশা পূর্ণ হবে। তিনি বললেন “যা…… তোর আবেদন মঞ্জুর, তুই বেঁচে থাকবি তিনশত বছর।” এই বলে সে অদৃশ্য হয়ে গেল। তাকে আর পেলাম না, আর তাকে পাবার প্রয়োজনও মনে করলাম না। তার কথায় আশ্বস্ত হলাম, বুকে সাহস নিলাম। বেঁচে থেকে যা করব তার সকল পরিকল্পনা করে নিলাম। নতুন উদ্যমে আবার জীবন শুরু করলাম, নতুন যৌবনে পদার্পন করলাম। ধ্যানমগ্ন অবস্থায়ই বিয়ে করলাম-সংসার করতে শুরু করলাম। বৈধ-অবৈধ উপায়ে উপার্জন করতে লাগলাম। ভয় নেই বিপদ-আপদ ও মরণের আমি যেন বেসামাল। দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা পেয়ে ব্যবসায় অবাধে দূর্নীতি, শ্রমিক ঠকানো, মালে ভেজাল দেয়া, মিথ্যা সাক্ষী দেয়াসহ অন্যায়-অপরাধ যত আছে তা যেন আমার কাছে পাস কাটিয়ে যেতে না পারে। ধন-সম্পদ সংগ্রহ করলাম, অত্যাধুনিক রকমের বহুতল, বহু কোঠা বিশিষ্ট ইমারত নির্মাণ করলাম। আমার বাড়ির উদাহরণ চলে দেশজুড়ে, মানুষ বলে এ যেন দুনিয়ার স্বর্গ। সখের পশুপাখি পুষলাম খাঁচায় বন্দি করে। বিদেশি কুকুর আনলাম পুষতে, তার থাকার জন্য একটি কক্ষও বরাদ্দ দিলাম। চারপাশে ঝি-চাকর, দাস-দাসী দিয়ে দুনিয়াতে স্বর্গরাজ্য তৈরি হলো আমার। যতদিন যাচ্ছে আনন্দ আর সুখ ততই বাড়ছে, মনে করতে লাগলাম সমগ্র দুনিয়াটা আমার নিয়ন্ত্রণে থাকলে আরও সুখ পেতাম। সারা দুনিয়ার বাদশাহী কামনা আমার। এত ধন-সম্পদ, এত সুখ, এত লোকজন সব যেন তিক্ত হয়ে উঠতে লাগল বয়স সত্তরে উন্নীত হওয়ার সাথে সাথে। একদিন প্রিয়তমা সহধর্মিনীর মৃত্যু হলো, আনন্দের মনিকোঠায় নিরানন্দ দখল নিল। নিসঙ্গতা অনুভব করতে লাগলাম। নিজেকে একা মনে হতে লাগল। এরপর সম-সাময়িক বন্ধ-বান্ধব, ভাই-বোন এক এক করে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছে। পাশে আর কাউকে ধরে রাখতে পারছি না। বয়স যখন শতকে পর্দাপন করল তখন সন্তনেরাও এক এক করে চলে যাচ্ছে ফিরে না আসার জগতে। ছেলে-মেয়ে, কন্যা-জামাতা, ভাতিজা-ভাতিজি চলে যাচ্ছে আমায় রেখে।
আমার নতুন সঙ্গী করে দিয়ে গেল নাতি-নাতনীদের। ওদের সঙ্গী পেলাম, কিন্তু সঙ্গ পাই না। আমার বয়স ইতোমধ্যেই একশত পঁচিশ পাড় হলো। নাতি-নাতনীরাও বৃদ্ধ হয়ে পাড়ি জমালো পরপারে, আমার আশ্রয় হলো তাদের সন্তানদের কাছে। তখন আমি যেন আর কারও আত্মীয় নই এমনই একজন বুড়া মিয়া। তখন আমার আপন বলে আর কেউ নেই, আমি জগতের অসহায় একজন মানুষ। বয়স ধীরে ধীরে একশত পঞ্চাশে উন্নীত হলো। নাতি-নাতনীর ছেলেমেয়েরাও বৃদ্ধ হয়ে এক এক করে চলে যাচ্ছে পরপারে। মনের কথা বলতে ছোট ছোট শিশুদের ডাকি তখন তার মায়েরা শিশুদের হাত ধরে সরিয়ে নিয়ে যায়। বলে তোমার পাশে বসে গল্প করলে চলবে না, ওদের লেখাপড়া করতে হবে। ওদিকে আমার সখের ভূবনের সব কয়টা কক্ষই দখল করে নিয়েছে বংশধরেরা। আমি ঐ বাড়ি হতে চলে গেলে ওরা