আবুল কালাম আজাদ
নাটোর জেলার গুরুদাসপুর উপজেলায় ছয়টি ইউনিয়ন পরিষদে গ্রাম আদালতের কার্যক্রমের সুফল পাচ্ছে গ্রামের সাধারণ মানুষ । জমিজমা সংক্রান্ত একটি মামলায় দুর্ভোগের অন্ত ছিল না নাজিরপুর ইউনিয়নের কাশেম আলীর । ত্রিশ বছর মামলা চালাতে গিয়ে সময় ও আর্থিক ক্ষতি এবং নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন তিনি। অতঃপর নাজিরপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান শওকত রানা লাবুর পরামর্শে ইউনিয় পরিষদে গ্রাম আদালতে মামলা দায়ের করেন। মামলায় গ্রাম আদালতে উভয় পক্ষের শুনানী শেষে বিষয়টির শান্তিপূর্ণ নিস্পত্তি হয়।
কাশেম আলীর মত গ্রামের শত শত ভূক্তভোগী মানুষ ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম আদালতে বিচার প্রার্থী হয়ে ছোটখাটো ঘটনার বিচার চেয়ে সুফল পাচ্ছেন। শুধুমাত্র নাজিরপুর ইউনিয়নেই গত আড়াই বছরে গ্রাম আদালতে পাঁচ শতাধিক মামলার শান্তিপূর্ণ নিস্পত্তি হয়েছে বলে চেয়ারম্যান জানান। একারণে ইউনিয়ন পর্যায়ে পারিবারিক ও সামাজিক কলহ বিবাদ তুলনামুলক হারে কমেছে । আর শক্তিশালী হচ্ছে স্থানীয় পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিত¦ । কমেছে মামলাকে ঘিরে দালারদের উৎপাত । ফলে থানা কিংবা বিচারিক আদালতের ওপর নির্ভরতা কমেছে গ্রামীন জনপদের সাধারণ মানুষের। সাশ্রয় হচ্ছে সময় ও আর্থিক দিক দিয়ে । রক্ষা পাচ্ছে হয়রানির হাত থেকে । নাজিরপুর ইউনিয়নের মত উপজেলার মশিন্দা, বিয়াঘাট, ধারাবারিষা ও চাপিলা ইউনিয়নেও গ্রাম আদালতের কার্য্যক্রমের মাধ্যমে গ্রামীণ বিবাদ কলহ মিমাংসা হচ্ছে। ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম আদালতের কার্যক্রম চলে বিচারিক আদালতের আদলে। সেখানে রয়েছে বিচারিক এজলাস,বাদি-বিবাদির দাঁড়ানোর কাঠগড়া, বিচারকের চেয়ার, সাক্ষি ও দর্শনার্থিদের বসার চেয়ার-বেঞ্চ।
গ্রাম আদালত
চলো যাই-ভয় নাই
গ্রাম আদালতে
বিরোধ মিমাংসা হবে
আলোচনা মতে।
ছোট খাটো ফৌজদারী
দেওয়ানী বিরোধ
সহজে নিস্পত্তি হয়
নাই প্রতিশোধ।
বাড়ীর কাছে ইউনিয়ন
আদালত হেথা
হয়রানি-টাকা ব্যয়
হয় না কো সেথা।
সমঝোতা – সৌহার্দে
সব মিটে যায়
শান্তির সুবাতাস
সমাজে ছড়ায়।
গ্রাম আদালত আনে
সম্প্রীতির ছায়া
গ্রাম আদালত পরিচালনার জন্য পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি রয়েছে। চেয়ারম্যান বিচারক, সচিব পেশকার, গ্রাম পুলিশ /দফাদার তামিল কারক, একজন মেম্বর একজন গন্যমান্য ব্যক্তি বিচারিক কাজ পরিচালনা করেন । সপ্তাহের প্রতি বুধবার সকাল ১০ টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত গ্রাম আদালতের বিচারিক কার্যক্রম পরিচালিত গয় ।
গ্রাম আদালতে যে সব বিচারিক কার্যক্রম পরিচালিত হয় তাহল: স্বামী-স্ত্রীর দ্বন্দ¦, নারী নির্যাতন,তালাক , যৌতুক, খোরপোষ, দেনমহরানা,, পারিবারিক কলোহ, মারামারি, জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ, মসজিদ, মাদ্রাসা, মন্দির ও গোরস্থান নিয়ে বিরোধসহ বিভিন্ন ছোটখাটো বিরোধ গ্রাম আদালতের মাধ্যমে নিস্পত্তি করা হয় । সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যাবস্থা নিশ্চিত করতে পাঁচ সদস্যের কমিটির বাইরেও উভয় পক্ষের তিনজনকে সমন্বয় করে আলাদা টিম গঠন করা হয় । তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে আদালতকে অবগত করেন । উভয় পক্ষের সিদ্ধন্তটি আদালতে রায় হিসেবে ঘোষণা করা হয় । এতে ন্যায্য বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়। নাজিরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের ভাষ্যমতে,¯া’নীয় সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালী করা এবং গ্রাম