এম আতিকুল ইসলাম বুলবুল
চলনবিল অঞ্চলে গরু ও মহিষের গাড়ীর চাকা তৈরির কারিগরদের অবস্থা দিন দিন শোচনীয় হয়ে পড়ছে। সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে পিচঢালা গ্রামীন রাস্তা, সড়ক গড়ে ওঠায় ফিকে হয়ে আসছে এক সময়ের জনপ্রিয় বাহন গরু-মহিষের গাড়ীর প্রচলন। আর গরু-মহিষের গাড়ী কমে যাওয়ায় এর সাথে জড়িত শত শত চাকা তৈরির কারিগর বেকার হয়ে পড়েছেন।অর্থাৎ কাঠ দিয়ে চাকা তৈরীর গ্রামীণ পেশা ক্রমশ অস্তি¡ হারাতে বসেছে। ফলে অনেকই পরিবার-পরিজন নিয়ে এখন মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
চলনবিল মূলতঃ সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, রায়গঞ্জ , উল্লাপাড়া, শাহজাদপুর, পাবনার চাটমোহর , ভাঙ্গুড়া , ফরিদপুর নাটোরের সিংড়া, গুরুদাসপুর ও নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে দেশের একমাত্র বিখ্যাত বিল বৃহত্তর চলনবিল অবস্থিত ।
এক সময় এ অঞ্চলে মাটির তৈরি রাস্তার কারণে বা বিলের ফসল পরিবহনে রাস্তা-ঘাট না থাকায় ফসলাদি ও অন্যান্য পণ্য পরিবহন, যাতায়াত এমনকি বিয়ে শাদীতেও বর-কনে আনা নেয়া এবং জা-ঝিদের চলাচলে ব্যাপকভাবে গরু-মহিষের গাড়ী জনপ্রিয় বাহন ছিল চলনবিলের প্রায় প্রতিটি কৃষক পরিবারে। এমনকি এটাই ছিল সত্তুর দশকের পূর্ব পর্যন্ত প্রধান গ্রামীণ যানবাহন।আর গরু -মহিষের গাড়ীর সাথে চাকার সম্পর্ক থাকায় চাকা তৈরির কাজে সে সময় শত শত কারিগর প্রয়োজনের তাগিদেই কাঠের তৈরি গরু-মহিষের গাড়ির চাকা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন অনায়াসে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলনবিল অধুষ্যিত নাটোর জেলার গুরুদাসপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১২ কিঃ মিটার দুরে গ্রামীণ জনপদ মর্শিন্দা ইউনিয়নের আত্রাই নদীর তীরে অবস্থিত কাছিকাটা বাজারে স্বল্প পরিসরে এখনো চাকা তৈরি হচ্ছে।
সেখানে সরেজমিনে কথা হয় চাকা তৈরীর কারিগর নজরুল ইসলামের সাথে । তিনি জানান, বছরের বিভিন্ন সময়ে আমন ধান, বোরো ধান, রসুন , সরিষা , গম সবজি মাঠ থেকে কৃষকের উঠানে ও বিক্রির জন্য বিভিন্ন হাট -বাজারে পরিবহনে গরু-মহিষের গাড়ী কৃষকদের একটি অপরিহার্য বাহন ছিল আর তাতে করেই চাকা তৈরির ব্যবসাটি জম-জমাট ছিল। তবে চলনবিলের প্রত্যন্ত অনেক গ্রামেই অনেক কৃষকের গরু-মহিষের গাড়ীর চাহিদার কারনে চাকার প্রয়োজনীয়তা একেবারেই ফুরায়নি এমনটি জানিয়েছেন চলনবিলের বস্তুল গ্রামের কৃষক ফনী খন্দকার (৬২)। এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল, চলনবিলের বিখ্যাত চাঁচকৈড় বাণিজ্য মোকামে গাড়ীর চাকা তৈরীর সুবাদে এখনো উক্ত হাটের পশ্চিম পাশের একটি রোডের নামকরণ আছে “ চাকার মোড়” নামে।
চাকা তৈরীর কারিগর নজরুল ইসলাম (৬৬) আরো জানান, তার বাড়ি চাপাইনবাগঞ্জ জেলার তানোর উপজেলার পলমা ইউনিয়নের মালবান্ধা গ্রামে। তিনি জানান, প্রায় ৪৭-৪৮ বছর ধরে তিনি চলনবিলাঞ্চলের চাকা তৈরীর বিভিন্ন কারখানায় চাকা তৈরীর কারিগর হিসেবে কাজ করছেন। আর এখান থেকে উপার্যিত অর্থেই তার সংসার চলে। চলনবিলের সর্বত্র এ রকম শত শত কারিগর আগে চাকা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তবে বর্তমানে চাকা তৈরির সাথে জড়িত শত শত কারিগরের কাজ না থাকায় বেকার হয়ে পড়েছেন। আবার অনেকেই প্রয়োজনের তাগিদে পেশা পরিবর্তন করেছেন।
চাকা তৈরি প্রসঙ্গে আত্রাই এর কারিগর নির্মল জানান, বাবলা কাঠের গুড়ি থেকে পাওয়া শক্ত কাঠ দিয়ে তৈরী চাকা টেকসই হওয়ায় অন্য ধরনের কাঠ চাকা তৈরীতে ব্যবহার হয় না। তবে বর্তমানে বাবলা কাঠ ক্রমশই দুস্প্রাপ্য হয়ে ওঠায় এবং এর প্রয়োজনীয়তা কমে আসায় এর সাথে জড়িত কারিগররা এখন সংসার চালাতে হিশশিম খাচ্ছেন।
চাকা তৈরীর আরেক কারিগর সুব্রত সরকার আরো বলেন, চাকা তৈরীর কাজটি পরিশ্রমের। এক জোড়া চাকা তৈরীতে ৫-৬ দিন সময় লাগে। যা ৮-১০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে। আর এক জোড়া চাকা তৈরি করলে একজন কারিগর ৭০০-৮০০ টাকা মজুনী পান। এতে সময় লাগে ৩-৪ দিন।
বর্তমানে চলনবিলের ৯ উপজেলায় হাতে গোনা ৮-১০টি হাট-বাজারে চাকা তৈরীর কারিগরদের দেখা মেলে। গুরুদাসপুরের চাঁচকৈড় বাজারের চাকা তৈরীর কারিগর নৃপেন্দ্র নাথ (৬৫) বলেন, চাকা তৈরীর কাজ কমে আসায় বেশীর ভাগ কারিগরই কাজ না থাকায় তারা পেশা বদল করে অন্য পেশায় চলে গেছেন। শুধুমাত্র চলনবিলের একেবারেই প্রত্যন্ত এলাকার গৈ- গ্রামে কিছু কৃষক গরু-মহিষের গাড়ী ব্যবহার করায় চাকা তৈরীর কাজটি নিভু নিভু করে চলছে। তবে সবকিছু আধুনিক যান্ত্রিক নির্ভর হয়ে পড়ায় গো-শকট আর তাতে চাকার ব্যবহার আর বেশী দিন টিকবে বলে মনে হয় না। ভবিষ্যতের প্রজন্ম এ সম্পর্কে হয়তো ইতিহাসে পড়বে এবং সংরক্ষিত থাকলে তা যাদুঘরে দেখতে পাবে।
লেখক ঃ বিশিষ্ট ,সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও কলামিষ্ট। দৈনিক সমকাল প্রতিনিধি, তাড়াশ।