বাঁচে। আমার জন্য আর অবশিষ্ট নেই। অবশেষে আমার সেই বিদেশি কুকুরের কক্ষটাই বরাদ্দ হলো আমার বাসস্থান। ওরা আমার আপন কেউ নয়, আপন ভাবারও কিছু নেই। তাদের সাথে আমার সম্পর্কটাই বলা যায় না। রাতে শুয়ে শুয়ে সেই কক্ষের দেয়ালের সাথে কথা বলি, ওরাও আমার সাথে বিদ্রুপ করে। উপহাস করে হাসে, খিলখিল করে হাসে প্রতিটি ইট। ওরা বলে অবৈধ উপার্জন দিয়ে আমাদেরকে এনেছিলে, আজ তোমার সেই সখের বালাখানায় তোমার স্থান নেই। কুকুরের ঘরে তোমার স্থান হয়েছে। এরপর হয়তো এখানেও তোমার স্থান হবে না। মনের দু:খে বাড়ি হতে বেরিয়ে বাজারে যাই চায়ের দোকানে, লোকালয়ে একটু বসে থেকে মনটাকে হালকা করতে। দোকানদার এক কাপ চা দিয়ে বলে, এই যে আজন্ম বুড়া, চা দিলাম গিলে উঠে যাও। তুমি থাকলে আমার দোকানে খরিদ্দার বসে না, খেয়ে উঠে যাও।
নানা ঘাত-প্রতিঘাতে বয়স যখন দু’শ বছরে উন্নত হলো ক্রমশ:ই দুনিয়াটা বিষের মত লাগতে শুরু করল। প্রার্থনা করি মৃত্যের, হয় না। কে যেন কানে কানে বলে যায় সময় হয়নি, তোমার সীমানা এখনো অনেক দুরে। হতাশা আর নি:সঙ্গতায় খোলা মাঠে চলে যাই। চৌরাস্তার মোরে একটি গাছ আছে, গাছটি আমার বয়সের চেয়েও বড়। চেয়ে দেখি দুনিয়ার সবকিছুর পরিবর্তন, সামাজিক পরিবেশের অনেক পরিবর্তন কিন্তু ঐ গাছের কোন পরিবর্তন হয়নি। আগের মতই গাছে পাতা গজায়, আরে মত পাখিরা গাছের শাখায় বসে গান করে, গাছের সেই আগের ফলই এখনো ধরে। ভাবলাম ওর কাছে আপাতত: আশ্রয় পাওয়া যাবে। যে আশা নিয়ে ওর কাছে গেলাম তাতে কোন লাভ হলো না, গাছ কথা বলে না, ওকে নীরব দেখে লাঠি দিয়ে পেটালাম তাও কোন জবান নেই। পায়ে ধরে ক্ষমা চাইলাম তবুও কোন সাড়া দেয় না। এ অবস্থা দেখে মানুষ আমাকে পাগল ভাবতে লাগল। ফিরে আসছি এমন সময় সামনে দেখলাম অনেক লোক আমার দিকেই আসছে। ওরা দেশি-বিদেশি সাংবাদিক, আমার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করবে, ছবি উঠাবে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমে প্রচার করবে ইত্যাদি। আমি বার বার বুঝাতে চেষ্টা করলাম, আমার পেটে খাদ্য নেই, বাসস্থান নেই, সেবা বা সঙ্গ দেবার কেউ নেই। তার কোন উত্তর নেই। ওরা শুধু ব্যস্ত নিজেদের উদ্দেশ্য নিয়েই। আমি সারা বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ এটাই ওরা প্রচার করবে অথচ আমার মনের খবর কেউ নেয় না। হঠাৎ ধ্যান ভেঙ্গে দেখলাম আমি সেই নির্জন গাছের তলায় বসে আছি। দিন গড়িয়ে পড়ন্ত বিকেলের রোদ এসে আমার মুখে লাগছে। আমি সেই’ই আছি। এর মাঝে দু’শ বছর পেরিয়ে গেছে। মাত্র দু’ঘন্টার ধ্যানের মধ্য দিয়ে দুনিয়ায় বেঁচে থাকার সকল আশা আকাংখা আমার শেষ। ভাবলাম, অনন্তকাল বেঁচে থাকার সুখের দরকার নেই। প্রিয় পাঠক, ভেবে দেখুন আর কত দিন বাঁচলে পূরণ হবে আপনার দুনিয়ার ভালবাসা।