আদালতে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার কারণে নাজিরপুর ইউনিয়ন পরিষদ জেলার সেরা ইউনিয়ন পরিষদ মনোনীত হয়েছে । একারণে নাটোর জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারের কাছ থেকে সম্মাননা হিসেবে এক লাখ বিশ হাজার টাকার বিশেষ বরাদ্দ পাওয়া গেছে । ঐ টাকা দিয়ে আদালতের এজলাস সহ অন্যান্য অবকাঠামো তৈরী করা হয়েছে । আগে সনাতনী পদ্ধতিতে আদালতের কাজ চলতো । গ্রাম আদালতের বিচারে ৮৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারে । বিচারিক আদালত থেকে অনেক মামলা নিষ্পত্তির জন্য গ্রাম আদালতে পাঠানো হয়। সেগুলো নিস্পত্তি করে আবার বিচারিক আদালতে পাঠানো হয় । এতে বিচারিক আদালতের ওপর চাপ কমছে এবং মানুষ উপকৃত হচ্ছে ।
নাজিরপুর ইউনিয় পরিষদের সচিব জালাল উদ্দিন জানান, গত আড়াই বছরে পাঁচ শতাধিক মামলা সুষ্ঠুভাবে নিষ্পত্তি করা হয়েছে। তার মধ্যে বিচারিক আদালত থেকে পাঠানো অন্তত শতাধিক মামলা নিস্পত্তি করে পাঠানো হয়েছে । পরিষদে সপ্তাহে কমপক্ষে ২৫/৩০ টি মামলা স্পিত্তি হয় । বর্তমানে ৫০ টি মামল চলমান আছে। নারী নির্যাতন সংক্রান্ত ও জমিজমার মামলা বেশী থাকে । নাজিরপুর ইউনিয়ন পরিষদ চত্বরে বিচার প্রার্থী মাজেদা বেগম চলনবিল বার্তাকে বলেন , সংসারের অভাবের কারণে অল্প বয়সে মেয়ে সালমাকে বিয়ে দিয়েছিলেন। মেয়ের বাচ্চা হওয়ার পর জামাই রতন আলী নানা অজুহাতে মেয়েকে তার কাছে পাঠায়। থানা , পুলিশ, আদালত সম্পর্কে তার কোন ধারনা না থাকায় ও টাকার অভাবে প্রতিবেশীর সহায়তায় ইউনিয় পরিষদে আবেদন করেন। তিনি এই গ্রাম আদালতে ন্যায্য বিচার পেয়েছেন। আরেক সুবিধাভোগী আনোয়ার হোসেন জানান, একটি মারমারি ঘটনায় তিনি থানায় মামলা করেছিলেন । এতে প্রায় অর্ধ লক্ষধিক টাকা খরচও করেছেন । কিন্তু ন্যায় বিচার পান নাই । পরে নাজিরপুর ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম আদালতে বিচার দিয়ে ন্যায্য বিচার পেয়েছেন । এতে করে প্রতিপক্ষের সাথে হৃদ্যতাও বহাল আছে ।
স্থানীয় বান্দিা শাহজাহান আলী বলেন, প্রায় নিয়মিত গ্রাম আদালতে উপস্থিত থাকেন । গ্রাম আদালত সক্রিয় থাকায় গ্রামে হানাহনি এবং পারিবারিক বিবাদ অনেকাংশে কমেছে । আগে যে কোন ঘটনা ঘটলেই মামলা করার জন্য থানায় কিংবা বিচারিক আদালতে দৌড়াতেন । এতে একশ্রেনি টাউট বাটপার দালালরা বাড়তি সুবিধা ভোগ করতো । বাদি-বিবাদি উভয়েই আর্থিক ক্ষতির এবং নানারকম হয়রানির শিকার হতো । গ্রাম আদালতে ন্যায্য বিচার পাওয়ায় সেসব বিড়ম্বনা কমেছে । তাঁর মতে সারা দেশের গ্রাম আদালতগুলি সক্রিয় হওয়া দরকার। নাজিরপুর ইউনিয়েেনর চেয়ারম্যান শওকত রানা লাবু জানান , কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি দানবীর হাজী মহসিন স্বর্ণ পদক -১৫, নেলসন ম্যন্ডেলা স্বর্ণ পদক -১৪, মহাত্মা গান্ধী স্বর্ণ পি সি এ্যওয়ার্ড- ১৪ এবং স্থানীয় সরকার পুরস্কার অর্জন করেছেন ।তিনি আগামীতেও এই ধারা অব্যাহত রাখার প্রশ্রিুতি দেন। গুরদাসপুর থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ সেলিম রেজা জানান, গ্রাম আদালত সক্রিয় থাকায় তৃনমূলের ছোট খাটো ঘটনায় থানায় মামলা হওয়র প্রবণতা আগের চেয়ে অনেক কমেছে। এটা ইতিবাচক। গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার বলেন, তাঁর উপজেলার সকল ইউনিয়নের গ্রাম আদালতের কার্যক্রম সন্তোষজনক । তবে নাজিরপুর ইউনিয়নের বিচারিক কার্যক্রম গ্রাম আদালতের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে । তার স্বীকৃতি হিসেবে বিশেষ বরাদ্দও পেয়েছেন সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান । এমনি গ্রাম আদালত চলনবিল তথা দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ুক সেটাই সবার কাম্য।